আন্তর্জাতিকজাতীয়সর্বশেষ

শ্রীলঙ্কার মতো ঝুঁকির পথে নেই বাংলাদেশ

শ্রীলঙ্কার মতো ঝুঁকির পথে নেই বাংলাদেশ

ঋণ নিয়ে বড় বড় প্রকল্প করায় বাংলাদেশও ঝুঁকিতে আছে আর অর্থনীতিবিদরা এই তুলনাকে অতিসরলীকরণ বলে জানিয়েছেন, শ্রীলঙ্কার মতো ঝুঁকির পথে নেই বাংলাদেশ। এশিয়ার শতভাগ শিক্ষিতের দেশ শ্রীলঙ্কার ‘অর্থনৈতিক শ্রী’ এখন বৈশ্বিক আলোচনার বিষয়। বৈদেশিক ঋণজাল ও মূল্যস্ফীতিতে কাবু হয়ে আছে শ্রীলঙ্কা।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তথ্য বলছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির চেয়ে বড় এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ। অর্থনীতির সূচকগুলোতে ভালো অবস্থানে আছে বাংলাদেশ।

আইএমএফ ও ইআরডির তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি ৪১৬ বিলিয়ন ডলার। আর শ্রীলঙ্কার জিডিপি মাত্র ৮২ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৪ বিলিয়ন ডলার। শ্রীলঙ্কার রিজার্ভ ১.৫ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশকে প্রতিবছর বিদেশি ঋণ বাবদ পরিশোধ করতে হয় দুই বিলিয়ন ডলার। শ্রীলঙ্কাকে করতে হয় সাত থেকে আট বিলিয়ন ডলার।

আইএমএফের তথ্য মতে, শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক ঋণ তার জিডিপির ৬১ শতাংশের বেশি। বাংলাদেশের তা ১৭ শতাংশের মতো। কোনো দেশের জন্য বৈদেশিক ঋণ জিডিপির ২০ শতাংশ হলে তাকে আদর্শ বলে মনে করা হয়। শ্রীলঙ্কার বিদেশি ঋণের বেশির ভাগ কঠিন শর্তে নেওয়া। বাংলাদেশের বেশির ভাগ বিদেশি ঋণ সহজ শর্তে নেওয়া।

এসব নানা সূচক ধরে অর্থনীতিবিদরা বাংলাদেশকে নিয়ে ইতিবাচক মন্তব্য করলেও শ্রীলঙ্কার বর্তমান অবস্থা থেকে শিক্ষা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে তুলনা করার মতো পরিস্থিতি এখন সৃষ্টি হয়নি। তবে বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। শ্রীলঙ্কা শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বের কাছে একটি শিক্ষণীয় দেশে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘অদূর ভবিষ্যতে আমরা যাতে এ রকম কোনো সমস্যায় না পড়ি সে জন্য এখন থেকে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। বিশেষ করে অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণের জন্য হলেও শ্রীলঙ্কা নিয়ে আমাদের পড়াশোনা করা উচিত। ’

ইআরডির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত সাত বছরে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে ২০১৪-১৫ অর্থবছর দেশের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল ২৬.৫৭ বিলিয়ন ডলার। পরের অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁডায় ২৯.১৯ বিলিয়ন ডলার। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ৩২.০৭ বিলিয়ন এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছর ৩৮.২৪ বিলিয়ন ডলার।

পরের তিন অর্থবছরে তা আরো দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এর পরিমাণ দাঁডায় ৪৪.৪৮ বিলিয়ন ডলার, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫১.১৩ বিলিয়ন ডলার এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬০.১৫ বিলিয়ন ডলার।

বৈদেশিক ঋণের এ দ্রুত বৃদ্ধি বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কার পথে নিয়ে যাচ্ছে কি না—জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মূলত বাজেটীয় অব্যবস্থাপনার কারণে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে এমন বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। এই অব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও নানা মাত্রা আছে। প্রথমত, শ্রীলঙ্কা সরকার অধিক জনপ্রিয়তা পাওয়ার লক্ষ্যে ব্যাপক হারে কর হ্রাস করেছে। কিন্তু সরকারি ব্যয় নির্বাহের জন্য বিকল্প অর্থ সংস্থানের ব্যবস্থা করেনি। এ ক্ষেত্রে অর্থের প্রয়োজন মেটাতে নতুন করে ব্যাপক হারে নোট ছাপানো হয়েছে। এতে করে মূল্যস্ফীতি অনেক বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ এমন কিছু করেনি। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বড় ঝুঁকির মধ্যে নেই। ’

বাংলাদেশে এখন অনেক বড় প্রকল্প চলছে। এসব প্রকল্প থেকে ঠিকমতো রিটার্ন না পেলে বাংলাদেশের অবস্থাও শ্রীলঙ্কার মতো হতে পারে বলে মনে করেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। তিনি সম্প্রতি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সামনের দিনগুলোতে মেগা প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। ’

জানুয়ারি মাসের তথ্যে দেখা যায়, শ্রীলঙ্কার রেমিট্যান্স এসেছে মাত্র ২৭ কোটি ১০ লাখ ডলার। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের মার্চ মাসের তথ্যে দেখা যায়, এই মাসে ১৮৬ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। ২০২০-২১ অর্থবছরে করোনা মহামারির মধ্যেও ২৪.৭৮ বিলিয়ন ডলারের রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী সোয়া কোটি বাংলাদেশি। শ্রীলঙ্কা ক্যালেন্ডার বছরকে আর্থিক বছর ধরে। ২০২১ সালে দেশটিতে রেমিট্যান্স এসেছিল আট বিলিয়ন ডলারের মতো।

২০২০-২১ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৩৮.৭৫ বিলিয়ন ডলার আয় করে বাংলাদেশ। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে প্রায় সমপরিমাণ ৩৮.৬০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। ২০২১ সালে পণ্য রপ্তানি থেকে শ্রীলঙ্কা আয় করেছিল সাড়ে আট বিলিয়ন ডলার। করোনা শ্রীলঙ্কার রপ্তানি আয়ে ধস নামালেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ঘটেছে উল্টো। করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার পর এই আয় এখন আরো বাড়ছে।

২০১৯ সালে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ে রাজাপক্ষে দেশে অর্গানিক কৃষি উৎপাদনকে উৎসাহিত করেন। এর জন্য তিনি রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ব্যবহার নিষিদ্ধ করেন। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে দেশটির উৎপাদনে। চালের উৎপাদন কমে যায় ২০ শতাংশ পর্যন্ত। চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ শ্রীলঙ্কা তখন প্রায় অর্ধবিলিয়ন ডলারের চাল আমদানি করতে বাধ্য হয়। বেড়ে যায় চালের দাম। অর্গানিক কৃষির নেতিবাচক প্রভাব পড়ে দেশটির চা উৎপাদনেও। চা রপ্তানিতেও দেখা দিয়েছে নেতিবাচক প্রভাব।

এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, এই নীতির ফলে একদিকে দেশটিতে খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে খাদ্যে মূল্যস্ফীতিও বেড়েছে ব্যাপক হারে। এদিক থেকে বাংলাদেশ নিরাপদে আছে।

বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে তুলনা করা বা শ্রীলঙ্কার সহাবস্থানে বসানো ঠিক নয় বলে মত দিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। সব শেষ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির বৈঠকে (একনেক) তিনি বলেন, ‘আমরা কোনো অহেতুক প্রকল্প গ্রহণ করি না। আর আমাদের অর্থনৈতিক ভিত্তি অনেক মজবুত। আমরা যেসব প্রকল্প নিচ্ছি তা হিসাব করেই নিচ্ছি। আমাদের রপ্তানি আয় প্রতিনিয়ত বাড়ছে। রেমিট্যান্স (প্রবাস আয়) আসছে। যাঁরা শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশকে মেলানোর চেষ্টা করছেন তাঁদের ধারণা ভুল। ’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *