পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় :
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন প্রতিদিনই দেখেছি শেখ কামালকে। দেখেছি নয়, দেখা হয়েছে। কলাভবনের করিডরে, সোসিওলজি ডিপার্টমেন্টের জটলায়, মধুর ক্যান্টিনের চত্বরে, টিএসসি ক্যাফেটারিয়ায়, শরীফ মিয়ার চায়ের দোকানে, বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠে, টিএসসির দোতলায় নাটকের রিহার্সেলে। কোন না কোন জায়গায় দিনে এক বা একাধিকবার দেখা হতোই। সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মেতে থাকা অনবদ্য এক যুবক। সাদামাটা মধ্যবিত্ত চেহারা। অথচ কী প্রাণবন্ত! বিশেষণ বিহীন আকর্ষণীয় ঔজ্জ্বল্য-বসন ভূষণে, চাল-চলনে, আলাপ চারিতায়, তুমূল আড্ডায়। সতত সারল্যমাখা সহজিয়া চরিত্রের অমন মানুষ আমি অন্তত আমার জীবনে দেখি নাই।
‘ভালো মন্দ যাহাই আসুক সত্যরে লহ সহজে’- কবিগুরুর অমোঘ দর্শনের যথার্থ অনুসারী ছিলেন শেখ কামাল। জাতির পিতার পুত্র হওয়া সত্ত্বেও মিথ্যা অপবাদ শুনতে হয়েছে, শরীরে কাদা লাগানোর অপচেষ্টাও হয়েছে, কিন্তু শেখ কামাল নির্বিকার। অদৃষ্টকে হাস্য মুখে পরিহাস করে বরং অধিকতর নিবিষ্ট হয়েছেন শুভ কর্মযজ্ঞে। একা নয়, বহুজনকে নিয়ে। বহুতর কর্মপরিকল্পনায়।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন স্পেশাল ট্রেনিংয়ের প্রথম ব্যাচে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শেখ কামাল স্বাধীনতার পর সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে ফিরে এসেছিলেন নিজ ভুবনে। হাত দিলেন ক্রীড়া, সঙ্গীত, নাট্য, শিক্ষা, সমাজ এবং তারুণ্যের রাজনীতি বিনির্মাণে। সেই সঙ্গে পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় ও সুন্দরতর করা। পিতা স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, সারাক্ষণ দেশ ও মানুষের কল্যাণে ব্রতী। সংসারের সর্বময় দায়িত্ব মাতা ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের হাতে। তাঁকে সহায়তা করতে পাঁচ ভাই বোন সদা উদগ্রীব। এক অসাধারণ পবিত্র এবং সুখের আবহ বত্রিশ নম্বরের বাড়িময়। মাথার ওপরে দেদীপ্যমান উজ্জ্বল বঙ্গবন্ধু-অথচ বত্রিশ নম্বরের বাড়ি শান্ত, স্নিগ্ধ, সুখী গৃহকোণ। প্রচলিত আছে, সূর্যের তাপ সহ্য করা যায় কিন্তু তপ্ত বালুর তাপ নাকি অসহনীয়। কিন্তু এই বাড়ির কারও চরিত্রেই সহ্যের রহিত তাপ নেই, অশোভন আচরণ নেই, ক্ষমতার অপব্যবহার নেই। শেখ কামালের চরিত্রে পরিবারের সুস্থ ও পবিত্র আবহের প্রভাব তো ছিলই। যার ফলে তিনি ছিলেন বন্ধুবৎসল, পরোপকারী, নিরহংকারী সজ্জন এক যুবক। শেখ কামালের শিষ্টাচার সম্পর্কে জানতে বেগম সুফিয়া কামাল এবং শিক্ষাবিদ আবুল ফজলের দুটি নিবন্ধ প্রাণিধানযোগ্য। নিবন্ধ দুটি পড়লে তাঁর সহজাত শিষ্টাচার সম্পর্কে পরবর্তী প্রজন্ম যে শিক্ষা লাভ করবেন তা পরম্পরায় দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
আগেই উল্লেখ করেছি মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে শেখ কামাল সরাসরি সম্পৃক্ত হয়েছিলেন রাজনীতি-সমাজ-সঙ্গীত-নাট্যের কর্মযজ্ঞে। সেই সময়ে সতীর্থ স্বজনরা এটাকে নিছক বিনোদন ভেবে ভুল করেছিলাম। এই সব কর্মযজ্ঞের ভিতর গূঢ় এক দর্শন ছিল। ছিল ইতিবাচক উদ্দেশ্য এবং সুদূরপসারী লক্ষ্য। শেখ কামালের লক্ষ্য ছিল আধুনিকতর এক সমাজ গড়ার। বঙ্গবন্ধুর ‘সোনার বাংলা’র অন্তর্নিহিত সঠিক রূপটি বুঝতে পেরেছিলেন তিনি। বুঝেছিলেন জাতির মনোগঠনের দায়িত্ব বাদ দিয়ে সুস্থ সামাজিক-সাংস্কৃতিক চর্চা হয় না। আর সুস্থ চর্চা ও সুপরিকল্পনা বাদ দিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ গড়াও সম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধু যেমন বাংলার মূল শিকড় উপড়ে ফেলে ‘সোনার বাংলা’ গড়তে চাননি, তেমনি শেখ কামালও চেয়েছিলেন বাংলার পবিত্র মাটির ওপর দাঁড়িয়েই বিশ্বের আধুনিক দেশ ও সমাজের সমকক্ষ হতে। এটাই তো পরম্পরার প্রকৃত শিক্ষা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চিন্তা-চেতনা, কর্মোদ্যোগ এবং সকল অর্জনেও বঙ্গবন্ধুর ‘সোনার বাংলার’ অন্তর্নিহিত রূপের উজ্জ্বল বর্ণচ্ছ্বটারই বহির্প্রকাশ ও প্রতিফলন। বড় বোন এবং ছোট ভাইয়ের ভাবনায় কী অদ্ভূত ঐক্যতান। জীবন দর্শন, দেশপ্রেম, মানুষ ও প্রাণিকূলের প্রতি ভালবাসা, ভদ্রতা, শিষ্টাচার, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি প্রীতি- সব মিলিয়ে বঙ্গবন্ধুর পুরো পরিবারটিই ছিল এক সুর ও এক তালে বাঁধা। সকল হারিয়েও শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা মূল সুরটি আজও অটুট রেখেছেন, বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হননি। শত কষ্ট সয়েও ধরে রেখেছেন বত্রিশ নম্বরের পারিবারিক ঐতিহ্য।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সোসিওলজি ডিপার্টমেন্টে, খেলার মাঠে, নাট্যমঞ্চে জাতির পিতার পুত্র হিসেবে শেখ কামাল কখনও বাড়তি কিছু প্রত্যাশা করেছেন বলে শোনা যায় না। শিক্ষকদের সঙ্গে ছিল গুরু-শিষ্যের পবিত্র সম্পর্ক। নিয়মিত ক্লাস করা, পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়া, ফল যাই হোক তা মেনে নেয়া- অন্যসব ছাত্রের মতোই ছিল স্বাভাবিক আচরণ। কোথাও, কখনও কোন ব্যাপারেই বাড়তি কিছু পাবার জন্য প্রভাব খাটিয়েছেন এমন কথা সহপাঠীদের মুখ থেকে কেউ শুনেছেন বলে শুনিনি। তবু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, জীবিতাবস্থাতেই তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে অনেক মিথ্যা অপবাদ। মৃত্যুর পর বছরে বছরে তা চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়েছে। যে যুবক সারাক্ষণ নিমগ্ন থাকতেন শুভ কর্মযজ্ঞে, যে যুবকের মুখ কখনও বিষাদের ছায়ায় মলিন হয়নি, যে যুবককে দেখলেই উদ্দীপ্ত যৌবনের দূত বলে বিশ্বাস করতে দ্বিধা হতো না, যে যুবক কিনা জীবনে সিগারেটের নেশা পর্যন্ত করেনি- সেই শেখ কামালের চারিত্র্যিক দোষ ধরার পরিকল্পিত চেষ্টা করা হয়েছে। দুঃখজনক হলেও এটা সত্য। কিন্তু এই দুঃখজনক সত্যের পেছনে লুকিয়ে আছে গভীর গভীরতম দূরভিসন্ধি এবং সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র। এই ষড়যন্ত্রের মুখোশ উন্মোচন এবং সত্য আবিষ্কারের দায়িত্ব এবং কাজ রাজনীতি বিশ্লেষকদের, ইতিহাস চর্চাকারীদের, গবেষকদের। সেই সব সত্য নিয়ে অমর কাব্য লিখবেন তারা। আমি, অতি সামান্যজন দু’একটি কথা এ প্রসঙ্গে বলার চেষ্টা করি। সব দায় গবেষকদের ওপর ছেড়ে দিয়ে আমরা তো বসে থাকতে পারি না। আমরা যদি কেবল নিজ পরিচয় ও অস্তিত্ব বড় করে জাহির করি তাহলে ভীষণ ভুল হবে না কি! পঁয়তাল্লিশ বছর পরে শেখ কামালের জন্মদিন পালন উপলক্ষে অতিমাত্রায় উচ্ছ্বাস ও আনুষ্ঠানিকতায় ঔজ্জ্বল্যে নিজেদের গৌরবান্বিত করতে শহীদ শেখ কামালের স্বতঃস্ফূর্ত ঔজ্জ্বল্য যেন ম্লান না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী সময়ে ষাটের দশকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে উদ্দেশ করে অপপ্রচার চালিয়েছে পাকিস্তানপন্থী দলগুলো। তাদের অপপ্রচারে রাজনৈতিক শিষ্টাচার বা সংস্কৃতি অনেক সময়েই মানা হতো না। জুলফিকার আলী ভুট্টো শিষ্টাচার বহির্ভূত অশোভন ও মিথ্যা তথ্য দিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর বংশ পরিচয় সম্বন্ধে। এটা ’৬৯-৭০ সালের কথা। পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকায় এই খবর প্রকাশিতও হয়েছিল (তথ্য সূত্র: আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী)। তথাকথিত শিক্ষিত স্মার্ট ভুট্টোর পক্ষেই এ ধরনের ব্যক্তিগত আক্রমণ সম্ভব। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে ভুট্টোর আরও অনেক তথ্যের প্রসঙ্গও দেয়া যেতে পারে। যেমন: ভুট্টো বলেছিল শেখ মুজিব বলেছেন, ‘ঢাকায় পাকিস্তানের রাজধানী স্থানান্তরিত হলে তিনি ছয় দফা ছেড়ে দেবেন’ এমন আরও উদাহরণ দেয়া যাবে। ভুট্টোর মতোই এই দেশের পাকিস্তানপন্থী ফকা চৌধুরী, সবুর খান, অলি আহাদ, ওয়াহিদুজ্জামান ঠাণ্ডা মিয়া, মৌলভি ফরিদ আহমেদ গংরাও কি কোন অংশে কম ছিল? বিশেষ করে ’৭০-এর নির্বাচনের আগে যে সব শব্দ প্রয়োগে তারা নির্বাচনী প্রচারণা করেছে তা মোটেও শোভন ছিল না।
এছাড়া বামপন্থী (প্রধানত চীনপন্থী) বুদ্ধিজীবী যারা নিজেদের শিক্ষিত, মার্জিত হিসেবে দাবি করত তারাই বা কম যায় কিসে! এদের ভেতর অন্যতম ছিল বদরউদ্দীন উমর, এনায়েতুল্লাহ খান প্রমুখ। শেখ মুজিব বা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে এদের প্রচারণা ছিল অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে এবং সেসবের একটা দীর্ঘস্থায়ী ছায়াও বিদ্যমান। যেমন: ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবের কোন ভূমিকা নেই, ছয় দফার সঙ্গে সিআইএ সম্পৃক্ত, আইয়ূব ও ইয়াহিয়ার সঙ্গে শেখ মুজিবের গোপন বৈঠক ইত্যাদি। পশ্চিম পাকিস্তানের জনপ্রিয় দৈনিক ডন, পাকিস্তান টাইমস, জং এবং পূর্ব পাকিস্তানের সাপ্তাহিক হলিডে পত্রিকা ছিল শেখ মুজিব ও তাঁর দল আওয়ামী লীগ বিরোধী অপপ্রচারের অন্যতম ঘাঁটি। কিন্তু ‘অসত্যের কাছে নাহি নত হবে শির, ভয়ে কাঁপে কাপুরুষ লড়ে যায় বীর।’ বঙ্গবন্ধু যথার্থ বীর ছিলেন, তাই অসত্য ও অপপ্রচারের কাছে কখনই নত শির হননি। বাঙালীর স্বার্থ রক্ষা তথা বাঙালীর মুক্তির লক্ষ্যে তিনি নির্ভীক ও অবিচল ছিলেন। ’৭০-এর নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ের পরেও পশ্চিম পাকিস্তানের ডন এবং জং নামক বহুল প্রচারিত দৈনিক লিখেছিল, শেখ মুজিব ইসলামাবাদে শপথ নিতে যাচ্ছেন। তথ্যটি ছিল ডাহা মিথ্যা। সবচেয়ে ভয়াবহ খবর ছাপা হয়েছিল ’৭১-এর ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হওয়ার পর। জং, পাকিস্তান টাইমস এবং অন্যান্য পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল ‘মুজিব ভারতে পালিয়ে গিয়েছে’। খবরটি ভয়াবহ এই জন্য যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার না দেখিয়ে রাতের আঁধারে হত্যাও করতে পারত।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেও প্রতিপক্ষরা কি চুপচাপ বসেছিল! পাকিস্তানের বন্দীশালায় অন্তরীণ থাকা অবস্থায় সেখানকার পত্রিকায় ছাপা হলো যে, শেখ মুজিব পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন চায়। এই খবর নিয়ে রাজনীতি শুরু করল খন্দকার মোশতাক, মশিউর রহমান যাদু মিয়া, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, শাহ আজিজ, মাহবুব আলম চাষী গং। এটাকে স্বাভাবিক রাজনীতি না বলে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলাই ভাল।
’৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ জয়লাভ করেছিল। কিন্তু তথ্য মতে প্রায় ত্রিশ ভাগের কাছাকাছি ভোটার হয় আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়নি অথবা ভোটদানে বিরত থেকেছে। সংখ্যার হিসাবে যা দুই কোটিরও বেশি। যদি ধরে নেই এরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ছিল না তবে কি ভুল হবে? ধরা যাক মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী শাসকের পক্ষেই তারা অবস্থান নিয়েছিল। আওয়ামী লীগের নৌকায় যারা ভোট দিয়েছিল তাদের ভেতর সকলেই কি বঙ্গবন্ধু ঘোষিত স্বাধীনতার পক্ষে ছিল? সম্ভবত নয়। যদি সত্য হতো তাহলে অনেক নির্বাচিত সংসদ সদস্য, তাদের ছেলেমেয়ে, আত্মীয় আপোস করেই দেশেই থেকে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতেন না। আমি এ ব্যাপারে ঢালাও মন্তব্য করছি না। কারণ স্বাধীনতাপ্রত্যাশী অনেকেই দেশ অভ্যন্তরে থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অল্প বিস্তর কাজ করেছেন, অহর্নিশ মুক্তির প্রার্থনা করেছেন। বঙ্গবন্ধুর জন্য, দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দেশের বহু বুদ্ধিজীবী পাকিস্তানী শাসকদের সমর্থন দিয়েছিলেন আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়ে। তাদের সবাই যে চাপে পড়ে বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছিলেন তা বোধহয় নয়। স্বাধীনতার পর এদের ভেতর কেউ কেউ গ্রেফতার হয়েছিলেন। আরেকটি দল সশস্ত্র বিপ্লবের নামে নক্সালবাড়ি স্টাইলে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। কোথাও কোথাও তারা মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছে। এরা ছিল চীনপন্থী। এদের প্রধান নেতাদের অনেকেই স্বাধীন বাংলাদেশকে মেনে নিতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুকে নেতা হিসেবে মানার তো প্রশ্নই আসে না। স্বাধীনতার পর এই সব গোপন সংগঠন এবং নেতারা প্রায় শুরু থেকেই বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যারপরনাই তৎপর হয়ে ওঠে। গ্রামে গ্রামে ডাকাতি, লুটপাট, হত্যা ইত্যাদি সশস্ত্র কর্মকাণ্ডের ভিতর দিয়ে ত্রাস সৃষ্টি করতে থাকে তারা। এদের সঙ্গে যুক্ত হয় অস্ত্রধারী রাজাকার, আলবদরের সদস্যরা। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ধর্ম নিরপেক্ষতা এবং অসাম্প্রদায়িক সমাজ বির্নিমাণের বিরুদ্ধে তারা বাধা সৃষ্টি করে, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম শারদীয় দুর্গোৎসবের আয়োজনে। বেশ কিছু গ্রাম অঞ্চলে তারা প্রতিমা ও মণ্ডপ ভাঙচুর করে। ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট এবং একই সঙ্গে সাম্প্রদায়িক বিভাজন সৃষ্টিতে এটা ছিল এক নষ্ট রাজনৈতিক খেলা।
ঠিক কাছাকাছি সময়ে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ধ্বজা তুলে গঠিত হলো জাসদ এবং জাসদ ছাত্রলীগ। নেতৃত্বে প্রায় সকলেই সাবেক পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সদস্য এবং বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী। এদের নেতৃত্বে গঠিত হলো গণবাহিনীর মতো একটি অস্ত্রধারী দল এবং গণকণ্ঠের মতো বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ বিরোধী দৈনিক পত্রিকা। সাপ্তাহিক হলিডে এবং সাপ্তাহিক হক কথার সঙ্গে যুক্ত হয়ে গণকণ্ঠ বাড়াল অপপ্রচারের শক্তি। এর মধ্যে পাকিস্তান থেকে ফিরতে শুরু করল সেনাবাহিনীর সদস্যরা। তাদের দাবি-দাওয়া এবং মুক্তিযোদ্ধা সৈনিকদের সঙ্গে দূরত্ব ও মনোমালিন্য দিনে দিনে বাড়তেই থাকল। সব কিছু মিলিয়ে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গবন্ধুর সরকারকে চাপে ফেলার চেষ্টা। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর অসামান্য শক্তি, নির্ভীক নেতৃত্ব ও সফলতা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জনপ্রিয়তা ও ভাবমূর্তি শনৈ শনৈ উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হওয়া পছন্দ হয়নি অনেকের। তাদের ঠুনকো অহঙ্কারে আঘাত লেগেছিল। কারণ তারা ছিল ‘উচ্চ ঘর, কংশ রাজের বংশধর’। আর বঙ্গবন্ধু ছিলেন টুঙ্গিপাড়ার ভূমিপূত্র। গণমানুষের প্রাণপ্রিয় নেতা। সাধারণের সঙ্গে অসাধারণ এক মহাপুরুষ যাঁর উচ্চতার পাশে ‘কংশ রাজের বংশধর’রা বামনসদৃশ। ঈর্ষাটা ছিল শ্রেণী চরিত্রের বিভাজনে। সামরিক, বেসামরিক এলিটদের চা-কফি-হুইস্কির আড্ডায় তাই প্রধান বিষয় ছিল বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ফিসফিসানি। যাকে পরিশীলিত ভাষায়, গাল ভরা বাক্যে বলা হয় হুইসপারিং অপপ্রচার। রাজনীতির পথচলায় বঙ্গবন্ধু সব সময় নিঃসঙ্গ শেরপা। আগরতলা মামলার মতো একটি ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র মাললায় তাকে যখন গ্রেফতার করা হয় তখন কিন্তু কোন রাজনৈতিক নেতা তাঁর পাশে আসেননি, একটা বিবৃতি পর্যন্ত দেননি। রাষ্ট্র পরিচালনার সময়ও তিনি যখন বিধ্বস্ত একটি নবীন দেশকে পুনর্গঠনে রাত-দিন হিমশিম খাচ্ছিলেন তখনও তার পাশে না এসে প্রায় সকলেই ছিল সমালোচনামুখর। রাজনীতির মারপ্যাঁচে এবং রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে কোন ত্রুটি খুঁজে না পেয়ে প্রতিপক্ষের কৌশলী অস্ত্র হলো বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে সামাজিকভাবে হেয় করা। চা-কফির কাপে এবং হুইস্কির গ্লাসে ঝড় তুলে তৈরি হতো এ ব্যাপারে নোংরা রণকৌশল। আর ফর্মুলা মতো কাজ করতো বিপক্ষের রাজনৈতিক অপশক্তির দল। কখনও একা, কখনও দল বেঁধে। যেহেতু বঙ্গবন্ধুর বড় পুত্র শেখ কামাল ছিলেন সামাজিক ক্ষেত্রে সবচেয়ে কর্মচঞ্চল এবং তরুণ সমাজের নেতৃত্বে জনপ্রিয়তম, সেহেতু তাকেই প্রধান টার্গেট করেছিল বিপক্ষ শক্তি। শেখ কামালের চরিত্র হননের জন্য বেছে নেয়া হয়েছিল এমন সব কল্পকাহিনী যা সাধারণ জনের কাছে অত্যন্ত ঘৃণার বিষয়। আর অপবাদের তুসের আগুনে বাতাস দিয়েছে কিছু সংবাদ মাধ্যম যাদের নাম আগে উল্লেখ করা হয়েছে। সাধারণ ও স্বাভাবিক বিশ্লেষণে অনেকেই অপপ্রচারের বিষয়গুলোর সত্যতা যাচাই করেনি। প্রতিবাদ তো দূরের কথা। এ ব্যাপারে শেখ কামালও ছিলেন পিতা বঙ্গবন্ধুর মতো নিঃসঙ্গ শেরপা। বন্ধুবিহীন একা।
’৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর শাসক শ্রেণী বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে শেখ কামাল সম্পর্কে মিথ্যা ও নোংরা অপবাদ এবং অপপ্রচারকে আরও পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করেছে। শেখ কামালের চরিত্র হননের মাধ্যমে তারা মূলত ধ্বংস করতে চেয়েছে বঙ্গবন্ধুর মতো মহানায়কের বিশাল ভাবমূর্তি, তাঁর পরিবারের সহজিয়া জীবন দর্শন এবং মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের ঐতিহ্য ও ইতিহাস।
কিন্তু দিনে দিনে সত্য প্রকাশিত হচ্ছে নিজ শক্তিতে। বহুমাত্রিক শেখ কামালকে চিনতে আগ্রহী হচ্ছে নতুন প্রজন্ম। এটাই আশার কথা। এটাই শেখ কামালের শুভ কর্মের ফল। এটাই তাঁর জন্মদিনের প্রাপ্তি।
লেখক : আহ্বায়ক, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।