ব্যক্তিত্ব

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন : বাংলাদেশকে দিয়ে গেছেন শিল্পের অমূল্য রত্নখনি

লিমন নন্দি: “এখনতো চারিদিকে রুচির দুর্ভিক্ষ! একটা স্বাধীন দেশে সুচিন্তা আর সুরুচির দুর্ভিক্ষ! এই দুর্ভিক্ষের কোন ছবি হয়না।” – শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন।

জয়নুল আবেদিন ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের ২৯ ডিসেম্বর তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ মহকুমার কেন্দুয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম তমিজউদ্দিন আহমদ। তিনি ছিলেন একজন পুলিশ কর্মকর্তা। তাঁর মায়ের নাম জয়নাবুন্নেছা। ৯ ভাইবোনের মধ্যে জয়নুল আবেদিন ছিলেন সবার বড়।

ছেলেবেলা থেকেই শিল্পকলার প্রতি ছিল তাঁর গভীর আগ্রহ৷ আর তাইতো মাত্র ষোল বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে বন্ধুদের সাথে সেই দূরের শহর কলকাতায় গিয়েছিলেন কলকাতা গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টস দেখার জন্য৷ সেখান থেকে ঘুরে আসার পর সাধারণ পড়াশুনায় মন বসাতে পারছিলেন না কোনভাবেই৷ তাই ১৯৩৩ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষার আগেই স্কুলের সাধারণ পড়ালেখার পাট চুকিয়ে কলকাতায় চলে যান এবং সেখানে গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টস-এ ভর্তি হন৷ তাঁর মা ছেলের এই আগ্রহ দেখে নিজের গলার হার বিক্রি করে ছেলেকে কলকাতার এই আর্ট স্কুলে পড়তে যেতে সাহায্য করেছেন৷ আর ছেলেও মায়ের এই ঋণ শোধ করেছেন দেশের স্বনামধন্য শিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে৷

ময়মনসিংহের সাথে জয়নুলের ছিলো আত্মার সম্পর্ক, ছিলো জীবনের ঋণের সম্পর্ক। এখানকার জেলা বোর্ডই কলকাতায় তাঁর শিল্পকলা শিক্ষাকালের প্রথম পর্যায়ের অতি জরুরি বৃত্তিটি দিয়ে তাঁকে উত্‍সাহিত করেছিল৷ তাঁর বাবা ছিলেন ময়মনসিংহে কর্মরত ছোট দারোগা৷ অনেক কষ্টে তিনি ছেলের জন্যে মাসে মাত্র দশটি টাকা পাঠাতে পারতেন৷ সেই তিরিশের দশকেও এটা খুব সামান্য পরিমাণ টাকাই ছিল৷ তখন ময়মনসিংহ জেলা বোর্ড আর্থিক সাহায্য না করলে প্রায় অসম্ভব হতো জয়নুলের শিল্প-শিক্ষা গ্রহণ৷ কলেজের অধ্যক্ষ মুকুল দে-র জোর সুপারিশে কাজ হয়েছিল৷ জেলা বোর্ড জয়নুলকে মাসিক পনেরো টাকা করে বৃত্তি অনুমোদন করেছিল৷ এতে করে আর্ট স্কুলের জীবনটা তাঁর কিছুটা হলেও দুশ্চিন্তামুক্ত হয়েছিল৷

জয়নুল আবেদিন তাঁর এসব ঋণের কথা ভোলেননি কখনও৷ তিনি যখন তৃতীয় বর্ষের ছাত্র তখন থেকেই তিনি পত্র-পত্রিকার অঙ্গসজ্জা করে যে সামান্য আয় করতেন তা দিয়েই তাঁর পিতার অস্বচ্ছল পরিবারে আর্থিক অবদান রেখেছেন৷ তাঁর মাকে দিয়েছেন ভালোবাসা৷ তাঁর জন্মস্থান ময়মনসিংহকে উপহার দিয়েছেন একটি আর্ট গ্যালারি আর বাংলাদেশের জনগণকে দিয়েছেন তাঁর সারা জীবনের শিল্পকর্মের বৃহত্‍ সম্ভার৷

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শিল্পচার্যের ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। তাঁরা মননে-আদর্শে একই ধরনের মত ও পথের অনুসারী ছিলেন। এই দুই বাঙালি মহাপুরুষ বাঙালি সংস্কৃতির উন্নয়ন ও বিকাশে আজীবন কাজ করেছেন।

স্বাধীনতার পর জাতির পিতা শিল্পাচার্যকে বাংলাদেশের সংবিধানের স্কেচ করার দায়িত্ব দেন। তিনি সূচারুভাবে সে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু সোনারগাঁয়ে বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন স্থাপনের দায়িত্বও দেন শিল্পাচার্যকে।

সকল শিল্পকর্মই যে লোক ঐতিহ্যের ধারায় প্রবাহিত হয় তার বাস্তব রূপায়ণই আজকের ঐতিহাসিক সোনারগাঁও-এর বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন।

১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের ছবি চিত্রমালার জন্য তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। তার চিত্রকর্মের মধ্যে অন্যতম ১৯৫৭-এ নৌকা, ১৯৫৯-এ সংগ্রাম, ১৯৭১-এ বীর মুক্তিযোদ্ধা, ম্যাডোনা। তার দীর্ঘ দুটি স্ক্রল ১৯৬৯-এ অংকিত ‘নবান্ন’ এবং ১৯৭৪-এ অংকিত ‘মনপুরা-৭০’ জননন্দিত দুটি শিল্পকর্ম। অনুমান করা হয় তার চিত্রকর্ম তিন হাজারেরও বেশি।

চিত্রশিল্প বিষয়ক শিক্ষার প্রসারের জন্য তিনি ‌‘শিল্পাচার্য’ অভিধা লাভ করেন। তিনি ১৯৫৮ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের সবচেয়ে বড় খেতাব হেলাল-ই-ইমতিয়াজ, ১৯৬৮ সালে ঢাকা আর্ট কলেজের ছাত্রদের তরফ থেকে ‘শিল্পার্চায’ উপাধি এবং ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে জাতীয় অধ্যাপকের সম্মান লাভ করেন। ১৯৩৮ সালে চিত্র প্রদর্শনীতে তিনি নিখিল ভারত স্বর্ণপদক লাভ করেন।

১৯৪৬ সালে জয়নুল আবেদিন ঢাকা নিবাসী তৈয়ব উদ্দিন আহমদের কন্যা জাহানারা বেগমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি তিন পুত্রের জনক। তার জ্যৈষ্ঠ পুত্র সাইফুল আবেদিন স্থপতি। বর্তমানে তিনি আমেরিকা প্রবাসী। দ্বিতীয় পুত্র খায়রুল আবেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূগোল বিষয় নিয়ে এমএ এবং কনিষ্ঠ পুত্র মঈনুল আবেদিন (মিতু) প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পানি-সম্পদ বিদ্যায় স্নাতক সম্পন্ন করেছেন।

জয়নুল আবেদীন ছিলেন সাধারণ আটপৌরে মানুষের শিল্পী। সাধারণ মানুষের জীবনচিত্র, দুঃখবেদনা ছিল এই মহান শিল্পীর ছবির উপজীব্য। তিনি একাধারে ছিলেন নিঃসর্গ প্রেমিক, অন্যদিকে তার রঙ-তুলিতে ফুটে উঠেছে দ্রোহের ভাষা।

কাকতালীয় হলেও আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবনের সঙ্গে শিল্পী জয়নুল আবেদীনের অনেক মিল খুঁজে পাই আমরা। দুজনেরই জন্ম গ্রামে। ছাত্রাবস্থার একটা সময় তাঁদের কেটেছে ময়মনসিংহে। আমাদের জাতীয় কবি এবং শিল্পাচার্য তৎকালীন পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় একই বছর অর্থাৎ ১৯৭৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন। দুজনকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে সমাহিত করা হয়।

ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরের ছোট্ট জয়নুল আজীবন নদীর মতই ছুটে বেড়িয়েছেন শিল্পের সন্ধানে আর বাংলাদেশকে দিয়ে গেছেন শিল্পের অমূল্য রত্নখনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *