অভিমত

শোকাবহ ২১ আগস্ট ঘাতকদের বিচারিক প্রক্রিয়ার দ্রুত বাস্তবায়ন চাই

তাপস হালদার:
২১ আগস্ট ২০০৪ সাল। বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম একটি কলঙ্কজনক দিন। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশে প্রকাশ্য দিবালোকে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় নিহত হন ২৪ জন এবং আহত হন পাঁচ শতাধিক। হালমার মূল টার্গেট ছিলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। একই মঞ্চে ছিলেন আওয়ামী লীগের সকল সিনিয়র নেতারা। হামলাকারীদের মিশন পুরোপুরিভাবে সফল হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পুরো আওয়ামী লীগই ধ্বংস হয়ে যেত।

১৯৭৫ সালে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর প্রতিক্রিয়াশীল চক্র ভেবেছিল আর কোনো দিন আওয়ামী লীগ ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পতাকা আর কেউ তুলে ধরতে পারবে না। জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে যখন আওয়ামী লীগের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন তখন থেকেই খুনী চক্র বঙ্গকন্যাকে টার্গেট করে। ১৯ বার হত্যা চেষ্টা চালানো হয়। ২০০০ সাল থেকে ৪ বার হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। কোটালীপাড়ায় ৭৬ কেজি বোমা পুঁতে রাখা, খুলনা, সিলেটের পর সর্বশেষ ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা। অন্য হামলাগুলো থেকে এ হামলাটি সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের ছিল। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশ্য দিবালোকে হাজার হাজার নেতাকর্মীর উপস্থিতিতে সন্ত্রাসী হামলা করা হয়। আজ বিচারের মাধ্যমেও প্রমাণিত হয়েছে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে কিভাবে সেদিন হামলা করা হয়েছিল।

সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বোমা হামলা, গোপালগঞ্জের ছাত্রলীগ নেতা তুষার হত্যা এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে নেতাকর্মী হত্যা ও গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ ও মিছিলের আয়োজন করেছিল। সভাটি শুরু হয় বিকেল ৩টায়, দলীয় সভানেত্রী ও সে সময়ের বিরোধী দলীয় নেত্রী মঞ্চে এসে পৌঁছান ৫টার দিকে। তিনি যখন বক্তব্য শেষ করছেন তখন ঘড়ির কাঁটায় সময় ৫টা ২২ মিনিট। সেই মুহূর্তেই দক্ষিণ দিকের রমনা ভবন থেকে একটি গ্রেনেড মঞ্চকে লক্ষ্য করা ছোঁড়া হলেও সেটি বাঁ পাশে পড়ে বিকট শব্দে বিষ্ফোরিত হয়। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা মানববর্ম তৈরি করে নেত্রীকে ঘিরে রাখেন। নেত্রীর নিরাপত্তাকর্মীরা এক প্রকার জোর করে গাড়ীতে তুলে দেন। মাননীয় নেত্রীকে যখন গাড়ীতে তোলা হয় তখন গাড়ী লক্ষ্য করে অতর্কিত গুলি করা হয়। ঘটনাস্থলেই নিরাপত্তা কর্মী মাহবুব মারা যান। গ্রেনেড হামলা থেকে কোনোভাবে বেঁচে গেলেও যাতে কোনোভাবেই প্রাণে বাঁচতে না পারেন তার সকল প্রক্রিয়াই হামলাকারীরা নিয়েছিল। তিন স্তরের বুলেট নিরোধক ব্যবস্থাসম্পন্ন মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়িটিই সেদিন প্রিয় নেত্রীকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল। গ্রেনেড হামলা, বন্দুকধারীদের মুহুর্মুহু গুলিও যখন ব্যর্থ তখন গাড়িটিকে থামানোর চেষ্টা করা হয়। নেত্রীকে বহনকারী মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়িটিকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি করা হয়, যার ফলে গাড়িটিতে ৭টি ছিদ্র হয় এবং বাঁ পাশের দুটো চাকাই পাংচার করা হয়। এত প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও গাড়ির ড্রাইভার অসীম সাহস ও বিচক্ষণ বুদ্ধিমত্তায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউর মৃত্যুপুরী থেকে নেত্রীকে সুধাসদনে নিয়ে আসেন।

এক থেকে দেড় মিনিটের ব্যবধানে তেরটি গ্রেনেডের বিস্ফোরণে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় বঙ্গবন্ধু এভিনিউ। যুদ্ধের ময়দান থেকেও ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বিস্ফোরণের পর কালো ধোঁয়া আর আগুনের ফুল্কি, হাজার হাজার মানুষের গগণবিদারী চিৎকার, ছোটাছুটিতে সমগ্র এলাকাটি প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে রক্তস্রোত বয়ে যায়। ছেঁড়া স্যান্ডেল, ব্যানার, ফেস্টুন আর পতাকার মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল নারী-পুরুষের নিথর দেহ, মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল হাজার হাজার মানুষ।

ঘটনাস্থলের পাশে শুধু নেত্রীর প্রটোকলের পুলিশ ছাড়া কোনো পুলিশ ছিল না। যখন দলীয় নেতাকর্মীরা আহত নেতাকর্মীদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিল তখনই পুলিশ গোলাপ শাহ মাজার ও স্টেডিয়ামের দিক থেকে কাঁদানে গ্যাস, রাবার বুলেট ছুড়ে উদ্ধার তৎপরতাকে বাধাগ্রস্থ করে। সকল বাধা অতিক্রম করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আহত প্রতিটি মানুষকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছিল। আর্তচিৎকারে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ভারী হয়ে যায়। বঙ্গকন্যা প্রায়ই বলে থাকেন, কর্মীরাই আমার প্রাণ, আওয়ামী লীগের প্রাণ। কর্মীরাও যে নেত্রীকে কতটা ভালবাসে, খুব কাছে থেকে সেদিন দেখেছি।

হাসপাতালের মেঝেতে পড়ে রয়েছে, কারো হাত নেই, পা নেই, সারা শরীর রক্তাক্ত। তখনও কিন্তু কেউ নিজে বাঁচার আকুতি করেনি। সবাই-ই বলেছে আপার খবর কী? আপাকে বাঁচান। তখনও কেউ নিশ্চিত করে জানে না নেত্রীর কী হয়েছে, কোথায় আছেন। যখন সাড়ে সাতটার বিবিসি সংবাদে নেত্রী কথা বললেন, তখন পুরো হাসপাতাল জুড়ে সে কী আনন্দ, একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কান্না। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় নেত্রী বিবিসিকে বলেছিলেন, ‘আমার কর্মীরা জীবন দিয়ে আমাকে বাঁচিয়েছে। গ্রেনেড যখন বিষ্ফোরিত হচ্ছিল তখন নেতাকর্মীরা আমাকে ঘিরে রেখেছিল। তাদের অনেকেই আহত হয়েছেন। এখনো আমার কাপড়ে দাগ লেগে আছে। সরকারের মদদে সারা দেশেই তো বোমা হামলা ঘটছে। আমাদের এই মিছিলটাই ছিল বোমা হামলা ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে। এজন্য তারা জবাব দিল বোমা ও গ্রেনেড মেরে। পুলিশ আহতদের সাহায্য করতে না এসে যেভাবে আমাদের লাঠি চার্জ করল ও কাঁদানে গ্যাস ছুড়ল তাতেই বোঝা যায় এটা সরকারের মদদে হয়েছে’।

আস্তে আস্তে তৎকালীন সরকারের মুখোশ উন্মোচন হতে লাগল। সংসদে রক্তমাখা পাঞ্জাবি পরে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত শোক ও নিন্দা প্রস্তাব উত্থাপন করতে চাইলেও সে সুযোগ সেদিন বিএনপি সরকার দেয়নি। উল্টো খালেদা জিয়া সংসদে বলেছিলেন, বিরোধী দলীয় নেত্রী সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য ভ্যানিটি ব্যাগে বোমা নিয়ে গিয়েছিল। এমন একটি ঘটনা নিয়ে একজন প্রধানমন্ত্রীর কী ধরনের মশকরা? সকল আলামত পুলিশ দিয়ে সন্ধ্যার মধ্যেই নষ্ট করে দেয়া হয়। বিচারপতি জয়নাল আবেদীনকে দিয়ে একটি কমিশন গঠন করে সময়ক্ষেপণের নামে ঘটনাকে ভিন্ন দিকে নেয়ার চেষ্টা করা হয়। কোনো কিছুই যখন হালে পানি পাচ্ছিল না তখন একটি নিরপরাধ সিএনজি চালক জজ মিয়াকে আটক করে মিথ্যা আষাঢ়ে গল্প তৈরি করে। প্রকৃত অপরাধীদের বিচারের নামে করে প্রহসন।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বিচার কার্য শেষ হয়। ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর রায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড, খালেদা জিয়ার ছেলে তৎকালীন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব তারেক রহমানসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও আরো ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়।

আদালতে রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন বলেন,‘রাজনীতিতে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের মধ্যে শত বিরোধ থাকবে। তাই বলে কি বিরোধীদলকে নেতৃত্বশূন্য করার প্রয়াস চালানো হবে? গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ক্ষমতায় যে দল থাকবে, বিরোধী দলের প্রতি তাদের উদার নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা থাকতে হবে। বিরোধী দলের নেতাদের হত্যা করে ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক ফায়দা লোটা মোটেও গণতান্ত্রিক চিন্তার বহিঃপ্রকাশ নয়। রাজনৈতিক জনসমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে রাজনৈতিক নেতা ও সাধারণ জনগণকে হত্যার এ ধারা অব্যাহত থাকলে সাধারণ মানুষ রাজনীতি বিমুখ হয়ে পড়বে। আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে নৃশংস হামলার পুনরাবৃত্তি ঠেকানো সম্ভব’।

ঘাতকরা শুধু প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকেই নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিল তা নয়, তারা একটি আদর্শ, একটি চেতনাকেই ধ্বংস করতে চেয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে একই চেষ্টাই করেছিল। বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা চিরতরে ধ্বংস করে পাকিস্তানী ধ্যান ধারণায় বাংলাদেশকে একটি ধর্মভিক্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করাই তাদের লক্ষ্য।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের মূর্তপ্রতীক হলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা। সে জন্যই তিনি বারবার খুনীদের টার্গেটে পরিণত হন।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যাকাণ্ডে সরাসরি মদদ দিয়েছিলেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান। আর ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট নারকীয় হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করেছিল তারই পুত্র তারেক রহমান। তার সাথে পরিকল্পনায় মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত পাকিস্তান, একাত্তরের ঘাতক মুজাহিদ, বাবর, পিন্টুরা মিলে দায়িত্ব তুলে দেয় ইসলামী জঙ্গি সংগঠনের খুনীদের হাতে। ৭৫ সালের আর ২০০৪ সালের ঘাতকতের উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার পেয়েছি ২৪ বছর পর আর বাস্তবায়ন হতে লেগেছে আরও ১২ বছর। ২০০৪ সালের হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছে ১৪ বছর পরে, বাস্তবায়নে কত সময় লাগবে সেটা কেউ এখনও জানি না।

বঙ্গবন্ধু পরিবারের বিচারের ক্ষেত্রে শুধু এত বিলম্ব কেন? আওয়ামী লীগই তো ১১ বছর ধরে ক্ষমতায় তারপরও এত দেরি কেন? আমরা সাধারণ জনগণ দ্রুত বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ করে ঘাতকদের রায় বাস্তবায়ন চাই। ২১ আগস্টের সকল শহীদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক: সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা।

ইমেইল: haldertapas80@gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *