রমজানে মানবদেহে রোজার প্রভাব
রোজা হচ্ছে মুসলমানদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত আর রমজানে মানবদেহে রোজার প্রভাব এবং রোজা রাখার গুরুত্ব অনেক বেশি কারণ তা স্বাস্থ্যের জন্যও খুব বেশি উপকারী। রোজা ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের একটি। এটি মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের অন্যতম মাধ্যম।
বলা যায়, রোজা রাখার দ্বারা ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিংয়ের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং বাই প্রডাক্ট হিসেবে অটোফেজির মাধ্যমে স্বাস্থ্যের উন্নয়ন অর্জন হয়।
দীর্ঘ দেড় হাজার বছর পর ড. ইয়োশিনরি ওশোমি তা প্রমাণ করে দেখিয়েছেন মাত্র।
বর্তমান জগতে সুস্থ থাকার জন্য যত ধরনের ফাস্টিং পদ্ধতির উদ্ভব হয়েছে তার মধ্যে ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি। রমজানে রোজার ফাস্টিং এবং সারা বছর ভেঙে ভেঙে সপ্তাহে দুই দিন ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টার ফাস্টিং, ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিংয়ের জ্বলন্ত উদাহরণ। আমরা রাসুল (সা.)-এর শাবান মাসের বেশির ভাগ দিনে রোজা রাখাকে রমজানে প্রবেশ করার আগেই ফ্যাট অ্যাডাপ্টেশন, রমজানের রোজাকে অটোফেজির পূর্ণতা, এরপর রমজান-পরবর্তী শাওয়ালের রোজা এবং সারা বছরে সপ্তাহে দুদিন রোজার বিধানকে স্বাস্থ্য সুরক্ষার মেইন্টেন্যান্স টিপস বলতে পারি।
এ জন্যই ইসলামে রমজানের পূর্বের শাবান মাসে অন্য মাসের চেয়ে বেশি রোজা রাখা, রমজানের ৩০ দিন বাধ্যতামূলক রোজা রাখা, শাওয়ালের ছয় রোজা এবং সারা বছর ধরে সপ্তাহে দুই দিন রোজা রাখা, চন্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ আইয়ামে বিজের রোজা এবং অল্পাহারের বিধান ডায়াবেটিস, হার্ট ডিজিজ, ক্রনিক কিডনি ডিজিজ, উচ্চ রক্তচাপ এবং ক্যান্সারের মতো লাইফস্টাইল ডিজিজ নিয়ন্ত্রণে অত্যন্ত কার্যকর বলে আধুনিক বিজ্ঞানেই প্রমাণিত। অথচ তাবৎ বিশ্বের চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা এসব রোগের চিকিৎসা ও নিয়ন্ত্রণে গলদঘর্ম হচ্ছে। এসব লাইফস্টাইল ডিজিজ থেকে বাঁচার চেষ্টা বিশ্বব্যাপী কম করা হচ্ছে না; কিন্তু ঘুরে-ফিরে ইসলাম নির্ধারিত পন্থায় মানুষের ফিরে আসার ইঙ্গিত স্পষ্ট।
বিজ্ঞানী লেভেলে অটোফেজি নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা শুরু হয় ১৯৬০-এর দশক থেকে। কিন্তু যে জিনের সাহায্য যেভাবে যেথায় এই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয় তার বিস্তারিত মাত্র কিছুদিন আগে ১৯৮৩ সালে ড. ইয়োশিনরি ওশোমি ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে, অটোফেজি প্রক্রিয়ায় সেলের অপ্রয়োজনীয় অংশ খেয়ে ফেলার পর নতুন করে সেল উজ্জীবিত হয় এবং শক্তি উৎপাদিত হয়। তিনিই প্রথম বলেছেন, অটোফেজির মেকানিজমের জন্য দায়ী অন্তত ১৫টি জিন। বিস্তারিত তথ্য আবিষ্কারের জন্য জাপানি এই বিজ্ঞানী ও সেল বায়োলজিস্ট ড. ইয়োশিনরি ওশোমি ২০১৬ সালে নোবেল প্রাইজ পান।
তিনি বলেন, অটোফেজির জন্য যে জিন দায়ী তাতে মিউটেশন হলে নানা ধরনের অসুখ হয়। তিনি ক্ষুধার সময় কোষ কিভাবে সাড়া দেয় তার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। তাঁর যুগান্তকারী আবিষ্কার আমাদের কোষগুলোর পুষ্টিহীনতা, ইনফেকশন, নির্দিষ্ট কিছু বংশগত রোগ, নিউরোলজিক্যাল ডিজিজ এবং ক্যান্সারে কিভাবে কাজ করে তার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। তাঁর এই আবিষ্কারকে ‘নিজের কোষ নিজেই খাবার’-এর গবেষণা আবিষ্কার বলে। অটো মানে ‘নিজে’ ফেজি মানে ‘খেয়ে ফেলা’। তার মানে নিজের কোষকে নিজেই খেয়ে ফেলা।
ঘরে যেমন ময়লা ফেলার জন্য ডাস্টবিন থাকে, কম্পিউটারে যেমন রিসাইকেল বিন থাকে, তেমনি আমাদের প্রত্যেকটি কোষে ডাস্টবিনসদৃশ মেমব্রেন বাউন্ড একটি গোলাকার ঝুরি বা অঙ্গাণু থাকে, যাকে বলা হয় লাইসোজোম। ঘরের ময়লা-আবর্জনা দিয়ে ডাস্টবিন ভরে গেলে আমরা বাইরে ফেলে দিই; না ফেলে দিলে ঘরে দুর্গন্ধ ছড়ায়। তেমনি শরীরের কোষের ভেতর নানা ক্রিয়া-বিক্রিয়ায় যা কিছু আবর্জনা জমা হয়, তা এই লাইসোজোম থেকে নির্গত হাইড্রোলাইটিক এনজাইম কাজে লাগিয়ে খেয়ে ফেলে, যেন জমা আবর্জনা কোষের ভেতরকার ক্রিয়া-বিক্রিয়ায় প্রভাব ফেলতে না পারে।
মানুষ যত বেশি খাবে তত আবর্জনা তৈরি হবে। সারা বছর মানুষের এই কোষগুলো আবর্জনা পরিষ্কার করতেই থাকে। কিন্তু খাবারের কারণে বেশি আবর্জনা জমা হয়ে গেলে তা পরিষ্কার করার মতো ক্ষমতা লাইসোজোমের থাকে না। শরীর কোষের এই অঙ্গাণু অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় এবং অতিরিক্ত বর্জ্য জমা হওয়ার কারণে ক্যান্সার বা ডায়াবেটিসের ঝুঁকিও বেড়ে যায়।
রমজানে নিয়মিত একটি দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকার কারণে শরীরের কোষগুলো সক্রিয়তা কম দেখায় এবং এসব আবর্জনা কম তৈরি হয়; বরং জমা আবর্জনা খেয়ে ফেলে শক্তি উৎপাদন করে। এই সময়ে শরীরের কোষগুলোর অন্যান্য ক্রিয়া-বিক্রিয়া কমে গেলেও কোষের আবর্জনা পরিষ্কারে লাইসোজোমেরও নিজের আবর্জনা নিজেই খেয়ে ফেলার শক্তি বেড়ে যায়।
রোজার ৩০ দিন একটা নির্দিষ্ট সময়ে কোষের বর্জ্য পরিষ্কারের কাজ চলে। প্রতিদিন একই সময়ে কোষগুলো অটোফেজির মাধ্যমে বর্জ্য পরিষ্কারের কাজ করার কারণে অনেকটা ট্রেনিংপ্রাপ্ত সৈনিকের মতো খুব সুচারুরূপে বর্জ্য পরিষ্কারের কাজটি করতে অভ্যস্ত হয়ে যায়। রেগুলার না হয়ে হঠাৎ যদি এই না খাওয়া হয়, তাহলে অটোফেজি প্রক্রিয়া শুরু হয় আরো পরে। রোজায় তো না খেয়ে থাকা হয় ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা। এ জন্য রোজা রাখার প্রথম দিকে অটোফেজি প্রক্রিয়া তেমন একটা হয় না। রেগুলার না খেয়ে থাকার কারণে আস্তে আস্তে একটা নির্দিষ্ট সময়ে আগে ভাগেই অটোফেজি প্রক্রিয়া শুরু হয়।
আবার কেউ যদি মনে করে যে সে একটু বেশি না খেয়ে থেকে বেশি অটোফেজি সক্রিয় রাখবে, তাহলে হিতে বিপরীত হবে। কারণ দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকলে কোষ আবার বর্জ্যগুলো খাওয়ার পর না পেয়ে কোষের ভালো অংশও খেতে শুরু করে।
অর্থাৎ অটোফেজি আর নিয়ন্ত্রণে থাকে না। সুতরাং মাত্রাতিরিক্ত বেশি না খেয়ে থাকলে অটোফেজি প্রক্রিয়ার যে সুফল পাওয়ার কথা, তা না পেয়ে বরং উল্টোটাই পাবে। এ জন্য প্রতিদিন ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা না খেয়ে ৩০ দিনের রোজা রাখার যে নিয়ম আল্লাহ বেঁধে দিয়েছেন তাই সবচেয়ে বৈজ্ঞানিক উপায় কোষের ডাস্টবিন পরিষ্কার করার।
আবার এই প্রক্রিয়ায় সারা বছর ধরে রোজা চালালে শরীরের ভীষণ ক্ষতি হবে এবং বাস্তবিক কারণেই তা সম্ভব নয়। এ জন্যই রাসুল (সা.) একনাগাড়ে সারা বছর রোজা রাখতে নিষেধ করেছেন। কিন্তু বছরের অন্য সময়ে সপ্তাহে নির্দিষ্ট দুই-তিন দিন নফল রোজা রাখার যে পরামর্শ রাসুল (সা.) দিয়েছেন তাও অত্যন্ত সায়েন্টিফিক। রাসুল (সা.)-এর দেখানো নিয়মেই বর্তমান দুনিয়ায় ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং আজ জনপ্রিয়।
জাপানি সেল বায়োলজিস্ট নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী ড. ওশোমি ঠিক এ কথাটাই সুপারিশ করেছেন। তিনি বলেছেন, দিনের পুরো অংশ নয়, বরং একটা অংশ (১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা) না খেয়ে থাকলে তা শরীরের জন্য ইতিবাচক পরিবর্তন বয়ে আনে। তিনি আরো বলেছেন, মুসলমানদের ৩০ দিন একনাগাড়ে দিনের একটা অংশে রোজা রেখে অন্য একটা অংশে ভেঙে ফেলা খুবই বৈজ্ঞানিক ও কার্যকর।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ডিপার্টমেন্ট অব হিস্টোপ্যাথলজি, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি, শেরেবাংলানগর, ঢাকা।