তাপস হালদার:
‘নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই’। নিঃশেষে প্রাণ দিয়ে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীরা তৈরি করে গেছেন বেদনাবিধুর গৌরবের ইতিহাস।
১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে স্বাধীনতা যুদ্ধের বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে যখন বাংলাদেশ ঠিক সেই সময়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আল শামস বাহিনীর নরপিশাচরা পরাজয়ের প্রতিশোধ ও বাঙ্গালী জাতিকে মেধাশূন্য করতে সুপরিকল্পিতভাবে ১০ ডিসেম্বর থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা বাংলাদেশের অসংখ্য মেধাবী সন্তানদেরকে হত্যা করে। বিজয় দিবসের পরবর্তী সময়ে মিরপুর, রায়েরবাজারসহ গণকবরগুলোতে অসংখ্য মৃতদেহ শনাক্ত হয়। প্রত্যেকটি মৃতদেহে বীভৎস আকারে নির্যাতনের চিহ্ন পাওয়া যায়।
১৯৭১ সালে অপারেশন সার্চ লাইট শুরু হওয়ার পর থেকেই পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এদেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা শুরু করে। ২৬ মার্চ রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষককে হত্যা করে। পরিকল্পনার সর্বশেষ ছিল ১৪ ডিসেম্বর। এই দিনই সর্বোচ্চ সংখ্যক বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়। যুদ্ধচলাকালীন সময়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী, প্রশিক্ষিত আধা-সামরিক বাহিনী আলবদর এবং আল-শামস বাহিনী সারা দেশের স্বাধীনতাকামীদের তালিকা করে পাকিস্তান গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীকে সরবরাহ করে। সেখানে তারা সারা দেশের প্রায় ২০ হাজার বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা করেছিল। সহায়তায় ছিল জামায়াতে ইসলামী ও এর ছাত্র সংগঠন ছাত্রসংঘ। বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিল ব্রি.জে. আসলাম, ক্যাপ্টেন তারেক, কর্নেল তাজ, ড. সাজ্জাদ হোসেন, ড. মোহর আলী, আলবদরের এবিএম খালেক মজুমদার, আশরাফুজ্জান (প্রধান জল্লাদ) ও চৌধুরী মাইনুদ্দিন (অপারেশন ইনচার্জ)। এদের নেতৃত্ব দিতেন রাও ফরমান আলি। পরবর্তীকালে জানা যায়, তার নেতৃত্বেই ১৪ ডিসেম্বর হত্যাকান্ডটি ঘটে।
স্বাধীনতার পর গভর্ণর হাউজে ফেলে রাখা ফরমান আলীর ডায়েরীর পাতায় যাদের নাম পাওয়া গেছে তাদের প্রত্যেককেই ১৪ তারিখে হত্যা করা হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান অধ্যাপক জি সি দেব, মুনীর চৌধুরী, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, ড. মোফাজ্জেল হায়দার চৌধুরী, রাশেদুল হাসান, ড. আনোয়ারর পাশা, সাংবাদিক সিরাজুদ্দিন হোসেন, শহীদুল্লা কায়সার, নিজামউদ্দীন আহমেদ, গিয়াসউদ্দিন আহমদ, ডা: ফজলে রাব্বী, ডা: আলীম চৌধুরী, সাহিত্যিক সেলিনা পারভীনসহ অনেক মেধাবী সন্তানদেরকে হত্যা করা হয়।
বাংলাপিড়িয়ার তথ্যমতে, শিক্ষাবিদ ৯৯১ জন, সাংবাদিক ১৩ জন, চিকিৎসক ৪৯, আইনজীবী ৪২, অন্যান্য (সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, শিল্পী ও প্রকৌশলী ১৬ জন হত্যাকান্ডের শিকার হন।
পাকিস্তানী শাসকদের দুই যুগের শাসনকালে ক্রমাগত অবিচারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন প্রবলভাবে গড়ে উঠেছিল। এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতেন সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীপেশার বুদ্ধিজীবীরা। তাঁরা সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে বাঙ্গালীদের উদ্বুদ্ধ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। যার কারণে জনগণও নিজেদের দাবি ও অধিকার সমন্ধে সচেতন হয়ে রাজনৈতিক আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। সেজন্যই বু্দ্ধিজীবীরা পাকিস্তানী শাসকদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছেন। এজন্যই বাঙ্গালী শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, আইনজীবী, শিল্পী, দার্শনিকগণকে টার্গেট করে হত্যা করা হয়। বাংলাদেশকে মেধা-মননে পঙ্গু করে দেওয়াই ছিল তাদের মূল পরিকল্পনা। তারা ভেবেছিল বিভিন্ন ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা করা হলে কোনোদিন দেশটি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না।
বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের সাথে এদেশের রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের সক্রিয় ভূমিকা ছিল, তারা বুদ্ধিজীবীদেরকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে হায়েনাদের হাতে তুলে দিয়েছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিজেরাই হত্যা করেছে। জাতির দুর্ভাগ্য এই নরপশুদের অনেকেই স্বাধীন দেশের এমপি, মন্ত্রী হয়েছে।
দীর্ঘদিন হলেও একাত্তরের প্রধান প্রধান ঘাতকদের বিচার হয়েছে, এখনও বিচার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। হত্যাকান্ডে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিল, প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করেছিল, তাদের প্রত্যেককেরই শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সকল ঘাতকের বিচারের মাধ্যমেই জাতি দায়মুক্ত হবে।
বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যায়নি। তাঁদের আত্মত্যাগই ইতিহাসে তাঁদের অমরত্ব দিয়েছে।
লেখক: সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা।
ইমেইল: haldertapas80@gmail.com