অভিমত

শোকাবহ ১৫ই আগস্ট : নেপথ্যের খলনায়কদের মুখোশ উন্মোচনে তদন্ত কমিশন চাই

তাপস হালদার:
শোকাবহ ১৫ই আগস্ট। ১৯৭৫ সালের এই দিনে রাজনীতির তীর্থস্থান ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বাঙালি জাতির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। একাত্তরের পরাজিত শক্তিরা তাদের পরাজয় মানতে না পেরে বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছিল। মহাত্মা গান্ধী, মাও সেতুং, নেলসন ম্যান্ডেলা, কামাল আতাতুর্ক, জর্জ ওয়াশিংটনকে বাদ দিয়ে যেমন তাদের দেশের ইতিহাস লেখা যায় না, তেমনি বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসও অসম্ভব। তিনি বাঙালি জাতিকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র উপহার দিয়েছেন। বাঙালি জাতির স্বপ্ন সাধক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি জাতিকে নিয়ে শুধু স্বপ্নই দেখতেন না, জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে দেখাতেন। বহুবার চেষ্টা করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলবার, আবার কখনো বিকৃত করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু তথা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস। কিন্তু ইতিহাসকে কখনো মুছে ফেলা যায় না। বঙ্গবন্ধুকে যতবার ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে ততবারই তিনি প্রবলভাবে স্বমহিমায় বাঙালির হৃদয়ে আরো শক্ত করে স্থান করে নিয়েছেন।

আরও পড়ুন: কিংবদন্তী তারুণ্যের প্রতীক শহীদ শেখ কামাল

বঙ্গবন্ধুর জীবন দর্শনের পরিব্যাপ্তি ছিল বাঙালি জাতিসত্তায়। বঙ্গবন্ধু এদেশের মানুষকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন। একজন বিদেশী সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলেন আপনার বড় শক্তি কি? উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমার সবচেয়ে বড় শক্তি আমি আমার দেশের মানুষকে ভালবাসি। সাংবাদিক আবারো প্রশ্ন করলেন তাহলে বড় দুর্বলতা কি? জবাবে বঙ্গবন্ধু এবার বললেন, তাদেরকে আরো বেশি ভালবাসি।

হাজার বছরের পরাধীন জাতিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এনে দিয়েছিলেন স্বাধীনতা। তিনি এদেশের মানুষের জন্য যৌবনের ১৪টা বছর জেলে কাটিয়েছেন। সেই স্বাধীন দেশে কেউ তাঁকে হত্যা করতে পারে, এটা ছিল সম্পূর্ণ কল্পনার বাইরে। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা বার বার সতর্ক করেছিল। তিনি বিষয়টি গুরুত্ব দিতে চাননি, বলেছিলেন ওরা আমার সন্তানের মতোই। এ ধরনের কাজ করবে না। কবি গুরু বলেছিলেন ‘মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ’। কবি গুরুর ভক্ত বঙ্গবন্ধুও হয়তো সেটাই ভেবেছিলেন। কিন্তু ওরা তো ছিল মানুষরূপী পশু। পাকিস্তানীদের জারজ সন্তান। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর এদেশের মানুষের প্রতি এতটা বিশ্বাস ছিল যে, তিনি রাষ্ট্রপতি হয়েও সাধারণ মানুষের সাথে সবসময় মিশতেন। তাঁর পরিবার-পরিজনেরাও কোনো ধরনের সরকারি প্রটোকল নিতেন না। রাষ্ট্রপতি হয়েও তিনি কখনো গণভবনে থাকেননি। নিরাপত্তার কথা বলা হলে, তিনি বলতেন গণভবনে থাকলে নিরাপত্তার বেড়াজালে জনগণের সাথে দূরত্ব বাড়বে।

মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তিরা কখনই তাদের পরাজয় স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেনি। পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর কিছু চাকুরিচ্যুত সদস্যকে ষড়যন্ত্রকারীরা ব্যবহার করেছিল। স্বাধীনতার সূতিকাগার বলে পরিচিত ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে হামলা চালিয়ে হত্যা করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু, বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ নাসের, শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশুপুত্র শেখ রাসেল, সুলতানা কামাল, রোজী জামালসহ পুরো পরিবারকে। বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা আজকের সমৃদ্ধ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা দেশের বাইরে অবস্থান করায় তাঁরা সেদিন প্রাণে বেঁচে যান।

১৯৭১ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনীর স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের অধিনায়ক মেজর জেনারেল সুজন সিং উবান তাঁর লেখা ফ্যান্টম্স অব চিটাগং গ্রন্থে লিখেছেন, ‘এবারও আমি লক্ষ করলাম, তাঁর (বঙ্গবন্ধু) বাসায় কোন নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। সব রকমের মানুষ সময় অসময়ে যখন তখন এসে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ চাইতো। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসা লোকদের কোন বাছ-বিচার নেই। এ কথা তুলতেই তিনি বললেন, আমি জাতির জনক। আমি দিন বা রাতে কোনো সময়ই আমি আমার দরজা বন্ধ রাখতে পারিনা’। বঙ্গবন্ধুর এমন সরল বিশ্বাসকেই ঘাতকরা পুঁজি করেছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যায় যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশ নিয়েছিল তারা সবাই ছিল বঙ্গবন্ধুর আস্থাভাজন। জিয়াউর রহমানকেও বঙ্গবন্ধু খুব স্নেহ করতেন। তার জন্যই শুধু উপ-সেনাপ্রধান পদ তৈরি করেছিলেন।

১৫ আগস্টের অন্যতম ঘাতক ফারুক রহমান সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাসকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “জিয়াউর রহমানের সাথে সবসময় আমাদের যোগাযোগ ছিল। ১৯৭৫ সালের ২০ মার্চ জিয়াউর রহমানকে হত্যার ষড়যন্ত্রের কথা জানালে তিনি বলেছিলেন, তোমরা করতে চাইলে করতে পারো, আমি সিনিয়র অফিসার হিসেবে যোগদান করতে পারি না।” দেশের প্রেসিডেন্টকে হত্যার ষড়যন্ত্র ৫ মাস আগে জেনেও, তিনি রাষ্ট্রপতি বা সেনাপ্রধানকে অবগত করেননি। এটা তার দায়িত্ব পালনের ব্যর্থতা। সেদিক দিয়ে বিচার করলেও তিনি দায় এড়াতে পারেন না। কিছু দিন পরই মুখোশ উন্মোচিত হয়ে যায়। জেনারেল জিয়া ক্ষমতা দখল করে জয় বাংলার পরিবর্তে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ প্রবর্তন করেন। রাষ্ট্রপতির নির্বাহী আদেশে ১১ হাজার রাজাকার আলবদরকে জেল থেকে মুক্ত করে দেন। যুদ্ধাপরাধী রাজাকারদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা তুলে দেন। সংবিধান পরিবর্তন করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করার সুযোগ দিয়ে জামায়াতে ইসলামীকে পুনর্বাসন করেন। জামায়াতের রাজনীতি করার সুযোগে দেশে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটে।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের ১২ ঘাতকের বিচার হয়েছে। এত বড় ঘটনা কি শুধুমাত্র ১২ জনের পক্ষেই সম্ভব ছিল? সেদিন কেন সব কয়টি বাহিনী প্রধানরা মাত্র দুঘণ্টার মধ্যে খুনী সরকারকে আনুগত্য জানালো। কেন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে পারলো না। কেন মন্ত্রীরা দলে দলে গিয়ে খন্দকার মোস্তাক গংদের মন্ত্রিসভায় যোগ দিল? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা খুবই প্রয়োজন। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে নেপথ্যের খলনায়কদের মুখোশ উন্মোচনে তদন্ত কমিশন গঠন করে তাদের বিচার করা এখন সময়ের দাবি।

গত বছর সম্প্রীতি বাংলাদেশ’র শোক দিবসের আলোচনা সভায় মাননীয় আইনমন্ত্রী দ্রুত কমিশন গঠনের কথা বলেছিলেন, কিন্তু এক বছরে কোনো অগ্রগতি দেখতে পাচ্ছি না। দ্রুত কমিশন গঠনের জোর দাবি করছি।

বিশ্ব মানব সভ্যতার ইতিহাসে ঘৃণ্য ও ন্যাক্কারজনক হত্যাকাণ্ডে তারা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই নয়, বাঙালির স্বাধীনতার আদর্শকেও হত্যা করতে চেয়েছিল। মুছে ফেলতে চেয়েছিল বাঙালির বীরত্বগাঁথা ইতিহাসও। বঙ্গবন্ধু আজ প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছেন। দেশ-জাতি যখন সংকটে পড়ে তখনই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ আমাদের অনুপ্রেরণা জোগায়, সঠিক পথ খুঁজে দেয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পথিকৃৎ এবং বাঙালি জাতির একমাত্র নেতা।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্টের বিজয়, আটান্নর সামরিক শাসন-বিরোধী আন্দোলন, ছেষট্টির ৬ দফা, ঊনসত্তরের গণঅদ্ভু্ত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের সুমহান মুক্তিযুদ্ধসহ বাঙালির প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর অমর শ্রেষ্ঠ কীর্তি।

স্বাধীনতার পাঁচ দশকে মাঝে মাঝে দেশে ছন্দপতন ঘটলেও এখন দেশ বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পথেই চলছে। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা আজ তাঁরই সুযোগ্য কন্যা মানবতার মাতা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্বপ্নপূরণের পথে এগিয়ে চলছে।

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ এক ও অবিচ্ছেদ্য। বলা যেতে পারে, একটি মুদ্রার দুটি ভিন্ন পিঠ। তিনি বাঙালি জাতির জনক এবং সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। তিনি এই স্বাধীন ভূখণ্ডের স্রষ্টা, তিনিই জাতির পথপ্রদর্শক, বাংলাদেশের পরিপূরক। আজ বঙ্গবন্ধু সশরীরে আমাদের মাঝে নেই কিন্তু তিনি সব সময় প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে জাগ্রত থাকবেন মহাকাব্যের মৃত্যুঞ্জয়ী মহানায়ক হিসেবে। উজ্জ্বল বাতিঘর হয়ে জাতিকে অনুপ্রেরণা দেবেন হাজার বছর ধরে। জাতীয় শোক দিবসে জাতির পিতার প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক: সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা।

ইমেইল: haldertapas80@gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *