নিজস্ব প্রতিবেদক, ধূমকেতু ডটকম: প্রাণ বাঁচাতে মিয়ানমারের রাখাইন থেকে পালিয়ে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আসার চার বছর পূর্ণ হলো। কবে তারা আদি নিবাসে ফিরতে পারবেন, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েই গেছে। এ অবস্থায় কক্সবাজারের শিবিরের ওপর চাপ কমাতে গত বছর ৪ ডিসেম্বর থেকে নোয়াখালীর হাতিয়ার ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর শুরু হয়। ভাসানচরে স্থানান্তর নিয়ে প্রথম থেকেই জাতিসংঘের আপত্তি ছিল। ফলে অনিশ্চয়তায় ছিল জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা। অবশেষে ভাসানচরে সহায়তা দিতে রাজি হয়েছে জাতিসংঘ। দূর হয়ে গেছে সব মতভেদ।
সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে ভাসানচরে কাজ শুরু করতে যাচ্ছে সংস্থাটি। সামনের সপ্তাহে এ নিয়ে চুক্তি হবে। ভাসানচরে এখন পর্যন্ত ১৮ হাজার ৮৯০ জন রোহিঙ্গাকে স্থানান্তর করা হয়েছে। আর এ পর্যন্ত জন্ম নিয়েছে ২৬০ শিশু। সরকার এক লাখ রোহিঙ্গাকে সেখানে স্থানান্তর করতে চায়। করোনার ঊর্ধ্বগতি ও বর্ষার কারণে এখন বাকি রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর আটকে আছে। সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে আবার ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর শুরু হবে।
পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন জানান, আগামী সপ্তাহেই জাতিসংঘ ও বাংলাদেশের মধ্যে চুক্তি সই হবে। চুক্তির পর সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে কার্যক্রম শুরু করবে সংস্থাটি।
এ ছাড়া রোহিঙ্গা ও স্থানীয়দের জন্য জাপানের কাছ থেকে করোনার টিকা চাওয়া হয়েছে বলে জানান সচিব।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেন, শুরুতে আপত্তি থাকলেও ভাসানচর এখন বিশ্বজুড়ে বাস্তুচ্যুত মানুষের আবাসনের সেরা উদাহরণ। এত টাকা ব্যয় করে শরণার্থীদের জন্য এত ভালো ব্যবস্থা আমার মনে হয় না, পৃথিবীর কোনো দেশে হয়েছে! ভাসানচরে যারা থাকছেন তারা বাড়তি সুবিধা পাচ্ছেন। তাদের জীবনযাত্রা কক্সবাজারের চেয়ে অনেক উন্নত।
কক্সবাজারের শরণার্থী শিবির ও তার বাইরে অবস্থান নিয়ে থাকা প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে নিয়ে নানা সামাজিক সমস্যা সৃষ্টির প্রেক্ষাপটে তাদের একটি অংশকে সাময়িকভাবে স্থানান্তরের পরিকল্পনা নেয় সরকার। সে জন্য নোয়াখালীর হাতিয়ার কাছে মেঘনা মোহনার ভাসানচরকে মানুষের বসবাসের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত করা হয়। এক লাখ মানুষকে অধিকতর নিরাপদ এই আশ্রয়ে সরিয়ে আনতে ২৩১২ কোটি টাকা ব্যয় করেছে বাংলাদেশ সরকার। ভাসানচরের নতুন ঠিকানায় প্রতিটি রোহিঙ্গা পরিবার নিজেদের জন্য আলাদা ঘর পেয়েছে। আছে রান্নার ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ, পানি আর পয়ঃনিস্কাশন সুবিধা। সেই সঙ্গে আছে খেলার মাঠ, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র, এমনকি জীবিকা নির্বাহের সুযোগ।
মালয়েশিয়া যেতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসা তিন শতাধিক রোহিঙ্গাকে সমুদ্র থেকে উদ্ধার করে আগেই ভাসানচরে নিয়ে রাখা হয়েছিল। এর পর গত বছর ৫ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের শরণার্থী ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গাদের একটি প্রতিনিধি দলকে দেখার জন্য ভাসানচরে পাঠানো হয়। তারা ফেরার পর তাদের কথা শুনে রোহিঙ্গাদের একাংশ ভাসানচরে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করে। ভাসানচরে ১২০টি ক্লাস্টার বা গুচ্ছগ্রামের সমন্বয়ে তৈরি করা হয়েছে লক্ষাধিক রোহিঙ্গার থাকার জায়গা। প্রতিটি ক্লাস্টারে রয়েছে ১২টি হাউস। পাকা দেয়ালের ওপর টিনের শেডের প্রতিটি হাউসে রয়েছে ১৬টি কক্ষ। প্রতিটি কক্ষে চারজনের একটি পরিবারের থাকার ব্যবস্থা। ১৩ হাজার একর আয়তনের এই চরে ১৭০২ একর জমির চারপাশে উঁচু বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাসের ঝুঁকি থেকে রক্ষার জন্য। এর ভেতরেই রোহিঙ্গাদের আবাসন ও অন্যান্য স্থাপনার জন্য ৪৩২ একর এবং ভবিষ্যতে প্রকল্পের সম্প্রসারণ ও বনায়ন কাজে ৯১৮ একর এলাকা রাখা হয়েছে।
রোহিঙ্গাদের থাকার প্রতিটি ক্লাস্টারের জন্য রয়েছে একটি চারতলা আশ্রয়কেন্দ্র। এটি ঘণ্টায় ২৬০ কিলোমিটার গতিবেগের ঘুর্ণিঝড়েও টিকে থাকতে সক্ষম। আপাতত ২২টি এনজিওর মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের খাবার, স্বাস্থ্যসেবা ও অন্যান্য প্রয়োজন মেটানো হচ্ছে। শিশুদের জন্য দুটি খেলার মাঠ তৈরি করা হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবার জন্য করা হয়েছে ২০ শয্যার দুটি হাসপাতাল এবং চারটি কমিউনিটি ক্লিনিক। নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে প্রকল্প এলাকায় পরীক্ষামূলক করা হয়েছে হাঁস-মুরগি, কবুতর, মাছ এবং ফল-ফসলের খামার। স্থানীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়াতে দুগ্ধ খামার, ধান ও সবজি চাষ, হস্তশিল্প, নারীদের জন্য সেলাইয়ের কাজ এবং পর্যটন প্রকল্পও হাতে নেওয়া হয়েছে।
ভাসানচর ৫৩ ক্লাস্টারের বাসিন্দা নুরুল ইসলাম জানান, ভাসানচর দেখতে আধুনিক শহরের মতো। এখানে পাহাড়ধসের চিন্তা নেই।
ভাসানচরের একটি গুচ্ছগ্রামের সমন্বয়ক রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ জুবাইর জানান, কক্সবাজারের শিবিরগুলোতে ঘিঞ্জি পরিবেশ; বর্ষায় পাহাড়ধস, বন্যা হয়। এ ছাড়া আছে মাদক ও অপহরণের ঘটনা। কিন্তু ভাসানচরে এসব ঝামেলা নেই।
তবে বাংলাদেশ এখনও রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়াকেই সমাধান মনে করে। সে লক্ষ্যেই কাজ চলছে বলে জানান শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (অতিরিক্ত সচিব) শাহ রেজওয়ান হায়াত। তিনি বলেন, ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের পাঠানোকে প্রাথমিক সাফল্য মনে করছি। চূড়ান্ত সাফল্য তখনই, যখন তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হবে।
তিনি বলেন, কক্সবাজার থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে নিয়ে যাওয়া হবে। তবে ভাসানচরে তাদের স্থায়ীভাবে নেওয়া হচ্ছে না। যখন প্রত্যাবাসন শুরু হবে, তখন তাদের মিয়ানমার পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
আগামী সেপ্টেম্ব্বরের শেষদিকে আবার ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর শুরু হবে বলে জানান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ সচিব মো. মোহসীন। তিনি বলেন, আমাদের মূল উদ্দেশ্য, এসব মানুষকে তাদের দেশ মানসম্মতভাবে ফেরত নেবে- সে লক্ষ্যে কাজ চলছে। যেহেতু এটা একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া, তাই আপাতত এ ব্যবস্থা।
২৫ আগস্ট দিনটিকে রোহিঙ্গারা ‘কালো দিবস’ হিসেবে পালন করে। তবে করোনা পরিস্থিতির কারণে এবার কক্সবাজারে কোনো কর্মসূচি নেই বলে জানিয়েছেন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইচ) নেতা সৈয়দ উল্লাহ।