জাতীয়সর্বশেষ

শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা, চাইলেই প্রতিরোধ সম্ভব

কর্মজীবী পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান সায়েল মাহমুদ (ছদ্মনাম)। রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সায়েল। বাবা-মা কর্মজীবী হওয়ায় একাই বেড়ে উঠা তার। ফলে তার মনে বাসা বাধতে থাকে বিষণ্ণতা, নিঃসঙ্গতা এবং একাকিত্বের মতো রোগ।

একসময় সায়েল ভাবতে থাকে তাকে ভালোবাসা বা যত্ন নেয়ার মতো কেউ নেই। গরম ভাত রান্না করে আদর করে ডেকে খেতে দেওয়ার মতোও কেউ নেই। ফলে সায়েলের বাবা-মার সাথে দূরত্ব বেড়ে যেতে থাকে।

একপর্যায়ে তার পরিচয় হয় একটি মেয়ের সাথে। ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে তৈরি হয় ভালোবাসার সম্পর্ক। কিন্তু সেটিও বেশি দিন টেকেনি। ফলে ‘একাকি’ সায়েল সিদ্ধান্ত নেয় আত্মহত্যা করে মুক্তি দেবে নিজেকে।

সায়েলের আত্মঘাতী হতে যাওয়ার লক্ষণ বুঝতে পারেন তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বন্ধু। পরে সে আরও কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে সায়েলকে কাউন্সেলিং শুরু করেন। এতে সায়েল আত্মহননের পথ থেকে সরে এলেও এখনও কিছুটা হতাশার মধ্যে আছে।

জীবন সুন্দর, তাই যত কষ্টই থাকুক বেঁচে থাকতে চায় মানুষ। কথায় আছে, মানুষ নাকি বাঁচার জন্য ভাসমান খড়কুটোও আঁকড়ে ধরে। তাহলে কেন আত্মহত্যার মতো একটি কাণ্ড অবলীলায় ঘটিয়ে ফেলে মানুষ? এই বিষয়ে কথা হয় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীর সাথে।

তারা বলেন, মূলত একাকিত্ব থেকেই আত্মহত্যার চিন্তা মাথায় আসে। এর পেছনে রয়েছে হতাশা ও দারিদ্র্যও। অতি দরিদ্রতা গ্রাস করলে অনেক সময় আমাদের ধর্মের কথা মাথায় আসে না। তখন শান্তি পাওয়াটাই মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। আবার যার সব কিছু পাওয়া হয়ে যায়, তখন সে একটা সেক্টরে হতাশ হয়ে তার হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। মস্তিষ্ককে তখন একাকিত্ব গ্রাস করে মৃত্যুর মতো সিদ্ধান্ত নিতেও পিছপা হয় না।

পারিবারিক কলহ-বিবাদ, প্রেম-ঘটিত জটিলতা, বেকারত্ব, নিঃসঙ্গতা, মানসিক চাপ ও তীব্র বিষণ্ণতা থেকেও শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি এন্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী সাব্বির সাদাত পিয়াস মনে করেন, সায়েলের মতো বিষণ্ণতা, নিঃসঙ্গতা এবং একাকিত্বের মতো রোগে আক্রান্ত যারা তাদের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের চিকিৎসা নেয়া প্রয়োজন। চিকিৎসার সঙ্গে কর্মজীবী বাবা-মায়েরও উচিত সন্তানদের আরও বেশি সময় দেয়া, তাদের বুঝার চেষ্টা করা, সন্তানদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণের মাধ্যমে দূরত্ব কমানো।

সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত দেশে ৩৬৪ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৯৪ জনই স্কুল শিক্ষার্থী। দ্বিতীয় স্বচ্ছ ৭৬ জন কলেজ শিক্ষার্থী। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ৫০টি। আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে ৪৪ জন মাদ্রাসার শিক্ষার্থীও আছে।

১৫০টি জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকার তথ্য থেকে এই সমীক্ষা চালায় সংগঠনটি। এতে দেখা গেছে প্রেম-ঘটিত কারণে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিষণ্ণতা, নিঃসঙ্গতা, বৈষম্য, নিজের সম্পর্কে হতাশা, বিচ্ছিন্নতা, পারিবারিক সমস্যাসহ ইত্যাদি কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক আরটিভি নিউজকে বলেন, ‘মূলত হতাশা থেকেই শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যা করে৷ এমন আছে যে পরীক্ষায় ভালো করতে পারেনি, এ কারণে আত্মহত্যা করেছে৷ এমন অনেক উদাহরণ আছে৷ আবার ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে আত্মহত্যার ঘটনাও দেখা যাচ্ছে৷ আত্মহত্যার কারণ বিশ্লেষণ করে যদি পক্ষে যুক্তি তুলে ধরা হয়, তাহলে আরেকজন আত্মহত্যার যুক্তি খুঁজে পায়৷ তাই আমাদের সবার সতর্ক হওয়া প্রয়োজন৷ মানসিক স্বাস্থ্যও যে শারীরিক স্বাস্থ্যের মতই গুরুত্বপূর্ণ তা অনেকেই বুঝতে পারেন না৷ প্রযুক্তি মানুষকে যেমন সচেতন করে, তেমনি আত্মহত্যা প্রবণ করে৷ ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে আত্মহত্যার মধ্যে কেউ ‘বীরত্ব’ খুঁজে পেতে পারেন বলে মনে করেন।

তিনি আরও বলেন, আর্থিক ও সামাজিক বৈষম্য মানুষকে হতাশায় ফেলে দিচ্ছে৷ আর এই হতাশা থেকে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে৷ এটা শুধু বাংলাদেশে নয় সারাবিশ্বেও এমন দেখা যাচ্ছে৷ এর বাইরে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কারণেও মানুষ আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হচ্ছে৷ নিজেকে যখন কেউ অপ্রয়োজনীয় মনে করেন, জীবন অর্থহীন মনে করেন তখন আত্মঘাতী হন৷ তবে এইসব কারণের মূল উপাদান রাষ্ট্র ও সমাজেই বেশি৷

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ আরটিভি নিউজকে বলেন, মানসিক রোগীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি। বিষণ্ণতার রোগীদের মধ্যে এক ধরনের তীব্র আশাহীনতা তৈরি হয়। তারা সবকিছু নেতিবাচকভাবে দেখে। তারা ভাবে, এ পরিস্থিতি দিন দিন আরও খারাপ হবে এবং এটি পরিবর্তনের জন্য শত চেষ্টায়ও কোনও লাভ হবে না। এর চেয়ে মুক্তির একমাত্র উপায় নিজেকে মেরে ফেলা। এ চিন্তায় তাড়িত হয়ে তারা আত্মহত্যা করে।

তিনি আরও বলেন, দুই ধরনের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। ১. আগে থেকে পরিকল্পনা করে, আয়োজন করে, সুইসাইড নোট লিখে আত্মহত্যা করেন অনেকে। যেটাকে বলা হয় ডিসিসিভ সুইসাইড। ২. হুট করে আবেগের রাশ টানতে না পেরে আত্মহত্যা করে ফেলেন অনেকে, যেটাকে বলা হয় ইমপালসিভ সুইসাইড। ডিসিসিভ সুইসাইড যারা করেন, তারা আগে থেকেই কিন্তু আত্মহত্যার ইঙ্গিত দিয়ে থাকেন।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দিলে আত্মহত্যার হার বেড়ে যায়। সমাজে যখন বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়, যখন মানুষ বিষণ্ণতায় ভোগে, তখন আত্মহত্যার হারও যায় বেড়ে। অনেকে আবার বাধ্য হয়েও আত্মহত্যা করে; যেমন- দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীরা অনেক সময় আত্মহত্যা করে। অসুখের তীব্র যন্ত্রণা সইতে না পেরে এ পথ বেছে নেয়।

আত্মহত্যা প্রতিরোধ

আত্মহত্যা প্রতিরোধ করতে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। শিশুদের বিকাশের সময় তাদের এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে তারা সফলতার মতো ব্যর্থতাকে মেনে নিতে পারে। যেকোনো ধরনের মানসিক সমস্যা বা আত্মহত্যার ইঙ্গিত পেলে দ্রুত মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। বিষণ্ণতা, মাদকাসক্তি, ব্যক্তিত্বের বিকার, সিজোফ্রেনিয়াসহ সব মানসিক রোগের দ্রুত শনাক্ত করা ও সুচিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

পারিবারিক বন্ধনগুলো দৃঢ় করতে হবে পাশাপাশি পরিবারে প্রত্যেকের সঙ্গে ভাল সময় কাটাতে হবে। আত্মহত্যার সংবাদ পরিবেশনের সময় গণমাধ্যমগুলোকে সবসময় অনুমোদিত নির্দেশিকা মেনে চলতে হবে। সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলোর ব্যবহারকারীদেরও সতর্কতার সঙ্গে আত্মহত্যার বিষয় নিয়ে মন্তব্য ও ছবি পোস্ট করতে হবে। এখানেও কোনও আত্মহত্যার ঘটনাকে খুব মহৎ করে দেখানোর চেষ্টা করা যাবে না। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলোর কর্তৃপক্ষেরও নিজস্ব নীতিমালা থাকা প্রয়োজন।

আত্মহত্যা প্রতিরোধে একটি সার্বক্ষণিক হটলাইন এখন সময়ের দাবি বলে মনে করেন ঢাবি শিক্ষক তৌহিদুল হক। তিনি বলেন, সরকারি একটি হটলাইন চালু করা জরুরি। যেটাতে রোগী বা তার পরিবার যোগাযোগ করে, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শসহ কাউন্সেলিংয়ের মধ্যে থাকতে পারে। যাতে সঠিক সময়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করে আত্মহত্যা প্রতিরোধ করতে পারে। এ জন্য সবাইকে যার যার ক্ষেত্র থেকে একযোগে কাজ করারও পরামর্শ দেন এই সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *