মাতৃভূমি

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ এখন মায়ানমারের ওপর চাপ বাড়াতে পারবে: বিশ্লেষকদের অভিমত

নিজস্ব বিশ্লেষণ, ধূমকেতু ডটকম: আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের মতে, মায়ানমার কখনোই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে আন্তরিক ছিল না। নানা সময় বৈঠক করে নানা অজুহাতের মাধ্যমে ফেরানোর প্রক্রিয়াকে পিছিয়ে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক রাজনীতির নানা মেরুকরণও এর একটি বড় কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে। আর মায়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের পর এখন আরও জটিল হলো রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি। তবে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সেনা অভ্যুত্থানের পর এখন মায়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি হবে। সরকার হিসেবে মায়ানমার এখন একটু দুর্বল অবস্থানে থাকবে। এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন নিয়ে মায়ানমারের ওপর চাপ বাড়াতে পারে।

মায়ানমারের নেত্রী অং সান সু চির ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) বেসামরিক সরকার উৎখাত করে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের কারণে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। চলতি সপ্তাহেই দেশটির সঙ্গে শরণার্থী ফেরানোর প্রক্রিয়া নিয়ে বৈঠকের কথা ছিল।

বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ আশা করছে মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা সমুন্নত থাকবে এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি চলমান থাকবে।

এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রনালয়ের পক্ষ থেকে সোমবার বলা হয়, ‘মিয়ানমারের সঙ্গে পারস্পরিক সহযোগিতামূলক সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়ে আমরা অবিচল রয়েছি এবং বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদে এবং স্থায়ীভাবে প্রত্যাবাসনের জন্য কাজ করে যাচ্ছি।’

মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ দৃঢ়ভাবে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও তার বিকাশে বিশ্বাসী উল্লেখ করে, মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং সাংবিধানিক ব্যবস্থা সমুন্নত থাকবে বলে আশা ব্যক্ত করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। নিকটতম ও বন্ধুপ্রতীম প্রতিবেশী হিসেবে মিয়ানমারে শান্তি ও স্থিতিশীলতা দেখতে চায় বাংলাদেশ। এই সমস্যা নিয়ে সর্বশেষ কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হয়েছে। প্রক্রিয়ায় সহায়তা করতে ভারতকে অনুরোধ করেছে বাংলাদেশ। সব পক্ষ থেকেই ইতিবাচক আশ্বাস পেলেও ইতিবাচক ফল পাওয়া যায়নি আজ পর্যন্ত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন মনে করেন, রোহিঙ্গা শরণার্থীদেরে ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের ওপর যে চাপ প্রয়োগ করা দরকার ছিল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আগে তা করেনি। বরঞ্চ বড় কয়েকটি শক্তি তাদের সমর্থন করে গেছেন। ”এখন মিয়ানমার নিজেরাই বাংলাদেশের জন্য নতুন ফ্রন্ট খুলে দিয়েছে।

সামরিক সরকার তাদের লেজিটিমেসি ক্রাইসিসের জন্য অনেকটাই দুর্বল থাকবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ যদি কুটনৈতিকভাবে সাফল্যের পরিচয় দিতে পারে তাতে রোহিঙ্গাদের ফেরাতে প্রচন্ড চাপ তৈরি সম্ভব।”

সাবেক পররাষ্ট্রসচিব তৌহিদ হোসেন মনে করেন, ফেরানোর প্রক্রিয়া নিয়ে যে বৈঠক হওয়ার কথা ছিল সেটা হবে কি না তা জানতে হয়তো কয়েকদিন অপেক্ষা করতে হবে। ”মায়ানমারে অং সান সুচির নেতৃত্বে এনলডির যে সরকার ছিল তারা কি সেনাবাহিনীকে এড়িয়ে পররাষ্ট্রবিষয়ক স্বতন্ত্রভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারত? সুতরাং দুই সরকারের মধ্যে গুণগত কোনো পার্থক্য নেই।”

“এই পরিস্থিতিতে আমাদের আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দিকেই নজর রাখতে হবে। তাদের মাধ্যমেই মায়ানমার সরকারের ওপর চাপ তৈরির চেষ্টা করতে হবে।”

আরেক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ মনে করেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তরাষ্ট্রীয় আলোচনা চলছে। শাসকের রদবদলে এর হেরফের হওয়ার কথা না। তাদের সঙ্গে লিখিত চুক্তিতে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার বিষয় উল্লেখ ছিল। তিনি বলেন ”আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া দেখে বোঝাই যাচ্ছে, এখন মিয়ানমারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের সুযোগ তৈরি হয়েছে।

এমনটা হলে বাংলাদেশের সেই সুযোগ নেওয়া উচিত। আর এই নিষেধাজ্ঞার শর্তের মধ্যে যেন রোহিঙ্গাদের বিষয়টি থাকে, সে বিষয়ে তৎপর থাকতে হবে।”

তিনি আরও বলেন, মিয়ানমারের এক বছরের জরুরি অবস্থার মধ্যে আমাদের বসে থাকলে চলবে না। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ আগে যে অবস্থান নিয়েছিল, সেখান থেকে এক চুলও সরে আসার কোনো সুযোগ নেই। এখন বিশ্ব সম্প্রদায়কে বাংলাদেশের অবস্থান আরও জোরালোভাবে বলার সুযোগ এসেছে।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইনে সেনা অভিযান শুরুর পর কয়েক মাসের মধ্যে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। আগে থেকে বাংলাদেশে ছিল আরও চার লাখ রোহিঙ্গা। আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে মায়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে ২০১৭ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করলেও সেই প্রত্যাবাসন আজও শুরু হয়নি।

২০১৯ সালে দুই দফা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও রাখাইন রাজ্যের নিরাপত্তা পরিবেশ নিয়ে শঙ্কার কথা তুলে ধরে ফিরতে রাজি হয়নি রোহিঙ্গারা। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে ইতিমধ্যে ৮ লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা মায়ানমারের কাছে হস্তান্তর করেছে বাংলাদেশ; যার মধ্যে মাত্র ৪২ হাজার জনকে ভেরিফিকেশন করার কথা জানিয়েছে মায়ানমার।

এরই ধারাবাহিকতায় জানুয়ারিতে চীনের আয়োজনে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে নিয়ে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হয়। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশ মায়ানমারের মধ্যে বৈঠক হওয়ার কথা ছিল।

এর আগে গত রোববার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন বলেছিলেন, ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে পূর্ব নির্ধারিত আলোচনার মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করতে মায়ানমার ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা কিছু ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। আমরা তাদের (মায়ানমার) বলেছি আপনাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নেয়ার একটি সুযোগ রয়েছে।’

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তারা প্রত্যাবাসন শুরু করার জন্য একটি তালিকা দিয়েছে এবং বাংলাদেশ তাদের শুরু করতে বলেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *