প্রচ্ছদ

সরস্বতী পুজোর অঞ্জলিতে পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে চোখাচোখি হত

মাসির বাড়ির পুজোয় নিয়ে গিয়েছিল মা। সন্ধেবেলায় ফিরতে পারিনি। সেবার এত মন খারাপ হয়েছিল! মহড়া দিলাম কিন্তু অনুষ্ঠান করতে পারলাম না।

ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত

যে জীবন আমি পেয়েছি, যেখানে জন্মেছি, বেড়ে উঠেছি, তা নিয়ে আমার খুশির শেষ নেই। আমরা যে সমস্ত পুজো বা উৎসবের সঙ্গে বড় হই, তা কিন্তু জীবনেরই নানারকম সংস্কৃতির কথা বলে।

ছোটবেলার দিকে তাকালে আমার সবচাইতে প্রিয় উৎসব মনে হয় সরস্বতী পুজোকে। ছেলেবেলার সেই সব সরস্বতী পুজো মানেই অনেক স্মৃতি, অনেক ভালবাসার অভিজ্ঞতা।সরস্বতী পুজো মানেই তো বাসন্তী রঙের শাড়ি। আসলে আমাদের ছোটবেলাকে ফিরে দেখলে মনে হয় গোটা ছোটবেলাটাই বাসন্তী রঙের! কত কথা মনে পড়ে। সরস্বতী পুজোয় সেই অল্প বয়সে কী উত্তেজনা! উপোস করতে হবে। তাড়াতাড়ি স্নান করে নিতে হবে। অঞ্জলি দিতে হবে। সরস্বতীর পায়ের কাছে পড়ার বই, কলম এ সব দিতে হবে। একটা কেমন যেন আনন্দময় ব্যস্ততা। মনে পড়ে সেই লাল নীল মঠ। পুজোর পরে সেগুলো খেতাম। পর্বে পর্বে আনন্দ! দুপুরে লুচি, বেগুন ভাজা, খিচুড়ি। আমাদের বাড়ি পুজো হত যেমন, তেমনই পাশের বন্ধুদের বাড়িতে পুজো হত। সব বন্ধুরা মিলে বিকেলে দলবেঁধে প্রসাদ খেতে যেতাম অন্যদের বাড়ি। সেদিন নিজেদের খুব ফুরফুরে, স্বাধীন লাগত।

বিকেল ফুরিয়ে যেত দ্রুত। হঠাৎ আমরা ছুটতাম বাড়ি। তাড়াতাড়ি তৈরি হতাম। অনুষ্ঠান আছে! আমাদের একটা কমিউনিটি মতন ছিল, সেখানে বড় করে সরস্বতী পুজো হত। সেই পুজোর বিশেষ আকর্ষণ ছিল সন্ধ্যার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। পাড়ার প্রত্যেকে আমরা অপেক্ষা করতাম সরস্বতী পুজো কবে আসবে। এক মাস আগে থেকে মহড়া চলত। আমরা কেউ গান, কেউ নাচ, কেউ নাটকের দলে যোগ দিতাম। খুব মজা হত। আমি নাচতাম। একবার মাসির বাড়ির পুজোয় নিয়ে গিয়েছিল মা। কী কারণে কিছুতেই সন্ধেবেলায় ফিরতে পারিনি। সেবার এত মন খারাপ হয়েছিল! মহড়া দিলাম কিন্তু অনুষ্ঠান করতে পারলাম না। অল্প বয়সের সেই মন খারাপটা এত গভীর ছিল যে, আজও সেই কথা মনে আছে।

এর পর আরেকটু বড় হলে সরস্বতী পুজোর আনন্দে যুক্ত হল নতুন উত্তেজনা। অঞ্জলি দেওয়ার সময় অন্য পাড়ার ছেলেরা আসত। তখন তাদের সঙ্গে চোখাচোখি হত। বুক দুরুদুরু করত তাতেই। একটু ভয় আর অজানা আনন্দ মিলেমিশে রোমাঞ্চ হত। ছেলেদের ছোট ছোট চিরকুট নিয়েও নানা উত্তেজনায় কাটাতাম আমরা মেয়েরা। এরমধ্যে একটু লুকিয়ে কেউ যদি কাউকে বলত, ‘তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে এই শাড়িটায়’ বা ‘খুব সুন্দর লাগছে তোমার চুলের ফুলটা’—ব্যস, আরও মাখো-মাখো অবস্থা! আসলে ছোটবেলা থেকে বড় হওয়ার এই সময়টার অপরূপ সৌন্দর্য আছে। তখন অন্য সকলের মতন ওই সময়টার রোমাঞ্চ গ্রহণ করে আমিও বড় হয়েছি। তখন যাপন করেছি।

আজ যখন ভাবি, ফিরে দেখি, মনে হয় যে ওই সময়ে মানুষের জীবনে ভালবাসার অঙ্কুরোদগম হয়। বৃহৎ জীবনে প্রবেশের আগে এই ভালবাসার অঙ্কুরোদগম। তাই ওই সময়টাকে আমি কখনওই ভুলতে পারি না। হয়তো কেউই পারে না।

বড় হওয়ার পরেও সরস্বতী পুজো আমার জীবনে এক‌ই রকম ভালবাসার। কারণ আমাদের শিল্পী জীবনে সরস্বতী ঠাকুর একটা বড় প্রেরণা। আঁকার স্কুলে তাঁকে পেয়েছি। তারপর যখন সিনেমার জগতে এসেছি, তিনি সঙ্গে থেকেছেন। ‘মুক্তধারা’ সিনেমায় সরস্বতী ঠাকুরের বেশে আমার একটা সুন্দর দৃশ্য ছিল, সেটা খুব মনে পড়ে। সেই ছবিটা এখনও অনেকে তাদের কাছে রেখে দেয়। ছবিটা আমারও খুব প্রিয়। সাদা শোলার সাজে। বেশ কিছু ছবি সরস্বতী পুজোর আগে-পরে মুক্তি পেয়েছে। আমাদের বাড়িতে আজও সরস্বতী পুজো হয়। দীর্ঘকাল ধরে আমি করি, সকলেই জানেন। আমার নাচের দলের ছেলেমেয়েরাই এখন মন দিয়ে করে। সেখানে কতজন এসেছেন। দিনটা আজও মনে বীণা বাজায়।

সরস্বতী পুজো জীবনের অংশ। সরস্বতী দেবী আমাদের কী বলেন? তিনি আমাদের ভেতরের মানুষটাকে বিশুদ্ধ স্বর দেন, শুভ্র পবিত্রতা দেন। আমাদেরকে এই দান লালন করতে হবে সারা জীবন।

কতটা পেরেছি জানি না, কিন্তু আমাকে এখন‌ই বের করতে হবে বাসন্তী রঙের শাড়ি। অঞ্জলি আছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *