সুদেব কুমার বিশ্বাস :
সন্তানের অমঙ্গল চান না কোনো মা-বাবাই। সবাই তাদের সন্তানকে জীবনে সফল হিসেবে দেখতে চান। তা নিশ্চিত করতে গিয়ে অসাধ্য সাধন করেন, জীবন পর্যন্ত বাজ রাখেন। কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় মঙ্গল চান, যে মাত্রায় প্রত্যাশা তৈরি করেন, তা কি সব সময় সঠিক থাকে? কখনও-সখনও সেই প্রক্রিয়ার মধ্যে কোনো ত্রুটি থেকে তো যেতেই পারে। যদি তাই হয়, সেই ত্রুটিযুক্ত প্রত্যাশা নিশ্চয়ই সন্তানের জন্যে মঙ্গল বয়ে আনার কথা নয়।
মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। বেশ আগের কথা। তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। যেখানে থাকি তার পাশেই একটি নামকরা স্কুল। সেই স্কুলের পাশ দিয়েই হেঁটে যাচ্ছিলাম।
দেখছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন স্বনামধন্য শিক্ষক তাঁর মেয়েকে স্কুল থেকে নিয়ে যাওয়ার পথে ভীষণভাবে বকাবকি করছেন। মেয়েটির অপরাধ, সে পরীক্ষায় একটু কম নস্বর পেয়েছে। বকুনির ধরনটা ছিল এরকম- “তোমার লজ্জা হওয়া উচিৎ! এই রেজাল্ট করে তোমার মুখ দেখাতে লজ্জা করে না? আমার ভাবতে লজ্জা লাগছে, তুমি আমার মেয়ে! কিচ্ছু হবে না তোমাকে দিয়ে। তোমার মতো একটা গাধা মেয়ে জীবনে কিচ্ছু করতে পারবে না। আগে বাসায় চলো, তারপর দেখছি!”
অসহায় মেয়েটি বাবার পাশ দিয়ে হাঁটছে আর পিতৃস্নেহের ঝাঁঝ হজম করছে। ভীষণ খারাপ লাগলো দেখে। আবার খুব ভালো লাগলো এই ভেবে যে, কী স্বাধীন জীবন আমার! বলতে গেলে প্রায় নিরক্ষর মা-বাবা আমার পড়াশোনা বা পরীক্ষার ফলাফলের কোনো খবরই রাখতেন না। খবর যে রাখা দরকার, সেটাও তারা মনে করতেন না। তখন খারাপ লাগলেও এখন ভাবছি, সেই স্বাধীনতা ছিল জীবনে মস্ত বড় এক প্রাপ্তি!
আমরা অধিকাংশ মা-বাবাই আমাদের সন্তানদের সত্যিকারের যোগ্যতা মূলায়ন করতে ব্যর্থ হই। আমাদের সন্তানদের তুলনায় এক প্রজন্ম পেছনের মানুষ আমরা। আমাদের সীমাবদ্ধ ধারণা থেকে বিশেষ ঝুঁকি নিই এবং বাজার দরে লোকে ভালো বলে এমন একটি পেশাই তাদের জন্যে আগে থেকেই ভেবে রাখি। এই ভেবে রাখার প্রক্রিয়া খুব একটা গণতান্ত্রিক নয় আবার। বরং মা-বাবা হিসেবে আমাদের দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে নিজেরাই তা ঠিক করে ফেলি। আমার সন্তান কী চায়, সে কীসে ভালো- এসব বিবেচনা অত্যন্ত গৌণ হয়ে যায় তখন।
আমরা কি জানি, পৃথিবীর প্রায় কোনো বিখ্যাত মানুষই তাদের মা-বাবার প্রত্যাশিত উপায়ে বড় হননি, বিখ্যাত হননি? তাঁরা প্রায় সবাই মা-বাবার মতের বাইরে গিয়ে, এমনকি তাঁদের মতের সাথে বিদ্রোহ করে ভিন্ন কিছু করে বিখ্যাত হয়েছেন। আমার কথা বিশ্বাস করার দরকার নেই। এই লেখাটি পড়তে পড়তে একটু থামুন। এবার আপনার খুব ভালো করে জানা বিখ্যাত মানুষদের জীবন-কথা নিয়ে একটু ভাবুন। উত্তর ঠিক পেয়ে যাবেন।
একবার ভাবুন তো, বাবার পছন্দ মতো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যদি শেষ পর্যন্ত ব্যারিস্টারি পড়তেই শুরু করতেন আর পাস করে এসে ওকালতিই করতেন, তাহলে আমাদের এবং সমগ্র বিশ্ববাসীর কী সাংঘাতিক ক্ষতিটাই না হতো!
স্বামী বিবেকানন্দ জীবন শুরু করেছিলেন স্কুল শিক্ষক হিসেবে। সংসারে চরম অভাব তখন। যদি কেবল সেই সংসার চালানোর কথা ভেবে থেকে যেতেন স্কুল শিক্ষক হিসেবেই অথবা অন্য কোনো চাকরি নিয়ে, তাহলেও কত বড় এক সম্পদকে আমরা হারিয়ে ফেলতাম।
ওদিকে অত্যন্ত মেধাবী নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুকে তাঁর উকিল পিতা তৈরি করছিলেন তৎকালীন Indian Civil Service-এ যোগদানের উপযুক্ত করে। নেতাজির মধ্যে যদি বিবেকের সায় না আসত এবং বাবার নির্দেশ মতো আইসিএস অফিসার হিসেবেই যোগ দিতেন, তাহলে ভারত থেকে ইংরেজদের তাড়ানোয় কে অগ্রণী ভূমিকা পালন করত?
কলম্বাসকে কম বেগ পেতে হয়নি সমুদ্র অভিযানে নামতে। কোনোভাবেই কিন্তু পরিবারের অনুমতি মিলছিল না। তিনি পরিবারের কথা শুনলে আরও অনেককাল হয়তো অজানাই থেকে যেত যে, পৃথিবীতে আমেরিকা বলে কোনো দেশ এবং মহাদেশ আছে।
পড়াশোনায় অতি সাধারণ আলবার্ট আইনস্টাইন- এর মা-বাবা হয়তো আশাও করেননি তাঁদের ছেলে এতো বড় কাণ্ড করে ফেলবেন। একেবারে পৃথিবীর সেরা বিজ্ঞানী হয়ে যাবেন। তাঁদের কী যেন যন্ত্রপাতি তৈরির দোকান ছিল। ভাগ্যিস সেই দোকানেই আইনস্টাইনকে ভর্তি করে দেওয়া হয়নি!
অস্তিত্ববাদের প্রবক্তা ফরাসি দার্শনিক জাঁ পল সার্ত্রে তাঁর বাবাকে হারান আট বছর বয়সে আর বারো বছর বয়সের সময় তার মা আবার বিয়ে করেন। পরিণত বয়সে তিনি যখন যথেষ্ট নাম করেছেন তখন কোনো একজন সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, “আমার জীবনের এক মস্তবড় সুযোগ যে, ছোটবেলাতেই আমি মা ও বাবা উভয়কেই হারিয়েছি। কারণ তাঁরা থাকলে আমি আমার মতো হতে পারতাম না। হয়তো তাদের ইচ্ছে মতো কিছু একটা হতাম।”
ভগবান বুদ্ধ কেবলই একজন রাজা হিসেবে জীবন শেষ করতেন যদি তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে না গিয়ে তাঁর মা-বাবার ইচ্ছে মাফিক রাজার ভূমিকাতেই থাকতেন। চৈতন্য মহাপ্রভুর ক্ষেত্রেও সম্ভব হতো না সন্নাসী হওয়া, জীবোদ্ধার করা, যদি তিনি মায়ের কথাই কেবল শুনতেন।
বিশ্বের অন্যতম সেরা ক্রিকেট খেলোয়াড় শচিন টেন্ডুলকার- এর কবি ও অধ্যাপক বাবাও চাননি, ছেলে ক্রিকেটই খেলুক। মা-বাবার কথা শুনে সাধারণের পথ ধরলে শচিনের মতো মোটামুটি মানের ছাত্র জীবনে কী করতেন বলা মুশকিল, তবে ক্রিকেট বিশ্ব বঞ্চিত হতো বিরাটভাবে।
“Lady with the Lamp” নামেই যাঁকে আমরা চিনি, সেই ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল অমর হয়ে আছেন তাঁর সেবা কাজের জন্যে। অথচ তাঁর মা-বাবা কোনোভাবেই চাননি মেয়ে সেবিকার পেশা বেছে নিক। তাঁর মা-বাবা যখন তাঁর বিয়ের আয়োজন করছেন, তিনি তখন বিয়ে না করে জোর করে নার্সিং পড়তে শুরু করলেন। বাকি ইতিহাস সবারই জানা।
বিখ্যাত বলিউড অভিনেতা ’মি. পারফেশনিস্ট’ বলে খ্যাত আমির খানের মা-বাবাও তাঁদের ছেলেকে অভিনেতা নয়, প্রকৌশলী বানাতে চেয়েছিলেন। আমির খান যদি তাঁদের কথাই শুনতেন, তাহলেও কত বড় ক্ষতি হয়ে যেত সিনেমা জগতের। আর বলিউডের এ সময়ের অন্যতম সেরা অভিনেত্রী কঙ্গনা রানাউতের বাবা খুব করে চেয়েছিলেন তাঁর মেয়ে ডাক্তার হোক। অথচ কঙ্গনার ইচ্ছে অভিনয় করার এবং বাবার কথার অবাধ্য হয়ে ঝগড়া করে তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন।
আমরা মা-বাবারা আমাদের সাধারণ ধারণা থেকে আমাদের শিশুদের গায়ে তারা কে কেমন তার একধরনের লেভেল লাগিয়ে দিই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের সত্যিকারের সক্ষমতা সম্পর্কে বিশেষ ধারণা না রেখেই তাদেরকে একধরনের খাঁচার মধ্যে বন্দী করে ফেলতে চাই। ধরুন, একজন শিক্ষার্থী আশা করছে সে একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হবে, কিন্তু পরিবার থেকে বলা হলো তারা তাকে ডাক্তার বানাতে চায়। এটি অত্যন্ত খোঁড়া যুক্তি, বোকা ভাবনা। সন্তান নিজে কী করতে চায়, সে কীসে বেশি ভালো- এগুলোর কোনোই গুরুত্ব নেই সেক্ষেত্রে।
তার মানে, মা-বাবা হিসেবে আমরা কি কোনো কিছুই করতে পারব না? কোনোরকম কর্তৃত্বই ফলাতে পারব না নিজের সন্তানের উপরে? এখানেই কবি জিব্রান খলিল বলছেন তার বিখ্যাত কবিতা On Children এ,
“Your children are not your children.
They are the sons and daughters of Life’s longing for itself.
They come through you but not from you,
And though they are with you yet they belong not to you.”
আরেকটি কথা! আমরা কেউ কি ভেবেছি, আমাদের সবার সন্তান যদি হুবহু আমাদের মনের মতো হয় এবং আমাদের দেখানো পথ অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করে তাহলে এই পৃথিবীর উন্নতিই আসলে থেমে যাবে? কারণ, আমাদের সন্তানেরা আমাদের থেকে এক প্রজন্ম এগিয়ে। তাদেরকে যদি আমাদের ধারণার আলোকে আমাদের মতো করে তৈরি করতে চেয়ে এভাবে এক প্রজন্ম পিছিয়ে রাখি, তাহলে তো তাই হওয়ার কথা! তাহলে কী করব আমরা মা-বাবারা? আবার শরণাপন্ন হতে হয় স্বামী বিবেকানন্দ-এর। তিনি চারাগাছের বেড়ে ওঠার উদাহরণ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “শিশু নিজে নিজেই শিখিয়া থাকে। তবে তাহাকে তাহার নিজের ভাবে উন্নতি করিতে আপনারা সাহায্য করিতে পারেন। সাক্ষাৎভাবে কিছু দিয়া আপনারা তাহাকে সাহায্য করিতে পারেন না, তাহার উন্নতির বিঘ্নগুলি দূর করিয়া পরোক্ষভাবে সাহায্য করিতে পারেন। নিজস্ব নিয়মানুসারেই জ্ঞান তাহার মধ্যে প্রকাশিত হইয়া থাকে। মাটিটা একটু খুঁড়িয়া দিন, যাহাতে অঙ্কুর সহজে বাহির হইতে পারে। চারিদিকে বেড়া দিয়া দিতে পারেন, যাহাতে কোনো জীবজন্তু চারাটি না খাইয়া ফেলে; এইটুকু দেখিতে পারেন যে, অতিরিক্ত হিমে বা বর্ষায় যেন তাহা একেবারে নষ্ট হইয়া না যায়- ব্যাস, আপনার কাজ ঐখানেই শেষ!” আমরা সেটা অনুসরণ করতে পারলে আর বিশেষ কিছু করার দরকার নেই কিন্তু।
তাই বলি, আমরা যেন আমাদের প্রিয় সন্তানকে প্রত্যাশার চাপে পিষে না ফেলি। নিজে যা করতে পারিনি, তা সন্তানের মাধ্যমে দেখতে চেয়ে ওদের স্বাভাবিক বিকাশকে ক্ষতিগ্রস্ত যেন না করি। পরীক্ষায় কত নম্বর পেলো; তার চেয়ে ঢের বেশি জরুরী কতটা চিন্তা করতে শিখল, কতোটা প্রশ্ন তৈরি করতে শিখল, নিজের মতো করে ভাবতে শিখল। আসুন, ওদের মানুষের কাছে নিয়ে যাই, প্রকৃতির কাছে নিয়ে যাই। গাছ-নদী-পাহাড়ের সাথে বন্ধুত্ব করাই। যতোটা সম্ভব, বাস্তব অভিজ্ঞতার মুখোমুখী করাই। নিজের সিদ্ধান্ত ওদের নিজেদেরকেই নিতে দিই।
সুরক্ষার নামে বেড়া তৈরি করে আলো-বাতাস প্রবেশ করা বন্ধ করে যেন না দিই। ওরা অপার সম্ভাবনাময় শিশু, রেসের ঘোড়া নয়। বাঁচতে হলে নিঃশ্বাস নেওয়া চাই। আসুন, আমার-আপনার শিশুকে নিঃশ্বাস নিতে দিই!
লেখক: একজন শিক্ষা ও উন্নয়নকর্মী। কাজ করেন একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায়।
আরো পড়ুন: