খাদ্য-পুষ্টি

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে হলুদের তুলনা নেই

নিজস্ব প্রতিবেদক, ধূমকেতু ডটকম: হলুদ ছাড়া মাছের ঝোল রাঁধা কঠিন। ডালেও হলুদ না দিলে নয়। পোস্ত, শুক্তোর মতো দু’একটা নিরামিষ রান্না ছাড়া অন্য তরি-তরকারিতে হলুদ দেওয়াটা আমাদের অভ্যাস। শুধু এই অভ্যাস যে স্বাস্থ্যের পক্ষে কতটা উপকারী, সেটাই অজানা।

হলুদের মধ্যে রয়েছে ‘কারকিউমিন’ নামে এক উপাদান, যা একাই একশোর বেশি রোগ সারাতে পারে। হাজারেরও বেশি বছর ধরে এশিয়ায় হলুদের ব্যবহার শুধু মশলা হিসেবে নয়, ওষধি হিসেবেও। ভিটামিন ই বা ভিটামিন সি-র তুলনায় পাঁচ থেকে আট গুণ বেশি কার্যকরী অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট কারকিউমিন শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। চলুন জেনে নিই নানা গুণে গুণান্বিত এই হলুদের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য উপকারিতা সম্পর্কে।

আরও পড়ুন: কাঁচা মরিচ রক্ত জমাট বাধার ঝুঁকি কমায়

১. কাঁচা হলুদ খাদ্য পরিপাকে
কাঁচা হলুদের মধ্যে গ্যাস্ট্রো-প্রটেক্টিভ কিছু গুণ থাকে যা খাবার পরিপাকে সাহায্য করে। ফলে হজমের গোলমাল, গ্যাসের সমস্যার ক্ষেত্রে কাঁচা হলুদ খুবই উপকার দেয়।

২. খাদ্য সংক্রমণ থেকে বাঁচতে
হলুদে থাকা কারকিউমিনের অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি ও অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট উপাদান থাকায় তা বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ থেকে খাদ্যনালীকে বাঁচায়। আমরা রোজ যে খাবার খাই, তার মধ্যে অনেকসময়ই নানা জীবাণু থেকে যেতে পারে। খাবারে কাঁচা হলুদ বা হলুদ গুঁড়ো ব্যবহার করলে তা খাদ্যনালীকে ক্ষতিকারক জীবাণুর সংক্রমণ থেকে বাঁচায় ও খাদ্যনালীর প্রদাহের সম্ভাবনা কমায়।

৩. কাঁচা হলুদ হাড় জোড়া লাগাতে
বহু প্রাচীনকাল থেকেই কাঁচা হলুদকে হাড়ের নানারকম রোগ সারানোর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। হাত বা পা মচকে গেলে চুন-হলুদ লাগানোর কথা তো আমরা সবাই জানি। এছাড়া কাঁচা হলুদ বেটে ভাঙ্গা হাড়ের জায়গায় লাগালে তা উপকার দেয়। দুধে কাঁচা হলুদ দিয়ে খেলেও তা এক্ষেত্রে উপকার দেয়। হলুদের অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি গুণ ব্যথা, প্রদাহকে কমায় এবং হাড়ের টিস্যুগুলিকে রক্ষা করে ও ভাঙ্গা হাড় জোড়া লাগাতে সাহায্য করে।

৪. হাড়ের ক্ষয় রোধে
কাঁচা হলুদে থাকা কারকিউমিন হাড়ের ক্ষয় ও হাড়ের গঠনের মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রাখে ও হাড়কে সুস্থ ও মজবুত রাখে। মেনোপজের সময় মহিলাদের যে হাড়ের ক্ষয় হয়, তা থেকেও কাঁচা হলুদ আমাদের বাঁচায়।

৫. ট্রমাটিক ডিসঅর্ডার কমাতে
ট্রমাটিক ডিসঅর্ডারের ক্ষেত্রে যেসমস্ত খারাপ, ভীতিজনক স্মৃতি থাকে, হলুদে থাকা কারকিউমিন তা কমাতে সাহায্য করে। এছাড়া কাঁচা হলুদের অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি গুণ স্ট্রেস বা চাপ, উদ্বেগ থেকে আমাদের মুক্তি দেয়।

৬. কাঁচা হলুদ ডায়াবেটিসে
হলুদ ও হলুদে থাকা কারকিউমিন অ্যান্টি-ডায়াবেটিক এজেন্ট হিসেবে কাজ করে ও রক্তে শর্করার মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। এছাড়া কাঁচা হলুদ ইনসুলিন হরমোনের ক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে ও অগ্ন্যাশয়কে সুস্থ রাখে।

৭. ত্বকের বয়স কমাতে
কাঁচা হলুদ বহু প্রাচীনকাল থেকেই ত্বকের ঔজ্জ্বল্য রক্ষা করতে ও ত্বকের বয়স কমায়। তাই বিভিন্ন ক্রিমের প্রয়োজনীয় উপাদান হিসেবে হলুদ ব্যবহার করা হয়। ত্বকের বিভিন্ন দাগ, রিঙ্কল ও সান ট্যান থেকে ত্বককে রক্ষা করার জন্য কাঁচা হলুদের পেস্ট ঘরেই তৈরি করে মুখে লাগানো যেতে পারে। হলুদে থাকা কারকিউমিনের অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট গুণ ত্বককে বয়সের ছাপ থেকে বাঁচায়।

৮. ক্যান্সার দূর করতে
কাঁচা হলুদে থাকা কারকিউমিন ক্যান্সার দূর করতে সহায়তা করে। কারকিউমিন ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি বন্ধ করে তাদের মৃত্যু ঘটায়। ফলে ক্যান্সারের সম্ভাবনা হ্রাস পায়। বিভিন্ন স্টাডি থেকে জানা গেছে, প্রায় ৫৬ রকম ক্যান্সারের সম্ভাবনা কাঁচা হলুদ রোজ নিয়মিত খেলে কমে যায়।

৯. কাঁচা হলুদ আরথ্রাইটিসের হাত থেকে বাঁচতে
হলুদে থাকা কারকিউমিন নানাভাবে আরথ্রাইটিসের হাত থেকে আমাদের বাঁচায়। কাঁচা হলুদ অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি এজেন্ট হিসেবে কাজ করে ও তা হাড়ের কোষকে রক্ষা করে। ফলে যারা রিউম্যাটয়েড আরথ্রাইটিসে ভোগেন, দেখা গেছে সাধারণ ফিজিওথেরাপির থেকে তারা যদি নিয়ম করে কাঁচা হলুদ খান, তাহলে তা ব্যথা কমায় ও হাড়ের জয়েন্টের মুভমেন্টে অনেক সাহায্য করে।

১০. কাঁচা হলুদ মনমরা ভাব কাটাতে
কাঁচা হলুদের অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট গুণ আমাদের বিষণ্ণ মনমরা ভাব, বদমেজাজ, ডিপ্রেশন কাটিয়ে মনকে চনমনে করে তুলতে সাহায্য করে।

১১. কাঁচা হলুদ স্ট্রোকের পরে
নিয়ম করে কাঁচা হলুদ খাওয়া আমাদের স্ট্রোকের সম্ভাবনাকে এক ধাক্কায় অনেকটা কমিয়ে দিতে পারে। এছাড়া কাঁচা হলুদের অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট ও অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি গুণ স্ট্রোকের পরবর্তী চিকিৎসাতেও অনেক উপকার দেয়। কাঁচা হলুদ হার্টকেও বিভিন্ন ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে। এছাড়া অপারেশনের পরে যে হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা থাকে, তাকেও কাঁচা হলুদ কমাতে সাহায্য করে।

১২. দাঁতের ক্ষয় রোধ করতে
কাঁচা হলুদ দাঁতের ওপরে থাকা এনামেলের আস্তরণকে রক্ষা করে ও দাঁতের ক্ষয় থেকে দাঁতকে বাঁচায়। হলুদের অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল গুণাবলী থাকায় তা জীবাণুকে থেকেও দাঁতকে রক্ষা করে। তাই অনেকসময় বিভিন্ন টুথপেস্টে হলুদকে আবশ্যকীয় উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এছাড়া মাড়ি থেকে রক্ত পড়া কমাতে ও মুখের ভেতরে ক্ষত সারাতে কাঁচা হলুদ নিয়ম করে খাওয়া যেতে পারে।

হলুদের শুধু উপকারী দিক না বরং অপকারী দিকও রয়েছে। যে কোনো উপাদান তুলনার দিক থেকে বেশি ব্যবহার করলে সেই উপাদানের গুণাগুণ মানও কমে যায়।

আসুন জেনে নিই হলুদের অপকারিতাঃ
 
১। অনেক ক্ষেত্রে বলা হয়ে থাকে, নিয়মিত কয়েক টেবিল চামচ হলুদ খাওয়ার জন্যে। তবে এইভাবে নিয়মিত দীর্ঘদীন হলুদ খেলে পেটে সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই অতিরিক্ত হলুদ ব্যবহার করা যাবে না। এবং বয়স্ক ও শিশুদের ক্ষেত্রে বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে।

২। বর্তমানে বিভিন্ন ধরণের রোগের মধ্যে এলার্জি রোগটা বেশি দেখা দেয়। সাধারণত আমাদের দৈনন্দিন খাবারের ফলে এই সমস্যা দেখা দেয়। ডিম, মাছ, বেগুন ইত্যাদি খাবারে অনেকের এলার্জির সমস্যা দেখা দেয়। তবে অতিরিক্ত মাত্রার হলুদেও এলার্জি সমস্যা দেখা দেয়।

৩। বেশি হলুদ খাওয়ার অভ্যাস করলে ওষুধের সাথে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া করবে এবং ওষুধের কাজে বাধা প্রদান করবে। যেমন ওয়ারফারিন, স্টেরয়েড, অ্যাসপিরিন এগুলো হলুদের সাথে ক্রিয়া করে কাজে বাধা দেয়।

৪। পেট খারাপ: অনেকে বলেন প্রতি দিন কয়েক টেবল-চামচ হলুদ খাওয়া উচিত। কিন্তু, দীর্ঘ দিন বেশি পরিমাণে হলুদ খেলে ডায়রিয়া, বমি বমি ভাব বা ঘাম (সবার ক্ষেত্রে নয়) হতে পারে।

৫। জরায়ুর উদ্দীপনা: হলুদ ইউটেরাইন স্টিমুল্যান্ট হিসাবে কাজ করে যা মেন্সট্রুয়াল ফ্লো-কে উৎসাহিত করে। তাই গর্ভবতী ও সদ্য মায়েদের হলুদ কম খাওয়াই ভাল।

৬। রক্তক্ষরণ: রক্ত জমাট বাঁধতে দেয় না হলুদ। তাই অ্যান্টিকোয়াগুল্যান্ট ও অ্যান্টিপ্লাটিলেট ওষুধ খেলে হলুদ এড়িয়ে চলা ভাল।

৭। কেমোথেরাপি: বেশি হলুদে কেমোথেরাপি বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই যারা কেমোথেরাপি নিচ্ছেন, তাদের হলুদ বেশি না খাওয়াই ভাল।

৮। অ্যালার্জি: সাধারণত ডিম, বেগুন, চিংড়ি মাছেই বেশির ভাগ মানুষের অ্যালার্জি থাকে। কিন্তু অনেকের হলুদেও অ্যালার্জি হয়।

৯। হাইপোগ্লাইসেমিয়া: হলুদে ডায়াবেটিক আক্রান্তদের ব্লাড সুগারের মাত্রা হঠাৎ করে কমে যেতে পারে। যাদের ডায়াবেটিস নেই, তাদের ক্ষেত্রে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্ট প্রতিরোধ করার সম্ভাবনা থাকে।

১০। কিডনিতে পাথর: হলুদ অনেক সময় অক্সালেটরের বিপাক পরিবর্তিত করে দেয়। তখন ওই অক্সালেট কিডনিতে পাথর তৈরি করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *