শম্পা কর, ধূমকেতু ডটকম: আধুনিক হিন্দু নারীরা সচরাচর শাঁখা-পলা না পরলেও অনুষ্ঠান বা উৎসবে কিন্তু ঠিকই পরেন। হাল ফ্যাশনের নান্দনিক সব ডিজাইনের শাঁখা-পলা তাঁদের সাজসজ্জার অন্যতম উপকরণ। তাই ধর্মের গণ্ডি পেরিয়ে ফ্যাশন উপকরণ হিসেবেও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে শাঁখা-পলা।

এদিকে বাঙালি হিন্দুদের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজা আসতেও খুব বেশি দিন বাকি নেই। আর উৎসব এলেই সাজসজ্জার বিষয়ও চলে আসে। পূজার সাজসজ্জায় বিবাহিত হিন্দু রমণীদের নতুন পোশাকের সাথে একজোড়া নতুন শাঁখা-পলা যেন না হলেই নয়! তাই তাদের জন্য শাঁখা-পলা কী, কেন পরানো হয়, কী এর ইতিহাস এর পাশাপাশি জানাবো- ভালো শাঁখা কিভাবে চেনা যায় আর এগুলো কোথায়, কতো দামে পাওয়া যায়।

শাঁখা-পলা কী

বাঙালি বা অবাঙালি সব হিন্দু সম্প্রদায়ের বিবাহিত রমনীদের হাতে শাঁখা-পলা অতি আবশ্যকীয় অলংকার। শাঁখা-পলা বিবাহিত নারীদের মাঙ্গলিক চিহ্ন হিসেবে ধরা হয়। কথিত আছে হিন্দু রমণীরা বিয়ের পর স্বামীর সুস্থতা ও দীর্ঘায়ু কামনায় হাতে শাঁখা-পলা পরেন। হিন্দু বিয়েতে শাঁখা-পলা, নোয়া সিঁদুরের মতোই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।  শাঁখা-পলা বিয়ে এবং স্বামীর সাথে সম্পৃক্ত হওয়ায় স্বামী মারা গেলে হিন্দু রমণীদের হাত থেকে এগুলো খুলে নেয়া হয়। আধুনিক কালে অনেক বিবাহিতা রমণীই শাঁখা-পলা পরাকে বাধ্যতামূলক মনে না করলেও এখনো এগুলোকে সম্মান করেন। অবশ্য শাঁখা-পলা পরা নিয়ে আদি সনাতন ধর্মে বা বেদ পুরান অনুযায়ী কোনও কট্টর নিষেধাজ্ঞাও নেই, কারণ হিসেবে হিন্দু ধর্মের আচার্যগণ মনে করেন- হিন্দু বা সনাতন ধর্মের মূল দর্শনটিই হল চরম উদারতা এবং নিরপেক্ষতা।

কখন পরানো হয় শাঁখা-পলা

সাধারণত হিন্দু মেয়েদের বিয়ের দিন ভোরে দধি মঙ্গল অনুষ্ঠানের সময় শাঁখা-পলা পরানো হয়। আবার অনেকে বিয়ের আগের দিন কোনো শাঁখার দোকানে গিয়ে শাঁখারীর (যিনি শাঁখা বিক্রি করেন) কাছে শাঁখা-পলা পরেন। শাঁখারীর হাতে শাঁখা-পলা পরাকে শুভ বলে মনে করেন অনেকে।

কেন পরা হয় শাঁখা-পলা

শাঁখা পলা কেন পরা হয় এ নিয়ে নানা মত প্রচলিত আছে। যেমন

১। সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে: অনেকের মতে শাঁখা-পলা গোত্র বা কুলের চিহ্ন। আগেকার দিনের মতো এখনো সনাতন বা হিন্দু ধর্মে গোত্র বা কুল কথাটা প্রচলিত আছে। আগে হিন্দুদের বিবাহ হত এক গোত্র থেকে অন্য গোত্রে। নিজ গোত্রে বিয়ে করা পাপ বলে ধরা হত। মেয়েকে বিয়ের পর অন্য গোত্রে তুলে দেওয়া হত। আজও বিয়েতে কন্যা সম্প্রদান পদ্ধতির মাধ্যমে এই গোত্রান্তর প্রথা বেঁচে আছে। গোত্রান্তরের মাধ্যমে মেয়েকে পিতার গোত্র থেকে স্বামীর গোত্রে সম্প্রদান করা হয়, এর মানে হলো- সে আর তার পিতার গোত্রে নেই। আর সে যে এখন অন্য গোত্রে গেছে সেটা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্যেই চিহ্ন হিসেবে শাঁখা-পলা পরানো হয়। আবার শ্বশুরবাড়ির দিক থেকে মনে করা হতো- হঠাৎ একটা মেয়ে গোত্রে চলে এলে তার দিকে গোত্রের অন্য পুরুষরাও তাকাবে, নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাইবে। তাই নতুন আসা মেয়েটির গায়ে এমন চিহ্ন যোগ করা হোক, যাতে বোঝা যায় সে কারোর অধিকারভুক্ত। অন্য কেউ তার অধিকার আর পাবে না। আর সেই চিহ্ন হিসেবেই শাঁখা-পলা ব্যবহার করা হত।

আবার কেউ কেউ মনে করেন শাঁখা আর পলা পরানোর মাধ্যমে মেয়েটিকে ধির-স্থির, লক্ষ্মীমন্ত হওয়ার শিক্ষা দেওয়া হয়। কারণ শাঁখা আর পলা এমন জিনিস দিয়ে তৈরি যা একটু ধাক্কা লাগলেই ভেঙে যাবে। তাই শাঁখা-পলা রক্ষায় মেয়েটিকে আস্তে ধীরে চলতে হয় আর এই চর্চার মাধ্যমে সে ধির-স্থির হওয়া অভ্যাস করে নেয়। তাই বলা হয় শাঁখা আর পলা আসলে এই স্থিরতা, যত্ন, দায়িত্বপালনের প্রতীক হিসেবে মেয়েদের বিয়ের সময় পরানো হয় যাতে নতুন সংসারে গিয়ে সে তার সব দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারে।

২। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে: ব্রহ্মবৈবর্ত পুরান অনুযায়ী- শঙ্কাসুরের স্ত্রী, সতীনারী তুলসীদেবী ছিলেন ভীষণ পতিব্রতা সেই সাথে পরম বিষ্ণুভক্ত। আর শঙ্কাসুর ছিলো নাস্তিক। তার পাপের ঘড়া পূর্ণ হওয়ার পর ভগবান বিষ্ণু বামন অবতার রূপে তাকে বধ করেন এবং তার অস্থি ভারত মহাসাগরের জলে বিসর্জন দেওয়া হয়। তুলসীদেবী শত চেষ্টা করেও স্বামীকে রক্ষা করতে না পেরে অবশেষে বিষ্ণুর কাছে তাদের দুজনের অমরত্বের প্রার্থনা জানান। ভক্তের কাতর প্রার্থনা ফেরাতে না পেরে বিষ্ণুদেব তুলসীদেবীকে বর দেন যে, তুলসীদেবীর দেহ থেকে তৈরি হবে তুলসী গাছ যা ধর্মীয় প্রতিটি অনুষ্ঠানের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হবে এবং তার স্বামী শঙ্কাসুরের অস্থি থেকে তৈরি হবে নারীর জন্য এক অপূর্ব অলংকার যা তার বিবাহের প্রতীক হিসেবে জ্বলজ্বল করবে অঙ্গে। আর সেই অলংকারই হলো শাঁখা। সেই থেকেই পতিব্রতা নারীরা চিহ্নস্বরূপ শাঁখা পরে আসছে।

** আধ্যাত্মিক কারণ হিসবে বলা হয়- শাঁখার সাদা রং সত্ত্ব গুণ, সিঁদুরের মতো পলার লাল রং রজঃগুণ গুণের প্রতীক। সংসার আগলে রাখতে নারীকে একদিকে যেমন চরিত্রে, মনে সাত্ত্বিক হয়ে উঠতে হয়, তেমনি তাকে রজঃগুণ অর্থাৎ, রাজার গুণ, যথা- কামনা, বাসনার অধীশ্বরীও হয়ে উঠতে হয়।

** শাস্ত্র মতে, প্রাচীন আর্য ঋষিগণ হিন্দুধর্মের প্রতিটি আচারানুষ্ঠানে বৈজ্ঞানিক প্রয়োজনীয়তাকে প্রাধান্য দেওয়ার জন্য নানা রকম আচার অনুষ্ঠানের রীতি বানিয়েছেন। শাঁখা-পলাও তার ব্যতিক্রম নয়। তাদের মতে- মেয়েদের শরীর থেকে প্রতিমাসে ঋতুস্রাবের সাথে বেরিয়ে যায় রক্তের উপাদান আয়রন ও ক্যালসিয়াম। আর শাঁখায় থাকে ক্যালসিয়াম, পলার প্রবালে আয়রন ফলে শাঁখা-পলা নিয়মিত পরিধানে সেই ঘাটতি পূরণ হয়। আরো বলা হয় লাল পলা রক্তকে নির্দেশ করে। যে জায়গায় শাঁখা আর পলা পরা হয় সেই জায়গা দিয়ে সেন্ট্রাল নার্ভ যায় হাতের মধ্যে।

তাই পলা আর শাঁখা এই জায়গায় রক্ত সঞ্চালনের মাত্রা ঠিক রাখে। এনার্জির প্রবাহ বজায় রেখে মানসিক ভারসাম্য ঠিক রাখে। যেহেতু আমাদের শরীরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ নার্ভ হাতের এই অংশের মধ্যে দিয়ে গেছে, যেগুলোর সাথে সরাসরি যোগ রয়েছে আমাদের মস্তিষ্কের, তাই ধরা হয় শাঁখা আর পলা আমাদের মানসিক শান্তি বজায় রাখতে সাহায্য করে।  

৩। জ্যোতিষ শাস্ত্র মতে: জ্যোতিষ শাস্ত্র মতে, শাঁখা বা সাদা রঙের শঙ্খ হল চন্দ্রের প্রতীক। আর পলা বা লাল রঙের প্রবাল হল মঙ্গল গ্রহের প্রতীক। চন্দ্র আমাদের মনকে নিয়ন্ত্রণ করে আর মঙ্গল আমাদের এনার্জি বা শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাই শাঁখা আর পলা পরানোর মাধ্যমে ধরা হয় বিবাহিত জীবনে একজন মেয়ে মন আর শারীরিক শক্তি এই দুই দিক ব্যাল্যান্স করে চলার আগাম শিক্ষা পাবে।

শাঁখা-পলা কিসের তৈরি

শাঁখা- শাঁখা হলো সামুদ্রিক জলজ জীবের খোলশ ‘শঙ্খ’ কেটে তৈরি করা এক ধরনের বলয়াকৃতির সাদা রঙের  চুড়ি। এই শঙ্খ পাওয়া যায় ভারতবর্ষের চেন্নাই এবং শ্রীলঙ্কার সমুদ্রতীরে। শাঁখা ও শঙ্খজাত অলঙ্কার তৈরির জন্য নানা রকমের (নানা নামে) শঙ্খ পাওয়া যায় এবং ব্যবহৃত হয়, যেমন- জয়শঙ্খ, চৌমুক্ষি, তিতকৌড়ি, গৌরি, রামেশ্বরী, ধানছড়ি, সতীলক্ষ্মী, লতাবালা, তিতপুটি, মতি-ছালামত, পাটি, গারবেশি, কাচ্চাম্বর, ধলা, রায়াখাদ, খগা, সুর্কিচোনা, দোয়ানি, জাডকি, ঝাঁজি, কেলাকর, গড়বাকি, সুরতি, দুয়ানাপাটি, আলাবিল প্রভৃতি। এগুলোর মধ্যে তিতকৌড়ি সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মানের, এর থেকে তৈরি শাঁখার দাম সবচেয়ে বেশি এবং আলাবিল সবচেয়ে নিম্ন মানের শঙ্খ।  

পলা- পলা হলো রক্ত প্রবাল থেকে তৈরি লাল রঙের চুড়ি।

শাঁখা-পলার ইতিহাস  

  • * ইংরেজ ঐতিহাসিক এবং লেখক জেমস ওয়াইজের লেখা থেকে জানা যায়- রাজা বল্লাল সেনের সঙ্গে দক্ষিণ ভারত থেকে বাংলাদেশে শাঁখারিরা এসেছিলেন। অর্থাৎ, আজ থেকে প্রায় ৯০০ বছর পূর্বেও ভারতবর্ষে শাঁখার প্রচলন ছিল। 
  • * কিছু ঐতিহাসিকদের মতে, বল্লাল সেনের অনেক আগে থেকেই প্রায় ২,০০০ বছর আগেই দাক্ষিণাত্যে বা দক্ষিণ ভারতে শঙ্খশিল্পের উদ্ভব ঘটে এবং দক্ষিণ ভারতে অলঙ্কার হিসাবে শাঁখার প্রচলন ছিল।
  • * আর এক সূত্রে জানা যায়, খ্রিষ্টপূর্ব পাঁচ হাজার বছর আগে (মহাভারতের যুগেরও পূর্বে) শাঁখার ব্যবহার শুরু হয়েছিল আর শাঁখার সাথে সৌন্দর্য বর্ধক হিসেবে পলাও পরা হতো।

তামিলনাড়ুর প্রাচীন রাজধানী কোরকাই এবং কায়েলের ভগ্নস্তুপ থেকে শঙ্খশিল্পের প্রাচীন নির্দশন আবিষ্কৃত হয়েছে। মাদ্রাজ সরকার কর্তৃক বর্তমানে সেটা ‘সংরক্ষিত শঙ্খশিল্প’।

বাংলাদেশে কোথায় পাওয়া যায় শাঁখা-পলা

বাংলাদেশের প্রায় সব জেলাতেই দশকর্মা বা হিন্দু বিয়ের উপকরণ বিক্রি করে এমন দোকানগুলোতে শাঁখা-পলা পাওয়া যায়। তবে বাংলাদেশের ঢাকার ‘শাঁখারী বাজার’ শাঁখা-পলার জন্য বিখ্যাত। এই জায়গার শাঁখা ব্যবসায়ীরা সরাসরি ভারত থেকে আমদানি করা শাঁখা-পলা বিক্রির পাশাপাশি নিজেরাও শঙ্খ কেটে নানা ডিজাইনের শাঁখা তৈরি করে বিক্রি করেন। ডিজাইনের ভিত্তিতে নানা নামের শাঁখা পাওয়া যায় এখানে। এর মধ্যে সাতকানা, পাঁচদানা, তিনদানা, বাচ্চাদার, সাদাবালা, আউলাকেশী বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ঢাকেশ্বরী মন্দির এবং ঢাকার স্বামীবাগে, লোকনাথ বাবার আশ্রমের পাশের দোকান গুলোতেও শাঁখা-পলা কিনতে পাওয়া যায়। আজকাল অনলাইনেও বেশ কিছু পেইজে শাঁখা-পলা বিক্রি হচ্ছে।

শাঁখা-পলার দাম

শাঁখা- মান এবং ডিজাইনের উপর ভিত্তি করে শাঁখার দাম নির্ধারণ করা হয়। ডিজাইন, মান এবং আকার অনুযায়ী সাধারণ শাঁখা ২০০-৮০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায়। সোনায় বাঁধানোর জন্য যে শাঁখা তার দাম পরে ৮০০- ২০০০ টাকা। আজকাল সিটিগোল্ডে বাঁধানো শাঁখাও কিনতে পাওয়া যায় যেগুলোর দাম ২৫০-১০০০ টাকা।

পলা- সাধারণ পলাগুলো ৫০-১০০ টাকায় পাওয়া যায়। সিটিগোল্ডে বাঁধানো বা গোল্ডপ্লেটেড পলাগুলো ১৫০-১০০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায়। উল্লেখ্য যে, জায়গার ভিত্তিতে দামের সামান্য তারতম্য হতে পারে। 

ভালো শাঁখা চেনার উপায়

শঙ্খের মাঝের অংশ থেকে তৈরি শাঁখা ভালো মানের হয়। ভালো শাঁখার রং উজ্জ্বল সাদা হয়। শাঁখা কেনার সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন শাঁখার কোনো স্থান পোকায় খাওয়া (শাঁখার গায়ে কালো হয়ে থাকা ছোট-বড় ছিদ্র) না হয় যেগুলো মোম দিয়ে ভরাট করা থাকে। কারণ শাঁখা পোকায় খাওয়া স্থান থেকে দ্রুত ক্ষয় হয়ে ভেঙে যায়।  

আরো পড়ুন:

সুস্বাদু ইলিশে রসনাবিলাস-৫ [স্মোকড হোল ইলিশ]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *