দেবতনু মাজী :
পশ্চিমি দেশগুলোর মানুষের কাছে বাংলাদেশ মানেই ছিল একটা গরিব, অনুন্নত, মৌলবাদীদের দেশ। অনেকেই আবার বাংলাদেশে আসতে ভয় পেতেন এই ভেবে যে, যে কোনো সময় তারা সন্ত্রাসবাদের শিকার হতে পারেন। আবার অনেকের কাছেই বাংলাদেশ মানে ছিল সামরিক শাসন এবং গণতন্ত্রবিহীন একটা দেশ। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফিরলেও, সেভাবে গণতন্ত্রের স্বাদ বাংলাদেশের মানুষ কখনো পায়নি। বিএনপি সরকারের আমলে, বিশেষ করে ২০০১ থেকে ২০০৬ এর মধ্যে রাজনৈতিক সন্ত্রাস এবং প্রতিহিংসা বিপর্যস্ত করেছিল বাংলাদেশের মানব নিরাপত্তাকে। বিএনপির জোটসঙ্গী জামায়াত মৌলবাদীদের নানারকমভাবে সাহায্য করতো বাংলাদেশের মধ্যে একটা ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে রাখার জন্য।
২০০৬ সালে সাধারণ নির্বাচন হবার কথা থাকলেও সেই নির্বাচন হয় ২০০৮ সালে। সেইসময় বাংলাদেশের কেয়ারটেকার গভর্নমেন্ট অবৈধভাবে ক্ষমতায় প্রায় দুবছর থেকে যায়। সাধারণত কেয়ারটেকার গভর্নমেন্টের দায়িত্ব হলো, নির্বাচন যাতে সুষ্ঠুভাবে হয় সেটা নিশ্চিত করা এবং তারপর নতুন সরকার গঠন হয়ে গেলে তাদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়া। কিন্তু এক্ষেত্রে তা হয়নি। কেয়ারটেকার গভর্নমেন্টের শাসনকালে বাংলাদেশের মানুষ অর্থ ও খাদ্য সংকটের মুখে পড়েন। এমনকি সাইক্লোন সিডরের ফলে যে সমস্ত মানুষ আক্রান্ত হয়েছিলেন তারা ঠিক সময় ত্রাণ পাননি। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি, চাকরির অভাব এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ফলে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জীবনে নিরাপত্তার সংকট দেখা দেয়।
অনেক টালবাহানার পর ২০০৮-এর ডিসেম্বর মাসে আবারো সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসেন শেখ হাসিনা ওয়াজেদ ও তাঁর দল আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনা শুরু করেন স্বপ্ন দেখাতে এক নতুন বাংলাদেশের। ক্রমেই ভেঙেপড়া অর্থনৈতিক, খাদ্য ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তার উন্নতি ঘটে হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনকালে।
২০১০ সালে বাংলাদেশে প্রায় ৩১.৫% মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করছিলেন; ২০১৬ সালের মধ্যেই তা কমে দাঁড়ায় ২৪.৩%।
২০১৯ সালে বাংলাদেশের জিডিপি বৃদ্ধির হার দাঁড়ায় ৮.১৫%। করোনা ভাইরাসের ফলে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর জিডিপি বৃদ্ধির হার যখন নেতিবাচক তখন বাংলাদেশের জিডিপি বৃদ্ধির হার ২.৩৭%।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি এবং ফরেন রেমিট্যান্সের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অনস্বীকার্য। তবে বাংলাদেশ এখন ক্রমেই কাটিয়ে উঠছে গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রির ওপর নির্ভরশীলতা। বাংলাদেশ এখন ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবট তৈরিতে সক্ষম এবং ১২টি রোবট তারা ইতিমধ্যে কোরিয়াতে রপ্তানি করেছে।
এর পাশাপাশি বাংলাদেশে ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে আইটি ফ্রিলান্সারের সংখ্যা। বাংলাদেশে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে উদার বিনিয়োগ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশের মানুষের জীবন প্রত্যাশার হার এই মুহূর্তে ৭২.৬ বছর, এই ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ ভারত, পাকিস্তান, ভুটান, নেপাল এবং আফগানিস্তানের থেকে এগিয়ে।
উন্নতমানের স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদান করতে এখন সক্ষম বাংলাদেশ। এর ফলে উন্নতি হয়েছে স্বাস্থ্য নিরাপত্তার। এই করোনা মহামারীর সময় ভারতের মতো দেশকে বাংলাদেশ চিকিৎসার সরঞ্জাম এবং ওষুধ পাঠিয়ে সাহায্য করেছে। যা অবশ্যই প্রশংসনীয়।
বাংলাদেশে খাদ্য সংকটের সমস্যা সমাধান করতেও সক্ষম হয়েছে সরকার। এর পাশাপাশি নারী সুরক্ষা ও শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি বাংলাদেশের মানব নিরাপত্তাকে সুরক্ষিত করেছে। একসময় যে সন্ত্রাসবাদ বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল এবং অনেক মানুষের ভয়ের কারণ ছিল আজ সেই সন্ত্রাসবাদকেও প্রায় নিষ্ক্রিয় করতে সক্ষম শেখ হাসিনার সরকার। গ্লোবাল টেররিজম ইনডেক্সে বাংলাদেশের স্থান এখন ৩৩, যার ফলে এটা বলা যেতেই পারে যে সন্ত্রাসবাদের ঝুঁকির দিক থেকে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র (স্থান ২৯) এবং যুক্তরাজ্যের (স্থান ৩০) চেয়ে নিরাপদ।
এই প্রসঙ্গে অবশ্যই উল্লেখযোগ্য, বাংলাদেশ সরকারের সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি যা পরিষ্কার করে দিয়েছে জঙ্গি গোষ্ঠীদের কোনোভাবেই বরদাস্ত করা হবে না। শেখ হাসিনা যখন ক্ষমতায় আসেন বাংলাদেশের মানব উন্নয়নের তালিকায় স্থান ছিল ১৪০। সেখান থেকে আজ বাংলাদেশ ১৩৩তম স্থানে উঠে এসেছে। যদিও বাংলাদেশ মানব উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে, তবে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ক্রমেই মানব উন্নয়নের পথ মসৃণ করবে আগামী দিনে বলে আমি মনে করি।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, বিধান চন্দ্র কলেজ, রিষড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।