স্বাস্থ্য

নিতে হবে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচী

নিখিল মানখিন, ধূমকেতু ডটকম: জনগণের দ্বারে দ্বারে কম খরচে মানসম্পন্ন স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা পৌঁছে দিতে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচী বাস্তবায়ন করার উপর জোর দিয়ছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচী অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়েছে। দেশে ইতোমধ্যে বিক্ষিপ্তভাবে বিদ্যমান রয়েছে কর্মসূচীটির প্রায় সব উপাদান। এখন দরকার উপাদানসমূহের সমন্বয় ও সঠিক ব্যবহার। সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা প্রদানে থাকতে হবে সমন্বয়। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার ধারণায় ২০০৩ সালের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় সহনীয় পর্যায়ে ও সাধ্যের মধ্যে নিয়ে আসার কথা বলা হয়েছে। অথচ আমাদের দেশে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা পেতে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয় এর ৬৭ শতাংশই রোগীকে বহন করতে হচ্ছে।  

স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার মূল কথা হচ্ছে, সব মানুষ প্রয়োজনের সময় মানসম্পন্ন চিকিৎসাসেবা পাবে। চিকিৎসাসেবা নিতে গিয়ে কেউ দরিদ্র হয়ে পড়বে না। উদ্দেশ্য অর্জনে কৌশল হিসেবে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির পাশাপাশি অপচয় ও দুর্নীতি কমাতে হবে, স্বাস্থ্য বীমা মানুষকে সেবাপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা দেবে।

সম্প্রতি সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জন করতে হলে সবাইকে আন্তরিক হতে হবে। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা শ্লোগান হিসেবে শুনতে ভাল। কিন্তু এই জনবহুল দেশে বাস্তবায়ন করা খুব কঠিন। অর্থ ছাড়া মানসম্পন্ন সেবা দেয়া সম্ভব নয়। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জন করতে হলে স্বাস্থ্য, অর্থ ও জনপ্রশাসনসহ আরও বেশকিছু সংখ্যক মন্ত্রণালয়কে একসঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে বলে মনে করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, স্বাস্থ্য সেক্টরে জনবল বৃদ্ধি, অবকাঠামোর উন্নয়ন, মাতৃ ও শিশু মৃত্যু হ্রাস, ওষুধের সরবরাহ বৃদ্ধি, কমিউনিটি ক্লিনিক চালু, স্বাস্থ্য খাতে ডিজিটাল বাংলাদেশ কার্যক্রম ইত্যাদি উন্নয়নমূলক উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সফলতা পেয়েছে সরকার। কিন্তু সরকারি স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামোর দক্ষ ও ফলপ্রসূ ব্যবহারের অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি। চিকিৎসা সরঞ্জাম ক্রয়, সংগ্রহ, রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামত এবং সংস্কার করার জন্য প্রচলিত সরকারি নীতিমালা সময়সাপেক্ষ ও জটিল হওয়ায় সেটি প্রায় স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে অন্তরায় হয়ে উঠে। পর্যাপ্ত জনবল, আর্থিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতাসহ প্রয়োগধর্মী জাতীয় স্বাস্থ্য গবেষণা ব্যবস্থার অভাব রয়েছে। এতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও কর্মসূচী, সেবা প্রদান ও গরিববান্ধব নীতিমালা প্রণয়ন এবং গবেষণার মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন বিঘ্নিত হয়। স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ব্যবস্থাপনা উন্নত করার উদ্দেশ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার এখনও যথেষ্ট নয়। এক্ষেত্রে বিভিন্ন পর্যায়ের স্বাস্থ্য জনশক্তির আগ্রহ ও দক্ষতার অভাব এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অপ্রতুলতা বেশ দৃশ্যমান। সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ওষুধ সরবরাহের অপর্যাপ্ততা, জনবলের অভাব, যন্ত্রপাতি ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রের স্থাপনায় রক্ষণাবেক্ষণের দুর্বলতা ও প্রশাসনের জটিলতা এবং সুসংগঠিত রেডারেল পদ্ধতি না থাকায় স্বাস্থ্য অবকাঠামোর পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা যাচ্ছে না।

দেশে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে সৃষ্ট বর্জ্যের ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ, পেশাগত স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তার দিক দিয়ে সন্তোষজনক নয়। স্বাস্থ্যসেবার পূর্ণতা অর্জনের জন্য সরকারি এবং বেসরকারি খাতে অর্থের সংকুলান ও ব্যবস্থাপনা অপর্যাপ্ত। উন্নত স্বাস্থ্যসেবা এখনও অনেকটাই জেলা ও বিভাগ কেন্দ্রিক। উপজেলা পর্যায়ে  বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ উন্নত চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা নেই।

সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা বাস্তবায়ন করতে বাংলাদেশকে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে, কিন্তু অসম্ভব কিছু নয়। স্বাস্থ্য বীমা শুরু হলেও তা দেশের মাত্র একটি জেলার তিনটি থানায় পাইলট প্রকল্প হিসেবে চালু রয়েছে। এমতাবস্থায় সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা কাঠামোর বিভিন্ন উপাদানগুলোর মধ্যে সমন্বয় ঘটাতেই হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

প্রাপ্তির  ক্ষেত্রে  অসমতা :

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের ক্ষুদ্র আয়তন ও সীমিত সম্পদের বিপরীতে রয়েছে জনসংখ্যার বিস্ফোরণ। ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে রয়েছে আকাশচুম্বী বৈষম্য। স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি ও ভোগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন শ্রেণীর জনগোষ্ঠীর মধ্যে বড় ধরনের পার্থক্য রয়েছে। কিছু কিছু অসমতা এতটাই তীব্র ও প্রতিকূল যে, সমষ্টিগতভাবে তা দেশের অগ্রগতির অন্তরায়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য খাতে অর্জিত সাফল্য টিকিয়ে রাখাই কষ্টকর। আবার কিছু ক্ষেত্রে স্থবিরতার লক্ষণ দৃশ্যমান। দরিদ্র-মধ্যবিত্ত-ধনী সব শ্রেণীর মানুষের জন্য ন্যূনতম মানসম্পন্ন চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদান জরুরী হয়ে পড়েছে। আর এমতাবস্থায় দেশে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচী বাস্তবায়নের বিকল্প নেই।

স্বাস্থ্যের জন্য নিজের পকেট থেকে ব্যয় হয়  ৬৭ শতাংশ :

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হেলথ ইকোনমিক্স ইউনিটের তৈরি ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ এ্যাকাউন্টস’ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের স্বাস্থ্য খাতে যে অর্থ ব্যয় হয়, তার মাত্র ২৩ ভাগ বহন করে সরকার আর ৬৭ ভাগ ব্যয় করে ব্যক্তি নিজে। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের মানুষ স্বাস্থ্যের জন্য নিজের পকেট থেকে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করে। ২০১২ সালে স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৬৩ শতাংশ বহন করত ব্যক্তি নিজের পকেট থেকে। আর এখন তা বেড়ে ৬৭ শতাংশ হয়েছে। আর এনজিও ও দাতা সংস্থাগুলো বহন করছে ১০ শতাংশ। স্বাস্থ্য ব্যয় বাড়লেও সরকারী অংশের খরচ কমেছে।

বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা খরচ:

বিভিন্ন বেসরকারি স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা গেছে, বেসরকারি হাসপাতালসমূহের চিকিৎসাসেবার খরচ অনেকটা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। প্রতিটি অপারেশনে ১০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা লাগে। প্রতিদিন সিসিইউ সেবা পেতে ৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা এবং আইসিইউ সেবা পেতে লাগে ২০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা। প্রতি সেশনে ডায়ালাইসিস করাতে খরচ হয় প্রায় ৫ হাজার টাকা। এভাবে করোনারি এনজিওগ্রামে ১৫ হাজার টাকা, সিটি স্ক্যানে ৪ থেকে ৬ হাজার টাকা, এমআরআই ৬ থেকে ১০ হাজার টাকা, ইসিজি ৩০০ টাকা, ইকোকার্ডিওগ্রাম ১ হাজার থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা, এক্সরে ৫০০ টাকা, আল্ট্রাসনোগ্রাম ১ থেকে ৩ হাজার টাকা, কার্ডিয়াক ক্যাথ ১৫ হাজার টাকা, ইউরিন ২০০ টাকা এবং রক্তের হিমোগ্লোবিন, টোটাল কাউন্ট করাতে লাগে মাত্র ৪৫০ টাকা।

সরকারি  হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যয়:

স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, নামমাত্র খরচে চিকিৎসাসেবা পাওয়া যায় সরকারি হাসপাতালে। অপারেশন, সিসিইউ, আইসিসিইউ ও ডায়ালাইসিস সেবার ক্ষেত্রে কোনও টাকা নেয়া যাবে না। তবে বেশ কিছু পরীক্ষা করাতে স্বল্প ফি নেয়া হয়। এ ক্ষেত্রেও সরকারী ফি বেসরকারী হাসপাতালের ফির তুলনায় অনেক গুণ কম। সরকারী হাসপাতালে করোনারি এনজিওগ্রামে ২ হাজার টাকা, সিটি স্ক্যানে ২ হাজার টাকা, এমআরআই ৩ হাজার টাকা, ইসিজি ৮০ টাকা, ইকোকার্ডিওগ্রাম ২০০ টাকা, এক্সরে ২০০ টাকা, আল্ট্রাসনোগ্রাম ৩০০ টাকা, কার্ডিয়াক ক্যাথ ২ হাজার টাকা, ইউরিন ৩০ টাকা এবং রক্তের হিমোগ্লোবিন, টোটাল কাউন্ট করাতে লাগে মাত্র ১০০ টাকা। সকল হাসপাতালে ওষুধ ও অন্যান্য সামগ্রী বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়। এই মুহূর্তে কোনও ঘাটতি নেই।

স্বাস্থ্য বীমার কার্যক্রম কম

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রোগীর সুরক্ষায় স্বাস্থ্য বীমা চালু থাকলেও বাংলাদেশে এখনও এ সেবা সফলভাবে চালু করা সম্ভব হয়নি। স্বাস্থ্য বীমা শুরু হলেও তা দেশের মাত্র একটি জেলার তিনটি থানায় পাইলট প্রকল্প হিসেবে চালু রয়েছে। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা কার্যক্রম সম্প্রসারণে দেশের মানুষকে স্বাস্থ্য বীমায় আগ্রহী করতে নানা উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। জানা যায়, দেশে প্রচলিত প্রাইভেট ইনস্যুরেন্স কোম্পানিগুলোর ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য বীমা খুব গ্রহণযোগ্য না হলেও গ্রুপ স্বাস্থ্য বীমা জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। তবে বহু প্রতিষ্ঠান এই গ্রুপ স্বাস্থ্য বীমা করছে। এর বাইরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, গ্রামীণ ব্যাংকসহ বেশকিছু প্রতিষ্ঠান নিজস্ব আঙ্গিকে স্বাস্থ্য বীমা চালু করেছে।

অন্যদিকে কমিউনিটি পর্যায়ে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রসহ আরও কয়েকটি সংস্থা কাজ করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেবাপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা থাকার পরও দেশের অধিকাংশ মানুষই স্বাস্থ্যসেবা পেতে বীমা করতে আগ্রহী নয়। তাছাড়া আগে টাকা দিয়ে পরে সেবা গ্রহণের মনোভাব না থাকা এবং একজনের টাকায় অন্যজনের চিকিৎসা এ বিষয়েও অনীহা রয়েছে। তাই স্বাস্থ্য বীমা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। পৃথিবীর উন্নত দেশ এবং কল্যাণ রাষ্ট্রগুলোয় মানুষের স্বাস্থ্য সেবা অনেকাংশে বীমার ওপর নির্ভরশীল। ফলে স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় মেটাতে সেসব দেশের জনগণকে আর্থিক সমস্যায় পড়তে হয় না। কিন্তু স্বাস্থ্যসেবা পেতে বাংলাদেশের মানুষকে মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৬৭ ভাগ পকেট থেকে করতে হয়। স্বাস্থ্যসেবা পেতে বীমাতে অনাগ্রহের কারণে অধিক সংখ্যক মানুষকে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার (ইউএইচসি) আওতায় আনা যাচ্ছে না। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) ১৭ উদ্দেশ্যের মধ্যে অন্যতম সবার জন্য সুস্বাস্থ্য। কারণ দেশের সব ধরনের উন্নয়নের স্থায়িত্বের জন্য সবার আগে প্রয়োজন জনগণের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা। এজন্য সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচীর এবং স্বাস্থ্য বীমার বিকল্প নেই। কিন্তু দেশের অধিকাংশ মানুষ স্বাস্থ্য বীমার প্রতি অনাগ্রহী। এই প্রেক্ষিতে দেশে স্বাস্থ্য বীমা নিশ্চিত করা সহজ নয়। এর জন্য সমন্বিত (সরকারি-বেসরকারি) উদ্যোগ প্রয়োজন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা (ইউনিভার্সেল হেলথ কভারেজ) সিদ্ধান্তের আলোকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সকলের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার উদ্যোগের অংশ হিসেবে ২০১৬ সালে স্বাস্থ্যবীমা (হেলথকার্ড) প্রকল্পের কার্যক্রম চালু করে সরকার। টাঙ্গাইলের তিন উপজেলা মধুপুর, কালিহাতি ও ঘাটাইলে এই প্রকল্পের উদ্বোধন করা হয়। গত ৫ বছর ধরে স্বাস্ত্যবীমা প্রকল্পটি ‘পাইলট‘ হিসেবেই রয়ে গেছে।

সকলের আন্তরিক অংশগ্রহণ দরকার : বিশেষজ্ঞগণ

স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের সাবেক মহাপরিচালক আসাদুল ইসলাম বলেন, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার (ইউএইচসি) ধারণা আমাদের জন্য নতুন নয়। সংবিধানে সবার জন্য স্বাস্থ্যর বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। ২০০০ সালের আলমা আতা ঘোষণায়ও ‘সকলের জন্য স্বাস্থ্য’-এ কথা বলা হয়েছিল। তাতে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার ওপর জোর দেয়া হয়েছিল। তবে ইউএইচসিতে যে বিষয়টি নতুন তা হলো মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। এবং তা আমরা কীভাবে নিশ্চিত করব সেই বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ ধূমকেতু ডটকমকে বলেন, ‘বিভিন্ন জরিপে দেখা যায়, বস্তি, ভাসমান, চর ও হাওড়াঞ্চলের মানুষ এখনও স্বাস্থ্য সেবা পাচ্ছে না। দেশের ৫৫ শতাংশ মানুষ এখনও মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার ধারণায় ২০৩০ সালের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় সহনীয় পর্যায়ে ও সাধ্যের মধ্যে নিয়ে আসার কথা বলা হয়েছে। অথচ আমাদের দেশে চিকিৎসা পেতে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয় এর ৬৭ শতাংশই রোগীকে বহন করতে হচ্ছে। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনের জন্য মানসম্পন্ন ও দক্ষ জনবলও দরকার। দেশে পর্যাপ্তসংখ্যক চিকিৎসক থাকলেও নার্স ও টেকনিশিয়ানের ঘাটতি আছে। সুতরাং সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আমরা অনেকটা দূরেই আছি।

ডক্টরস ফর হেলথ এন্ড এনভায়রনমেন্টের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রশিদী-ই মাহবুব ধূমকেতু ডটকমকে জানান, জলবায়ু পরিবর্তনে স্বাস্থ্য ঝুঁকি মোকাবেলায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেই বাংলাদেশের। বিদ্যমান জনস্বাস্থ্যসেবা ও জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্টি স্বাস্থ্য ঝুঁকির বিষয়টির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনে নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দেবে। আর প্রতিটি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বাড়বে স্বাস্থ্য ঝুঁকির মাত্রা। নতুন নতুন রোগে আক্রান্ত হবে মানুষ। চলমান জনস্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামো দিয়ে তা মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। ওই অবস্থার জন্য থাকতে হবে বাড়তি প্রস্তুতি। কিন্তু ওই ধরনের প্রস্তুতি নেই বাংলাদেশের। বর্তমান জনস্বাস্থ্যসেবার অবস্থা উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী এখনও ন্যূনতম স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত। যেখানে বিদ্যমান স্বাভাবিক স্বাস্থ্যসেবা দিতে হিমশিম খেতে হয়, সেখানে জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট স্বাস্থ্য ঝুঁকি মোকাবেলায় সরকারের প্রস্তুতি প্রশ্ন থাকাটাই স্বাভাবিক বলে মনে করেন রশিদী-ই মাহবুব।

ইউএইচসি সূচকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান:

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের তথ্য প্রতিবেদন তুলে ধরে ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) স্বাস্থ্য বিষয়ক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডাঃ মোঃ হাবিবে মিল্লাত, এমপি  ধূমকেতু ডটকমকে জানান, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা সূচকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ১০টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ।  যেসব কার্যক্রম চলছে তা মিলিয়েও তুলনামূলক চিত্রে অবস্থান ৫০ শতাংশের ওপরে উঠতে পারেনি। অন্যদিকে মানুষের চিকিৎসার জন্য নিজের পকেট থেকে সবচেয়ে বেশি যায় বাংলাদেশে, যা দেশের স্বাস্থ্য খাতের জন্য অশনিসংকেত। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি ৫০ শতাংশ। অথচ এই সূচকে ভুটান ৭২, নেপাল ৬২, শ্রীলঙ্কা ৬৮, ইন্দোনেশিয়া ৬১, মালদ্বীপ ৭২, দক্ষিণ কোরিয়া ৭৮ ও থাইল্যান্ড সর্বোচ্চ ৮৮ শতাংশ অবস্থানে রয়েছে। এ ক্ষেত্রে কেবল বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে আছে তিমুর। যদিও ওই তিমুর আবার সবার চেয়ে এগিয়ে আছে চিকিৎসায় রাষ্ট্রের ব্যয়ের দিক থেকে। অর্থাৎ তিমুরে চিকিৎসার পেছনে ব্যক্তির পকেট থেকে ব্যয় হয় মাত্র ১০ শতাংশ। আর এ ক্ষেত্রে এই ১০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশে ব্যক্তির পকেট থেকে খরচ হয় সর্বোচ্চ ৬৭ শতাংশ। এ ছাড়া থাইল্যান্ডে ১২, মালদ্বীপে ১৬, ভুটানে ২০, নেপালে ৬০, ভারতে ৬৫, ইন্দোনেশিয়ায় ৪৮ ও শ্রীলঙ্কায় ৩৮ শতাংশ ব্যয় হয় ব্যক্তির পকেট থেকে।

আন্তর্জাতিক মূল্যায়ন:

আন্তর্জাতিক মেডিক্যাল জার্নাল ‘ল্যানসেট’ এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচীর  উদ্যোগ প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। এ জন্য নির্দিষ্ট কোনও বাজেট বরাদ্দ নেই। এ উদ্যোগে বড় বাধা স্বাস্থ্য খাতের অদক্ষ স্বাস্থ্যকর্মী। স্বাস্থ্য জনবলের (চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ান) ৯৪ শতাংশই অদক্ষ। স্বাস্থ্যকর্মীদের গ্রামাঞ্চলে কর্মক্ষেত্রে ধরে রাখা কঠিন। 

অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের ‘দ্য পাথ টু ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচী  অর্জন করতে হলে বাংলাদেশ সরকারকে স্বাস্থ্য খাতের জন্য বাড়তি অর্থায়নের ব্যবস্থা করতে হবে। দক্ষ জনবলের জন্য প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট গড়ে তোলার পাশাপাশি গ্রাম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বাস্থ্যকর্মী ধরে রাখার জন্য বাস্তবসম্মত উদ্যোগ নিতে হবে। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *