অভিমত

শুভ জন্মদিন শহীদ লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল

তাপস হালদার

আজ ২৮ এপ্রিল। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুনেচ্ছা মুজিবের দ্বিতীয় পুত্র বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গর্বিত অফিসার, মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট শেখ জামালের ৬৮ তম জন্মদিন।

১৯৫৪ সালের এ দিনে গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। তিনি ঢাকা রেসিডেনশিয়াল মডেল কলেজ থেকে ম্যাট্রিক ও ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। তিনি অত্যন্ত পড়ুয়া প্রকৃতির ছিলেন, দিনের বেশিরভাগ সময়ই পড়াশোনায় ডুবে থাকতেন।বাজাতেন গীটার, খেলতেন ক্রিকেট।

আরও পড়ুন: এশিয়ায় বিস্ময়কর ডিজিটাল লিডার বাংলাদেশ : সজীব ওয়াজেদ জয়ের প্রবন্ধ

শেখ জামালের মুক্তিযুদ্ধে যোগদান ছিল অনেক ঘটনাবহুল। জাতির পিতা  বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে গ্রেফতারের পর পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে তিনিও পাকিস্তানীদের হাতে ধানমন্ডির ১৮ নম্বর রোড়ের  একটি বাড়িতে  গৃহবন্দী ছিলেন। যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে ৫ আগস্ট সকালে পরিবারের কাউকে না জানিয়ে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি  যুদ্ধে চলে গিয়েছিলেন। তাঁর যাওয়াটা অত সহজ ছিল না।পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর প্রহরা থেকে পালানোর সময় ধরা খেলে মৃত্যু অনিবার্য ছিল। ভারতের আগরতলা হয়ে কলকাতা পৌঁছে যান। সেখানে মুজিব বাহিনীর বাছাইকৃত ৮০ জন নির্বাচিত তরুণ সদস্যের সাথে ২১ দিনের প্রশিক্ষণ শেষে সক্রিয় যুদ্ধের ময়দানে নেমে পড়েন। যোগ দেন ৯ নং সেক্টরে। যুদ্ধে অনেক দুঃসাহসিক অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ২ ডিসেম্বর লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় মুক্তিযুদ্ধের যেসব আলোকচিত্র আসে তার একটিতে সীমান্তের ১০ মাইল ভেতরে একটি রণাঙ্গনে সাবমেশিনগানধারীদের একজন হিসেবে ছবি ওঠে শেখ জামালের।

শেখ জামাল ছিলেন একজন দেশপ্রেমিক মেধাবী সেনা অফিসার। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে দেশের  সেবা করার জন্য সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর লং কোর্স’র প্রথম ব্যাচের কমিশন্ড অফিসার। ১৯৭৪ সালের ২৯ জানুয়ারি যুগোস্লাভিয়ার  প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো বাংলাদেশ সফর কালে শেখ জামালের সেনাবাহিনীতে  কাজ করার আগ্রহ দেখে  টিটো তাঁকে যুগোস্লাভিয়ার মিলিটারি একাডেমিতে ক্যাডেট হিসেবে প্রশিক্ষণের প্রস্তাব দেন। সে প্রস্তাব গ্রহণ করে তিনি যুগোস্লাভিয়ার ক্যাডেট একাডেমিতে প্রশিক্ষণের জন্য চলে যান। এরপর ব্রিটেনের স্যান্ডহার্স্ট একাডেমি থেকে প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে ঢাকা সেনানিবাসস্থ দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে যোগদান করেন।

দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলে দেড় মাস সময়ের চাকরিকালে অফিসার ও সৈনিকদের মাঝে তিনি অসাধারণ পেশাগত দক্ষতা ও আন্তরিকতার ছাপ রেখেছিলেন। কয়েক সপ্তাহেই শেখ জামাল অফিসার ও সৈনিকদের মধ্যে তাদেরই একজন হয়ে যান। ট্রেনিং গ্রাউন্ডে, রণকৌশলের ক্লাসে, অবস্টাকল ক্রসিংয়ে অংশ নিয়ে সৈনিকদের মুগ্ধ করেন। ব্যাটালিয়ন বক্সিং টিমের সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেন। বিকেলে ইউনিট সদস্যদের নিয়ে খেলতেন বাস্কেট বল। সকালে পিটির সময় সকলকে দৌড়ে পিছনে ফেলে অবাক করে দিতেন।

১৪ আগষ্ট রাতে ব্যাটালিয়ন ডিউটি অফিসার হিসেবে ক্যান্টনমেন্টে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। রাতে ফিরে আসেন ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে। ভোর রাত ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের শিকার শেখ জামালসহ তাঁর পরিবার। এভাবেই থেমে যায় এই ২১ বছরের টগবগে তরুণের জীবনের আলো।

জাতির জনকের পুত্র, একজন রাষ্ট্রপতির সন্তান হয়েও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়েই সেনাবাহিনীর চাকুরি করেছিলেন। অথচ সেই সেনাবাহিনীর কিছু উচ্ছৃঙ্খল সদস্যদের হাতেই তাঁকে শহীদ হতে হল। তখন তিনি ছিলেন ক্যাপ্টেন পদমর্যাদার অফিসার। সেদিন মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসারের হত্যার বিচার সেনা আইনে করতে ব্যর্থ হয়েছিল তৎকালীন সেনাবাহিনী।

শেখ জামাল আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু এখনও তরুণ প্রজন্মকে আলোর পথ দেখান শহীদ শেখ জামাল। তাঁর স্মৃতিকে ধরে রাখতে তৈরি হয়েছে শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব। ফুটবল, ক্রিকেটসহ প্রতিটি খেলায় আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে ক্লাবটি।

আজকের এই দিনে দুঃসাহসিক মুক্তিযোদ্ধা, সুদক্ষ মেধাবী সেনা অফিসার শেখ জামালকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। শুভ জন্মদিন শহীদ লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল।

লেখক: সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা।

ইমেইল: haldertapas80@ gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *