জাতীয়

শতবর্ষে শিল্পী কামরুল হাসান

শতবর্ষে শিল্পী কামরুল হাসান

শতবর্ষে শিল্পী কামরুল হাসান: বেঁচে থাকলে শিল্পী কামরুল হাসান আজ শতবর্ষে পা দিতেন। জীবনের পরিধি শতায়ুর মাইলফলক স্পর্শ করতে না পারলেও কোনো কোনো মানুষ তাঁর কাজের ভেতর দিয়ে শত কেন, হাজার বছর পেরিয়ে মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে ওঠেন। বাংলাদেশের আধুনিক শিল্পকলা চর্চার অন্যতম পথিকৃৎ কামরুল হাসান। ১৯২১ সালের ২ ডিসেম্বর ব্রিটিশ ভারতের বর্ধমান জেলার কালনা থানার নারেঙ্গা গ্রামে এই মৃত্যুঞ্জয়ী শিল্পীর জন্ম হয়েছিল।

বাংলাদেশে চারুচর্চা, প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পশিক্ষার উদ্যোগ, জনভোগ্য ব্যবহারিক শিল্প তৈরির চেষ্টাসহ সামগ্রিকভাবে চারুকলায় কামরুল হাসানের নাম অনন্য হয়ে আছে। ১৯৪৮ সালে ‘গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্টস’ প্রতিষ্ঠায় শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের অন্যতম সহযোগী ছিলেন কামরুল হাসান।

বিজ্ঞাপন
দেশভাগের পর কামরুল হাসান সপরিবার ঢাকায় চলে আসেন। এর আগেই উদীয়মান চারুশিল্পী এবং সংস্কৃতি, সাহিত্য, রাজনীতির নানা সাংগঠনিক কাজে সক্রিয় থেকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। কলকাতা সরকারি আর্ট স্কুল থেকে করেন চারুকলায় ডিপ্লোমা। ছাত্র অবস্থাতেই তিনি গুরুসদয় দত্তের ব্রতচারী আন্দোলনে যুক্ত হন। তিনি ‘মিস্টার বেঙ্গল’ পুরস্কারও পেয়েছিলেন। এ ছাড়া শিশু–কিশোরদের সংগঠন মুকুল ফৌজের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। তারপর কলকাতায় মুসলিম চিত্রশিল্পীদের কাজ নিয়ে প্রদর্শনী করেন।

শতবর্ষে শিল্পী কামরুল হাসান
শতবর্ষে শিল্পী কামরুল হাসান

মিল্লাত পত্রিকায় ‘ভিমরুল’ নামে নিয়মিত কার্টুন এঁকে প্রশংসিত হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যোগ দেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ফরোয়ার্ড ব্লকে। মোটাদাগের এসব তথ্যই বলে দেয় যে কামরুল হাসান কেবল জনবিচ্ছিন্ন শিল্পচর্চায় নিজেকে গুটিয়ে রাখেননি। জীবনের শুরু থেকেই শিল্পচর্চার পাশাপাশি সামাজিক ও রাজনৈতিক কাজকর্মেও সমান আগ্রহে প্রবেশ করেছিলেন।

কামরুল হাসানের শিল্পকর্মের সংখ্যা বিপুল। বিদগ্ধ সমালোচকেরা কামরুল হাসানের শিল্প ও জীবনে কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ করেছেন। প্রথমত তাঁর শুদ্ধশিল্প চর্চা। নিজেকে তিনি ‘পটুয়া’ বলে পরিচয় দিতেন। বাংলার পটুয়াদের ঐতিহ্যবাহী রং ও রূপবন্ধে তিনি মুগ্ধ ছিলেন। এর সঙ্গে এসে মিশেছিল ইউরোপের নতুনত্বের নন্দনবোধ। পিকাসোর কিউবিক রীতি আর মাতিসের বর্ণচ্ছটা তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছে। তাঁর ছিল এক নিজস্ব চিত্রভাষা। কামরুল হাসানের চিত্রকলায় নারী, নিসর্গ, প্রাণী নানা আঙ্গিকে ও ব্যঞ্জনায় উঠে এসেছে।

তাঁর জনশিল্পের চর্চাও ছিল। তিনি বইয়ের প্রচ্ছদ, অলংকরণ, সাজসজ্জা থেকে শুরু করে শাড়ির নকশা করতেও এত ভাবেননি। বিসিকের নকশাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে তিনি ঐতিহ্যবাহী জামদানির নকশা সংগ্রহ এবং এর আধুনিকায়নে একাগ্র ছিলেন। বৈশাখী মেলার আয়োজন করে কারুশিল্পকে নাগরিক জনরুচি গড়তে এবং তার প্রসার ঘটাতে চেয়েছেন।

তৃতীয়ত ছিল শিল্পী হিসেবে তাঁর রাজনৈতিক দায়বোধ। তিনি প্রচুর রাজনৈতিক পোস্টার ও কার্টুন করেছেন। তাঁর আঁকা ইয়াহিয়া খানের মুখচ্ছবির কার্টুনটি মুক্তিযুদ্ধের আইকন হয়ে উঠেছে। রাজনীতিতে শিল্পের ভূমিকার এটি এক অনন্য উদাহরণ। মুক্তিযুদ্ধকালে প্রবাসী সরকারের তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ে আর্ট ও ডিজাইন বিভাগের প্রধান হিসেবে বহু অসাধারণ কাজ করেছেন। জাতীয় পতাকার নকশার পূর্ণাঙ্গতা দিয়েছেন তিনি। জাতীয় প্রতীকের ডিজাইন, দেশের সংবিধানের প্রচ্ছদ ও অলংকরণও তাঁর হাতে হয়েছে। বাংলা একাডেমির ফেলো, স্বাধীনতা পুরস্কারসহ বিভিন্ন পদক পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়েছিল তাঁকে।

তাঁকে পাওয়া গেছে রাজপথের সংগ্রামী কর্মীর ভূমিকায়। মহান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে, ষাটের দশকের স্বাধিকার আন্দোলন, চিরগৌরবের মুক্তিযুদ্ধ হয়ে, স্বাধীনতা–পরবর্তী স্বৈরশাসনবিরোধী গণতান্ত্রিক সব সংগ্রামে তিনি ছিলেন সক্রিয়। ১৯৮৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জাতীয় কবিতা পরিষদের উৎসবের সমাপনী দিনে সভাপতির দায়িত্ব পালনকালে তিনি ‘দেশ আজ বিশ্ব বেহায়ার খপ্পরে’ শিরোনামের স্বৈরাচারবিরোধী রেখাচিত্র আঁকার পর আকস্মিকভাবে গত হন মাত্র ৬৭ বছর বয়সে। এমন মৃত্যুর মধ্যে অর্থবহ হয়ে রইল কামরুল হাসানের সারা জীবনের সাধনা।

কর্মসূচি
শিল্পী কামরুল হাসানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্‌যাপন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে গত ২৫ নভেম্বর কলাকেন্দ্র আয়োজিত তাঁর শিল্পকর্মের প্রদর্শনী দিয়ে। ‘সহজিয়া’ নামের এ প্রদর্শনী ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে।

আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের আয়োজনে সকাল সাড়ে নয়টায় শিল্পীর কবরে উপাচার্য মোহাম্মদ আখতারুজ্জামানের নেতৃত্বে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়েছে। এ ছাড়া তাঁর নামে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে চারুশিক্ষার্থীদের জন্য স্থাপন করা একটি কম্পিউটার ল্যাব উদ্বোধন করা হবে। কাল ৩ ডিসেম্বর গ্রাফিকস আর্ট বিভাগের আয়োজনে বেলা ১১টায় হবে আলোচনা সভা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *