তাপস হালদার:
২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৫০ সাল, লোকসংস্কৃতির লীলাক্ষেত্র ফরিদপুর শহরে জন্মগ্রহণ করেন বহুগুণে গুণান্বিত বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়। বাবার চাকুরি সূত্রে প্রাথমিক স্কুল জীবন শুরু হয়েছিল গোপালগঞ্জের এস.এম মডেল স্কুলে। ষাটের দশকের উত্তাল দিনগুলোতে রাজবাড়ী জেলা স্কুলে মাধ্যমিক স্তরে পড়ার সময়ই ’৬২-র শিক্ষা কমিশন আন্দোলন ও ৬৬-র ছয় দফা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। তখন থেকেই রাজনৈতিক জীবনের হাতে খড়ি। তারপর তো ’৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় ছাত্রনেতা হিসেবে রাজেন্দ্র কলেজসহ বৃহত্তর ফরিদপুর জেলায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। ষাটের দশকের শেষের দিকে বৃহত্তর ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগের সিনিয়র সহ-সভাপতির দায়িত্ব নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পূর্ববর্তী সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। ছাত্রলীগের কাজ করতে গিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সাহচর্য লাভ করেন। জাতির পিতার জেষ্ঠ্য সন্তান শহীদ শেখ কামালের সাথে হয়ে যায় বন্ধুত্ব। মুক্তিযুদ্ধের পর বন্ধুত্ব আরো ঘনিষ্ঠ হয় যখন পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে ভর্তি হন। শহীদ শেখ কামাল সব সময় তাঁকে ‘দেশী’ বলে ডাকতেন।
আরও পড়ুন: দেশের প্রতি ভালোবাসাই মে. জে. সি আর দত্তকে অমর করে রাখবে
এদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। প্রগতিশীল প্রতিটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন তৈরির ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের প্রতিষ্ঠাকালীন স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও পরবর্তীতে নির্বাহী সদস্য, ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ শাখার প্রতিষ্ঠাতা সদস্যসহ বহু সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদে তিনি দায়িত্ব পালন করেন।
বাংলাদেশের সকল প্রগতিশীল আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং এখনও দিয়ে যাচ্ছেন। ১৯৮৫ সালে এরশাদের পতন ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দাবিতে গড়ে ওঠা যুব ঐক্যের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও যুব সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা হিসেবে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
১৯৭০ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত জাতীয় যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে অসহায় মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন এবং ত্রাণকার্যে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন।
শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্র ছিলেন তা-ই নয়, সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন, কাজ করেছেন, এখনও বিভিন্নভাবে জড়িয়ে আছেন গণমাধ্যমের সাথে। ছিলেন দৈনিক লাল সবুজ পত্রিকার সম্পাদক। আশির দশক থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের পক্ষে নিয়মিত মূলধারার গণমাধ্যমগুলোতে লিখে যাচ্ছেন। এছাড়াও মৌলিক সাহিত্য, গল্প, উপন্যাস, নাটক, কবিতা ও ছড়ার অসংখ্য গ্রন্থ লিখেছেন।
বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে তিনি বিভিন্ন দেশ সফর করেছেন। উত্তর কোরিয়ার পিয়ংইয়ংয়ে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ছাত্র-যুব সম্মেলন (যেখানে ১৭৫টি দেশের ২৫ লক্ষ প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন), বাংলাদেশের প্রথম প্রতিনিধি হয়ে মিশরের রাজধানী কায়রোতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব, নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু সম্মেলন, কানাডা ও আমেরিকায় অনুষ্ঠিত একাধিকবার ফোবানা সম্মেলন, জার্মানির বার্লিনে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক লোক উৎসব, হলদিয়া ও কলকাতা আন্তর্জাতিক কবিতা উৎসবসহ অনেক আন্তর্জাতিক উৎসবে বিভিন্ন সময়ে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন।
বিখ্যাত মানুষদের হাজারো কাজ থেকে একটি কাজ হয়তো তাঁকে হাজার বছর বাঁচিয়ে রাখে। শ্রদ্ধেয় পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় মুক্তিযোদ্ধা, অভিনেতা, সাংবাদিক, আবৃতিকার, লেখক, গবেষকসহ অসংখ্য সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। এখন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্লাটফরম ‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ’ এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এসবের পরেও আমার মনে হয় শ্রদ্ধেয় আবদুল গাফফার চৌধুরী পরিচালিত ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’ নাটকটির জন্য চিরদিন তিনি স্বমহিমায় উদ্ভাসিত থাকবেন। নাটকটিতে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন তিনি । নাটকটিতে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ও ষড়যন্ত্রের নেপথ্যের কাহিনী সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এটি হতে পারে ইতিহাসের একটি দলিল। নাটকটি যখন তৈরি করা হয়েছিল তখন দেশের প্রেক্ষাপট খুবই খারাপ অবস্থায় ছিল। স্বাধীনতাবিরোধী চারদলীয় জোট সরকারের তাণ্ডবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের লোকদের কথা বলাটাই দায় হয়ে পড়েছিল। সে সময়ে এই ধরনের একটি নাটকে অভিনয় করা মোটেও সহজসাধ্য ছিল না। এই নাটকের জন্য পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়কে লন্ডন, নিউইয়র্ক, ঢাকায় একাধিকবার প্রাণনাশের চেষ্টা করা হয়েছে। তাঁকে এজন্য দেশ-বিদেশে পালিয়ে বেড়াতেও হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে শ্রদ্ধেয় গাফফার চৌধুরী সম্প্রতি একটি আলোচনা সভায় বলেছেন, ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’ নাটকটিতে অভিনয় করার জন্য অনেককেই সেদিন বলেছিলাম, কেউ সেদিন সাহস করেননি। পীযূষ সেই সাহসটি করেছিল’।
আশির দশকের শুরুতে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত ‘সকাল সন্ধ্যা’ নামের টিভি সিরিয়ালে ‘শাহেদ’ চরিত্রে অভিনয় করে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। প্রথম অভিনীত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘আগামী’। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘একাত্তরের যীশু’ তে পাদ্রীর ভূমিকায় অনবদ্য অভিনয় করেন। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ও ‘গেরিলা’য় অভিনয় করেও প্রসংশিত হয়েছেন।
এছাড়াও পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র হলো মহামিলন, উত্তরের খেপ, কিত্তন খোলা, মেঘলা আকাশ, আধিয়ার, আমার আছে জল, মৃত্তিকা মায়া, আমি শুধু চেয়েছি তোমায়, বুনো হাঁস।
বাংলাদেশে বিকল্প ধারার চলচ্চিত্রে প্রধান অভিনেতা ছিলেন পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়। অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি এদেশের মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে সকল ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী-পেশার মানুষদের সাথে নিয়ে গঠন করেছেন ‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ’ নামে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। তিনি নিজে অসাম্প্রদায়িক চেতনা লালন করেন, সে জন্যই সকল ধর্ম বর্ণের মানুষের কাছে সম্প্রীতির বার্তা পৌঁছে দিতেই সম্প্রীতি বাংলাদেশ সংগঠনটি গঠন করেছেন।
বাংলাদেশে এই ধরনের সংগঠন এটাই প্রথম, যেখানে সকল ধর্ম-বর্ণের প্রতিনিধিত্ব আছে। তিনি নিজে সংগঠনটির আহ্বায়ক। স্বাধীনতার সপক্ষের বিশিষ্টজন, গুণীজনদের নিয়ে তিনি সংগঠনটি তৈরি করেছেন। সংগঠনের একজন ক্ষুদ্র কর্মী হয়ে শ্রদ্ধেয় পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় দাদাকে কাছ থেকে কিছুটা দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। আমি দেখেছি, তিনি একজন অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন ও ধারণ করেন, সর্বোপরি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ও দেশরত্ন শেখ হাসিনার পক্ষে একজন অকুতোভয় সৈনিক। তিনি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বাস্তবায়নের জন্য সারা দেশে কাজ করে চলেছেন। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে ‘পথ হারাবে না বাংলাদেশ’ স্লোগানকে সামনে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তিকে বিজয়ী করতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে গেছেন। সম্প্রীতি বাংলাদেশ’র পক্ষ থেকে ‘শতবর্ষের পথে বঙ্গবন্ধু ও সম্প্রীতির বাংলাদেশ’ এবং ‘শতবর্ষে বঙ্গবন্ধু ও সম্প্রীতির বাংলাদেশ’ এই স্লোগানগুলোকে সামনে নিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে শ্রদ্ধেয় পীযূষ বন্দোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে সারা দেশে কাজ করে যাচ্ছে সম্প্রীতি বাংলাদেশ।
এই করোনা মহামারিকালে যখন স্বাভাবিক কার্যক্রম করা যাচ্ছিল না তখন অনলাইন কার্যক্রমের মাধ্যমে তিনি বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদেরসহ সমসাময়িক বিষয় নিয়ে ভার্চুয়াল আলোচনা সভার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।
সমাজ, দেশ, গণতন্ত্র, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে আজীবন কাজ করে যাওয়া এই মহান মানুষটির এখনও মেলেনি কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। আমাদের প্রত্যাশা শ্রদ্ধেয় পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়কে কাজের মূল্যায়ন করে দেয়া হোক রাষ্ট্রীয় সম্মান।
সম্প্রীতি বাংলাদেশ’র অনুষ্ঠানগুলোতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গিয়ে দেখেছি মানুষ তাঁকে কতটা ভালোবাসে, সম্মান ও শ্রদ্ধা করে। মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ দেখেছি। আজ এই মহৎ মানুষটির ৭০তম জন্মদিন। শুভ জন্মদিনে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক: সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা।
ইমেইল: haldertapas80@ gmail.com