জীবন ও পরিবার

রাখাইনদের প্রধান উৎসব ‘সাংগ্রেং পোয়ে’ বা পানি খেলা

বাংলাদেশে বসবাসরত ৪৫টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জীবনযাপনে যেমন রয়েছে বৈচিত্র্য, তেমনি রয়েছে স্বকীয়তা। তাদের উৎসব, ধর্ম, শিক্ষা, ভাষা প্রভৃতি নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখছেন ধূমকেতু ডটকম-এর বিশেষ প্রতিবেদক নিখিল মানখিন। প্রকাশিত হচ্ছে প্রতি শনিবার। আজ প্রকাশিত হলো [১১তম পর্ব]। চোখ রাখুন ধূমকেতু ডটকম-এ।

নিখিল মানখিন, ধূমকেতু বাংলা: বাংলাদেশে বসবাসরত ৪৫টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে একটি হলো রাখাইন। তারা একটি স্বতন্ত্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, যাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যগত পরিচয় রয়েছে এবং যা অন্যদের হতে তাদের পৃথক করে। কক্সবাজার ও পটুয়াখালীসহ দেশের কয়েকটি জেলায় তাদের বসবাস। তাদের সমাজ ব্যবস্থা পিতৃতান্ত্রিক হলেও নারীদের অনেক মর্যাদা রয়েছে। তারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। তাদের প্রধান সামাজিক উৎসব হলো ‘সাংগ্রেং পোয়ে’ বা পানি খেলা।

বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং ধূমকেতু ডটকমকে বলেন, বাংলাদেশের রাখাইন সম্প্রদায়ের  অবস্থা ভালো না। তারা আজ নানা জটিল সমস্যায় জর্জরিত। তারা স্বকীয় সংস্কৃতি ও ভাষার উত্তরাধিকার নিয়ে বাংলাদেশে বসতি গড়ে তোলে। বাঙালি সংস্কৃতির প্রভাব, শিক্ষা, শিল্পায়ন ও নগরায়ন, সেটেলাইট ও উন্নত তথ্য প্রযুক্তির প্রভাব ইত্যাদি কারণে তাদের ব্যবহারিক ও দৈনন্দিন জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে। যার ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব কেবল তাদের সংস্কৃতির উপর পড়ছে না, অধিকন্তু তাদের জীবন-জীবিকার উপরও প্রভাব ফেলছে। জীবন ও জীবিকার ধরনও পাল্টে যাচ্ছে। শহরমুখী রাখাইনদের সংখ্যা অনেকগুণ বেড়েছে।

বসবাস:

রাখাইনরা বাংলাদেশের  কক্সবাজার, পটুয়াখালী, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, বরগুনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বাস করে। কক্সবাজার জেলার খুরুশকুল, চৌফলদন্ডী, বারুয়াখালী, রামু থানার ফতেখাঁরকুল, পানেরছড়া, ঈদগড় বৈদ্যপাড়া, টেকনাফ থানার সদর এলাকা ছাড়াও খারাংখালী, চৌধুরীপাড়া, মহেশখালীর গোরকঘাটা, ছোট মহেশখালী, মুদির ছড়া, বুলিসং, চকরিয়া হারবাং, ঘোনা, মানিকপুর, পেকুয়ার বারবাকিয়া ইত্যাদি এলাকায় রাখাইনরা বাস করে। এছাড়া জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে বসবাস শুরু করেছে।

জীবন ও জীবিকা:

রাখাইন কমিউনিটি অব বাংলাদেশের আহ্বায়ক ক্যাঞিং ধূমকেতু বাংলাকে বলেন, রাখাইনদের অর্থনৈতিক অবকাঠামো স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্টমণ্ডিত। সামগ্রিকভাবে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর চেয়ে পিছিয়ে থাকলেও প্রতিকূল পরিবেশেও নিজেদেরকে স্বাবলম্বী হিসেবে গড়ে তোলা এবং অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তাদের সংগ্রামী মনোভাব প্রশংসার দাবি রাখে। গ্রামাঞ্চলে রাখাইদের অস্তিত্বের প্রথম ও প্রধান শর্ত হলো ভূমি, যা তাদের অর্থনীতি নির্ধারণ করছে। কিন্তু বিত্তবান ও ভূমি খেকোদের প্রবল গ্রাসে তাদের জমি বেদখল হয়ে যাচ্ছে।

রাখাইনদের ঐতিহ্যগত পেশাগুলোয় দৃষ্টি দিলে অর্থনৈতিক সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। কক্সবাজারের গ্রামাঞ্চলে তাদের মধ্যে ৩৩ শতাংশের বেশি পরিবার ভূমিহীন এবং প্রান্তিক কৃষক ২০ শতাংশ। তাদের সমাজে প্রায় সব ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে মহিলাদের অংশগ্রহণ রয়েছে। তাঁত বোনা, বার্মিজ পণ্যসামগ্রী বিক্রি, শুটকি প্রক্রিয়াজতকরণ ও ‘নাপ্পি’ তৈরি ইত্যাদি পণ্যকেন্দ্রিক নারী উদ্যোক্তা সৃষ্টি হয়েছে রাখাইন সমাজে। রাখাইন নারীদের বড় অংশ সেলস গার্ল হিসেবে কাজ করে। জীবিকার মূল ভিত্তি কৃষি হলেও ব্যবসা ও চাকরিতে প্রবেশ করছে অনেক রাখাইন। স্কুল ও কলেজগামী ছেলেমেয়ের সংখ্যাও বেড়েছে।

সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসব:

রাখাইন অধিকার আন্দোলন কর্মী মংম্যায়া ধূমকেতু বাংলাকে বলেন, রাখাইন সম্প্রদায় ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দিপনার মধ্য দিয়ে তাদের ধর্মীয় ও বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। রাখাইনদের সামাজিক জীবন বৌদ্ধ ধর্মের ভিত্তির উপরেই প্রতিষ্ঠিত। সে মতে তারা বৌদ্ধ ধর্মের সব ক’টা অনুষ্ঠান পালন করে।

‘কাছং ইয়াংরী ছিয়াম’ নামক অনুষ্ঠানটি হয় বৈশাখ মাসের পূর্ণ চন্দ্র দিবসে। বৌদ্ধদের নিকট এই দিনটি অত্যন্ত পবিত্র। এর পর রয়েছে আষাঢ়ী পূর্ণিমা ও আশ্বিণী পূর্ণিমা। কার্যতঃ চৈত্র সংক্রান্তি চৈত্রের শেষ দিবস এবং বৈশাখের প্রথম দিবস রাখাইনদের খুবই আনন্দের দিন। তাদের ‘ওয়াগেপোয়ে’ নামে আরেকটি পূঁজা হয়ে থাকে প্রতি বৎসর নভেম্বর মাসে। তবে রাখাইনদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান সাংগ্রেং বা পানি খেলা। প্রতি বৎসর নববর্ষ উপলক্ষ্যে তারা আয়োজন করে থাকে তাদের বৃহত্তম সামাজিক উৎসব সাংগ্রেং বা পানি খেলা।

মঘী সনের প্রথম মাসের নাম টেঙ্খু। টেঙ্খুর প্রথম দিন থেকে তিন দিনব্যাপী নারী-পুরুষ বিশেষ করে কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীরা মেতে উঠে অনাবিল এক আনন্দ উৎসবে। মঘী বৎসরের শেষ মাসের নাম তাবং। তাবং কবে শেষ হবে টেঙ্খু কবে আসবে তাই নিয়ে উদগ্রীব থাকে রাখাইন সম্প্রদায়ের লোকজন।

রাখাইন কিশোর-কিশোরী ও যুবক-যুবতীদের শান্তির বর্ণির্ল শোভাযাত্রার মাধ্যমে এবং বৌদ্ধ মূর্তিকে পবিত্র সুগন্ধি পানি দিয়ে গোসল করানোর পর শুভ সূচনা হয় সাংগ্রেং অনুষ্ঠানের। সাংগ্রেং উপলক্ষে রাখাইন অধ্যুষিত এলাকায় নির্মাণ করা হয় মন্ডপ বা প্যান্ডেল। মন্ডপগুলো রকমারি ফুল, বাহারি পাতা, রঙিন কাগজ এবং বর্ণিল বেলুনে সুসজ্জিত করে তোলা হয়। মন্ডপের পাশে রাখা হয় পানি ভর্তি ড্রাম।

রাখাইন তরুণী এবং যুবতীরা ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে সেজেগুজে পানির ‘মগ’ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। অপর দিকে রাখাইন তরুণ এবং যুবকরাও নতুন পোশাক পরে দল বেঁধে মন্ডপে আসে এবং অপেক্ষমান মেয়েদের দিকে পানি ছুঁড়ে মারে। মেয়েরাও ছেলেদের দিকে পানি ছুঁড়ে জবাব দেয়। এই পানি ছুড়াছুড়ির মধ্যে চলতে থাকে নানা রকম গান-বাজনা ও নাচ। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলতে থাকে পানি খেলা। কেউ কেউ এই উৎসবকে পাত্র-পাত্রী কিংবা জীবনসঙ্গী নির্বাচনের উপলক্ষ বলে ধারণা করে থাকেন। প্রবীণরা যদিও সরাসরি পানি খেলায় অংশগ্রহণ করেন না, তবে তারা যুবক-যুবতীদের সহায়তা করে থাকেন।

সাংগ্রেং পোয়ে উপলক্ষ্যে বর্ণিল রূপে সাজে রাখাইন পল্লীগুলো। প্রতিটি মহল্লায় সামিয়ানা টাঙ্গিয়ে নেচে গেয়ে উৎসবে মেতে উঠে রাখাইন আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা। জমকালো এ আয়োজনে যোগ দেয় অন্যান্য আদিবাসী, স্থানীয় অধিবাসী ও পর্যটকরা। প্রায় সপ্তাহ জুড়ে অনুষ্ঠানমালা থাকলেও সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্ব তিন দিনের এই ‘জলকেলি’ উৎসব।

পোশাক-পরিচ্ছদ:

বাংলাদেশ রাখাইন স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ক্যাখিন রাখাইন বলেন, পোশাকের ক্ষেত্রে রাখাইন যুবকরা নিজেদের তৈরি লুঙ্গি (দোয়া) ও শার্ ট(এনজ্যি) পরিধান করে। মন্দিরে প্রার্থনা এবং বিভিন্ন ধর্মীয় ও লোকজ অনুষ্ঠানে মাথায় পাগড়ি পরে, যা ঐতিহ্যের প্রতীক।

অন্যদিকে মেয়েরা লুঙ্গি (থাবিং), ব্লাউজ (বেদাই এনজ্যি), বক্ষবন্ধনী (রানজেই এনজ্যি), ওড়না (পোছো পেইন) ইত্যাদি পরিধান করে। এছাড়া সাজসজ্জায় চুলে তাজা ফুল, সোনা ও রূপার টংকার, স্বর্ণের অলংকার পছন্দ করে। কিন্তু বর্তমানে চাকরিজনিত কারণে নারী-পুরুষ উভয়ে অফিসিয়াল পোশাক পরে। কম সংখ্যক মহিলা তাদের পোশাক পরে। এখন তারা সালোয়ার-কামিজে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। তবে ধর্মীয় উৎসব পূজা-পার্বণে তারা জাতীয় পোশাক পরে। বর্তমানে বুটিক দোকানগুলো তাঁত ব্যবহার করে রাখাইনদের ঐতিহ্যবাহী ধারা বজায় রেখে বিভিন্ন পোশাক বিক্রি করছে। রাখাইন মেয়েরা জিন্স প্যান্ট, গেঞ্জি, ফতুয়া ইত্যাদি পরিধান করে। তারা এখন বাঙালি সংস্কৃতির পাশাপাশি নগর জীবন ও সেটেলাইট চ্যানেল দ্বারা প্রভাবতি হচ্ছে, যা তাদের পোশাক পরিচ্ছদেও এনেছে ব্যাপক পরিবর্তন।

আদিবাসী ফোরাম, কক্সবাজার জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মংথেনহলা রাখাইন বলেন, বাংলাদেশে বসবাসরত রাখাইন সম্প্রদায় আজ নানা প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করে বেঁচে আছে। চরম হুমকির সম্মুখীন তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি। ভূমি হারিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের দিকে ঝুঁকে পড়ছে তারা। কিন্তু এখানেও শান্তি নেই। ব্যবসা করতে গেলেও পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হয়। সব মিলিয়ে রাখাইন সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব আজ চরম হুমকির মুখে।

আরো পড়ুন:

বম জাতিগোষ্ঠী : পৃথক বর্ণমালা না থাকলেও আছে নিজস্ব ভাষা

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *