তাপস হালদার :

মহান ব্যক্তিদের অনেক কর্ম থাকে, তার মধ্যে দু-একটি কর্ম হয়তো তাঁকে হাজার বছর বাঁচিয়ে রাখে। শ্রদ্ধেয় পীযূষ বন্দোপাধ্যায়ও দেশ, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য অনেক অবদান রেখেছেন। কিন্তু আমি মনে করি, ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’ চলচ্চিত্রের জন্য তিনি হাজার বছর বেঁচে থাকবেন। চলচ্চিত্রটিতে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড ও ষড়যন্ত্রের নেপথ্যের কাহিনী সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এটি হতে পারে ইতিহাসের একটি দলিল। বাঙালি জাতির হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চরিত্রে অভিনয় করা বিরল এক সৌভাগ্যের ব্যাপার।

পীযূষ বন্দোপ্যাধায় সেই সৌভাগ্য অর্জন করেছেন। উপমহাদেশের বরেণ্য সাংবাদিক, একুশে গানের রচয়িতা, পলাশী থেকে ধানমন্ডি চলচ্চিত্রের পরিচালক শ্রদ্ধেয় আবদুল গাফফার চৌধুরী চলচ্চিত্রটি তৈরির প্রেক্ষাপট বলতে গিয়ে মাঝে মাঝেই একটি কথা বলেন, ‘চলচ্চিত্রটিতে অভিনয় করার জন্য অনেককেই অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু তৎকালীন সরকারের রোষাণলে পড়ার ভয়ে কেউ-ই রাজি হচ্ছিল না, পীযূষ বন্দোপ্যাধায় সেই সাহসটি দেখিয়েছিল।’চলচ্চিত্রটি যখন তৈরি করা হয় তখন দেশের প্রেক্ষাপট খুবই খারাপ অবস্থায় ছিল। স্বাধীনতাবিরোধী বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের তান্ডবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের লোকদের কথা বলাটাই দায় হয়ে পড়েছিল। সে সময় এই ধরনের একটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করা মোটেও সহজসাধ্য ছিল না। এই  চলচ্চিত্রের জন্য পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়কে লন্ডন, নিউইয়র্ক, ঢাকায় একাধিকবার প্রাণ নাশের চেষ্টা করা হয়েছে। তাঁকে এজন্য দেশ-বিদেশে পালিয়ে থাকতেও হয়েছিল।

পীযূষ বন্দোপাধ্যায়ের মুক্তিযোদ্ধা, অভিনেতা, সাংবাদিক, আবৃত্তিকার, লেখক, গবেষক বহু পরিচয় থাকলেও তিনি স্বনামেই খ্যাত, আলাদা করে পরিচয় দিতে হয় না। এদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। প্রগতিশীল প্রতিটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন তৈরির ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের প্রতিষ্ঠাকালীন স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ শাখার প্রতিষ্ঠাতা সদস্যসহ বহু সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদে তিনি দায়িত্বপালন করেছেন।

বাংলাদেশের সকল প্রগতিশীল আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং এখনও দিয়ে যাচ্ছেন।

স্কুল ছাত্র জীবনেই তাঁর রাজনীতির হাতেখড়ি। ’৬২-র শিক্ষা কমিশন আন্দোলন ও ৬৬-র ছয় দফা আন্দোলনে স্কুলের ছাত্র হয়েও সক্রিয়ভাবে  অংশগ্রহণ করেন। ’৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় তো ছাত্রনেতা হিসেবে রাজেন্দ্র কলেজসহ বৃহত্তর ফরিদপুর জেলায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। তখন বৃহত্তর ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগের সিনিয়র সহ-সভাপতির দায়িত্ব নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পূর্ববর্তী সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। ১৯৮৫ সালে এরশাদ সরকারের পতন আন্দোলন ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দাবীতে গড়ে ওঠা যুব ঐক্যের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও যুব সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা হিসেবে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে পালন করেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

জাতির পিতার জেষ্ঠ্য সন্তান শহীদ শেখ কামালের সাথে বন্ধুত্ব হয়ে যায় ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে কাজ করতে গিয়ে। সেই বন্ধুত্ব শেখ কামাল শহীদ হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত বলবৎ ছিল। শেখ কামালের সাথে বন্ধুত্বকে তিনি আজও ভুলতে পারেননি। সেজন্যই শেখ কামালের কর্ম জনগণের মাঝে ছড়িয়ে দিতে তাঁর (শেখ কামাল) জন্মদিনে বন্ধুদের নিয়ে স্মৃতিচারণমূলক অনুষ্ঠান করে থাকেন। শেখ কামালের কর্ম ও আদর্শকে বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন।

এক সময় বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ মুখ ছিলেন পীযূষ বন্দোপাধ্যায়। তাঁর নামেই নাটক দেখতে হুমড়ি খেয়ে পড়তো দর্শক-শ্রোতা। আশির দশকের শুরুতে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত ‘সকাল সন্ধ্যা’ নাটকে ‘শাহেদ’ চরিত্রে অভিনয় করে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। প্রথম অভিনীত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচিত্র ‘আগামী’। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘একাত্তরের যীশু’তে পাদ্রীর ভূমিকায় অনবদ্য অভিনয় করেন। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচিত্র ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ও ‘গেরিলা’য় অভিনয় করেও প্রসংশিত হয়েছেন। এছাড়াও পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র হলো মহামিলন, উত্তরের খেপ, কিত্তন খোলা, মেঘলা আকাশ, আধিয়ার, আমার আছে জল, মৃত্তিকা মায়া, আমি শুধু চেয়েছি তোমায়, বুনো হাঁস।

বাংলাদেশের বিকল্প ধারার চলচ্চিত্রে প্রধান অভিনেতা ছিলেন পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়। অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি সকল শ্রেণীর মানুষের হৃদয়ে আলাদা স্থান করে নিয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্র ছিলেন। শুরু থেকেই অন্যান্য কাজের পাশাপাশি গণমাধ্যমেও যুক্ত ছিলেন। নব্বই দশকের শুরুতে ছিলেন দৈনিক লাল সবুজ পত্রিকার সম্পাদক। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট চ্যানেল একুশে টিভি’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

আশির দশক থেকে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের পক্ষে নিয়মিত মূলধারার গণমাধ্যমগুলোতে লিখে যাচ্ছেন। এছাড়াও মৌলিক সাহিত্য, গল্প, উপন্যাস, নাটক, কবিতা ও ছড়ার অসংখ্য গ্রন্থ লিখে বাংলা সাহিত্যকে করেছেন সমৃদ্ধ।

বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে স্বাধীনতার স্বপক্ষের সকল ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী-পেশার গুণীজনদের নিয়ে তিনি তৈরি করছেন ‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ’ নামে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। এটিই বাংলাদেশের একমাত্র সংগঠন যেখানে সকল ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী-পেশার প্রতিনিধিত্ব আছে। তিনি নিজে অসাম্প্রদায়িক চেতনা লালন করেন বলেই সকল ধর্ম বর্ণের মানুষের কাছে সম্প্রীতির বার্তা পৌঁছে দিতেই সম্প্রীতি বাংলাদেশ সংগঠনটি গঠন করেছেন। সম্প্রীতির বার্তাবাহক হয়ে বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ গড়ার দর্শনকে সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তিনি নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন।

১৯৫০ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর, লোকসংস্কৃতির লীলাক্ষেত্র ফরিদপুর শহরে জন্মগ্রহণ করেন বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়। আজ এই বরেণ্য ব্যক্তির ৭১তম জন্মদিন। শুভ জন্মদিনে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক: সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা।

ইমেইল: haldertapas80@ gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *