স্বাস্থ্য

রক্তস্বল্পতায় আক্রান্ত শিশুরা যেন চিকিৎসায় অগ্রাধিকার পায় : গবেষণাপত্রে সুপারিশ

নিখিল মানখিন, ধূমকেতু ডটকম: আয়রনের ঘাটতির কারণে রক্তস্বল্পতায় আক্রান্ত শিশুদেরকে খুঁজে বের করে সহজলভ্য কম-দামী সম্পূরক দিয়ে তাদেরকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চিকিৎসা দেয়া প্রয়োজন। আয়রন ঘাটতির কারণে রক্তস্বল্পতায় আক্রান্ত ছোট শিশুদের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। গ্রামাঞ্চলের শিশুরা বেশি মাত্রায় আক্রান্ত হচ্ছে। রক্তস্বল্পতার ব্যাপকতায় বেশ কিছু কারণ চিহ্নিত হলেও আয়রন ঘাটতির বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। আয়রনের ঘাটতিজনিত রক্তস্বল্পতাকেই দেশের ছোট শিশুদের মধ্যে বিরাজমান প্রধানতম রক্তস্বল্পতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। শিশুদের বিকাশের সময় খাদ্যে আয়রনের অভাবকে এর মূল কারণ হিসেবে ধরা হয়। রক্তস্বল্পতায় আক্রান্ত শিশুরা দারিদ্রতার সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন সমস্যার ঝুঁকিতে আছে, যা তাদের জন্য ক্ষতিকর এবং সুস্থভাবে তাদের বেড়ে ওঠাকে বাধাগ্রস্ত করে। অল্প বয়সে রক্তস্বল্পতা বুদ্ধির বিকাশকে দারুণভাবে বাধাগ্রস্ত করে। আর ছোট শিশুদের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বিকাশের ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। আইসিডিডিআর,বি পরিচালিত গবেষণা প্রতিবেদনে এ চিত্র ফুটে উঠেছে। 

আইসিডিডিআর,বি এর গবেষকদল জানায়, বাংলাদেশের শিশুদের রক্তস্বল্পতা-সংক্রান্ত গবেষণাসমূহের অধিকাংশই রক্তে শুধুমাত্র হিমোগ্লোবিনের মাত্রাকে মাপকাঠি হিসেবে ব্যবহার করেছে। মাত্র কিছু সংখ্যক গবেষণা আয়রন ঘাটতির কারণে সৃষ্ট রক্তস্বল্পতার ওপর পরিচালিত হয়েছে। তাই ছোট শিশুদের মধ্যে আয়রনের ঘাটতির কারণে সৃষ্ট রক্তস্বল্পতার সঠিক ব্যাপকতা এবং এদের ওপর আয়রন চিকিৎসার ফলাফল বের করতে একটি গবেষণা পরিচালনা করে আইসিডিডিআর,বি। আলোচ্য প্রতিবেদনে দেশের গ্রামাঞ্চলে ছোট শিশুদের মধ্যে আয়রনের ঘাটতির কারণে সৃষ্ট রক্তস্বল্পতার ব্যাপকতা তুলে ধরা হয়েছে। গবেষণার উদ্দেশ্যে মনোহরদী উপজেলার ৩০টি গ্রাম দৈবচয়নের ভিত্তিতে নির্বাচন করা হয়। জাতীয় পুষ্টি কর্মসূচির আওতায় পরিচালিত পুষ্টিকেন্দ্রসমূহের জন্মনিবন্ধিকরণ রেজিস্টার থেকে উল্লেখিত গ্রামসমূহের দু’ বছরের কম বয়সী সব শিশুকে নির্বাচন করা হয়।

আপাতদৃষ্টিতে সুস্থ সব শিশুর মাকে রক্তস্বল্পতা পরীক্ষার জন্য পরিচালিত সমীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য আহ্বান জানানো হয়। মোট ১ হাজার ২৩৭ জন শিশুর মায়েরা লিখিত সম্মতি দিয়ে এই সমীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। নির্বাচিত শিশুদের পায়ের গোড়ালি থেকে কয়েক ফোঁটা রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে ‘সিম্পল স্যান্ডইউইচ এনজাইম লিংকড ইম্মিউনোসরবেন্ট অ্যাসে’ দ্বারা হিমোগ্লোবিন, ফেরিটিন, সি-রিঅ্যাকটিভ প্রোটিন এবং সিরাম ট্রান্সফারিন রিসেপ্টর এর মাত্রা পরীক্ষা করা হয়।

গবেষণা কার্যক্রমের জন্য নির্ধারিত ১ হাজার ২৩৭ জন শিশুর সবার বয়সের গড় ছিল ১৩ মাস। রক্ত পরীক্ষার একটিমাত্র পরিমাপক অর্থাৎ হিমোগ্লোবিনের মাত্রা <১১ জি/ডিএল অনুযায়ী রক্তস্বল্পতার হার ছিল শতকরা ৬০ ভাগ(৭৫৫জন)। তবে রক্তে আয়রনের ঘাটতি পরিমাপের জন্য আয়রনের অন্যান্য পরিমাপ যেমন-কম মাত্রার হিমোগ্লোবিনের সঙ্গে ফেরিটিন এবং কম সি-রিঅ্যাকটিভ প্রোটিনের মাত্রা মিলিয়ে হিসাব করলে দেখা যায় যে,  শতকরা ২৫ ভাগ শিশুর আয়রনের ঘাটতিজনিত রক্তস্বল্পতা ছিল। যখন কম মাত্রার হিমোগ্লোবিন এবং উচ্চ মাত্রার সিরাম ট্রান্সফারিন সিসেপ্টরকে রক্তে আয়রনের পরিমাপের একটি নির্দেশক হিসেবে ধরা হয়, তখন শতকরা ৩০ ভাগ শিশুর আয়রনের ঘাটতিজনিত রক্তস্বল্পতা দেখা যায়।

গবেষণার শুরুতে আয়রনের ঘাটতির কারণে স্বল্প থেকে মাঝারি মাত্রার রক্তস্বল্পতায় আক্রান্ত বিভিন্ন বয়সের ২২৫ জন শিশুর মধ্যে রক্তস্বল্পতার ধরন একই রকম ছিল। আয়রনের ঘাটতির কারণে রক্তস্বল্পতায় আক্রান্ত শিশুদের খাটো হওয়ার সম্ভাবনা সব সময়ই বেশি থাকে এবং এখানের আয়রনের ঘাটতির কারণে রক্তস্বল্পতায় আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে অতিমাত্রায় খাটো শিশুদের হার যাদের রক্তস্বল্পতা ছিল না তাদের তুলনায় অধিক ছিল। বুদ্ধিমত্তার পরীক্ষায় যাদের রক্তস্বল্পতা ছিল না তাদের মায়েদের তুলনায় রক্তস্বল্পতায় আক্রান্ত শিশুদের মায়েরা অপেক্ষাকৃত কম স্কোর করেছিল এবং তারা তাদের শিশুদের কম যত্ন ও উদ্দীপনা দিয়েছিল। রক্তস্বল্পতায় আক্রান্ত শিশুদের পরিবার স্বাভাবিক শিশুদের পরিবার থেকে অর্থনৈতিকভাবে দরিদ্র হলেও শিক্ষাগত যোগ্যতা ও চাকরি ধরন দু’ শ্রেণীতে একই রকম ছিল।

এদিকে, একটি জাতীয় সমীক্ষায় ১ থেকে ৩ বছর বয়সী শিশুদের খাদ্যে শক্তি, আমিষ, আয়রন এবং অন্যান্য পুষ্টির অভাব পরিলক্ষিত হয়। তাদের খাদ্যে আয়রনের শতকরা ৬০ ভাগ আসে সিরিয়াল জাতীয় খাবার থেকে। এ সব সাধারণ চাল নির্ভর খাদ্যে আয়রন এবং আমিষ উভয়েরই ঘাটতি থাকে এবং সম্ভবত এ কারণেই শিশুরা আয়রনের ঘাটতিজনিত রক্তস্বল্পতায় ভোগে। এছাড়া কম ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করা শিশুরা যেহেতু কম আয়রনের মজুদ নিয়ে জন্মায়, সেহেতু এটিও আয়রন ঘাটতির কারণে সৃষ্ট রক্তস্বল্পতার আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।

আরো পড়ুন:

রক্তে হিমোগ্লোবিন বাড়ানোর সহজ উপায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *