ডেস্ক রিপোর্ট, ধূমকেতু ডটকম: করোনাভাইরাসের পর পর দুটি ঢেউ মোকাবিলায় ভারতে সবচেয়ে সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে কেরালা। ২০২০ সালের শুরুতে কোভিডের সংক্রমণ যখন ভারতে সেভাবে আসতে শুরু করেনি, বিজ্ঞানীরা সতর্কবার্তা দিচ্ছিলেন, কেরলাই হলো ভারতের একমাত্র অঙ্গরাজ্য যেখানে আন্তর্জাতিক সতর্কবাণীকে যথোচিত গুরুত্ব দিয়ে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছিল।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যখন থালাবাটি বাজিয়ে, শঙ্খধ্বনি করে, নিষ্প্রদীপ রেখে কোভিড মোকাবিলার অবৈজ্ঞানিক পথে হেঁটেছিলেন, তখন বিজ্ঞানচেতনার বাইরে কোনো রকম কুসংস্কারচ্ছ মানসিকতার পথে হাঁটেনি কেরালা রাজ্যের প্রশাসন।
কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের বিষয়েও আগে থেকে গোটা বিশ্বকে সতর্ক করেছিলেন বিজ্ঞানী-গবেষকরা। ভারত সরকার সেই সতর্কতাকে কানে তোলেনি। কুম্ভমেলায় লাখ লাখ মানুষের জমায়েতের ফলে লাগামহীন সংক্রমণ ছড়িয়েছে। দীর্ঘায়িত ভোট প্রক্রিয়াও কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিপদ বাড়িয়েছে। এই পর্যায়েও ব্যতিক্রমী ভূমিকা রেখেছে কেরালার বাম সরকার। দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলাতেও প্রথম থেকেই কেরালা সরকার বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিগুলোর ওপর গুরুত্ব দেওয়ার ফলে সেখানে দ্বিতীয় পর্যায়ের সংক্রমণের মোকাবিলা করা অনেক বেশি সহজ সাধ্য হয়েছে।
সর্বস্তরের টিকাদান কার্যক্রম নির্বাচন প্রক্রিয়ার ভেতরেও নিরলসভাবে করে গিয়েছে কেরালা সরকার। এই সার্বজনীন টিকা কার্যক্রম নিয়ে কেরালা সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধীরাও কোনো প্রকারের দুর্নীতি বা পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুলতে পারেনি। কোভিড মোকাবিলায় কেরালা সরকারের ভূমিকা আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও নানাভাবে প্রশংসিত হয়েছে।
নির্বাচন প্রক্রিয়ার সময়ে কোভিড পরিস্থিতির ভেতরে কেরালাতে মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা ঘিরে কোনো রকম অনিশ্চয়তা তৈরি হয়নি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে দুটি পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছে কেরালা সরকার। পশ্চিমবঙ্গে যখন দীর্ঘ টালবাহনার পর দুটি পরীক্ষাই বাতিল হয়েছে, তখন নির্বাচনে জিতে কেরালা সরকারের দুটি পরীক্ষা নেওয়ার প্রক্রিয়া শেষ হয়ে গিয়েছে। ভোট, কোভিড কোনো কিছুর অজুহাতেই কেরালা সরকার মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের ভেতরে কোনো রকম অনিশ্চয়তা তৈরি করতে চাননি। ইতোমধ্যেই ফলাফলও প্রকাশিত হয়েছে।
কেরালাতে বামপন্থীরা গত এক দশকে যে সামাজিক সংস্কারের পথে হেঁটেছে তাতে উচ্চবর্ণ এবং উচ্চবর্গের ভেতরে বামদের প্রতি সমর্থনের হার খুব বেশি না বাড়লেও নিম্নবর্গীয়দের ভেতরে বামদের প্রতি সমর্থন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। সাবলটার্নদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে যে নিরন্তর কর্মপ্রবাহ কেরালার বাম সরকার চালিয়েছে, সেটাই তাদের পর পর তিন বার জেতার অন্যতম চাবি-কাঠি হয়ে উঠেছে।
উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ্যবাদ সংস্কৃতির একটি বড় প্রভাব কেরালার সামাজিক জীবনে আছে। সেই প্রভাব থেকে কেরালার মানুষদের বের করে আনার ক্ষেত্রে বামপন্থীরা ব্রিটিশ শাসনকাল থেকে সেখানে নিরন্তর সংগ্রাম করে আসছে। ক্ষমতায় এসেও সেই সামাজিক লড়াইয়ের বিষয়টি তারা ভুলে যায়নি— অস্বীকার করা তো দূরের কথা। সমাজবিজ্ঞানী জোহান্স ব্রনখোর্স্ট বলেছিলেন; ভারতে ব্রাহ্মণ্যবাদের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্কটা খুব ক্ষীণ। এই সম্পর্কটা হলো, একটা সামাজিক আদর্শবাদের তথাকথিত পরিকাঠামো তৈরি করে, সেই পরিকাঠামোর সঙ্গে ধর্মীয় আধিপত্যবাদ বিস্তারের একটি কৌশল।
কোভিডের প্রথম ঢেউয়ের সময় থেকেই সংক্রমণ প্রতিরোধে চিকিৎসাবিজ্ঞানের যাবতীয় প্রয়োগজনিত দিকগুলোর ওপর গুরুত্ব দেওয়ার পাশাপাশি কোনো অবস্থাতেই কেরালায় যেন অক্সিজেনের সংকট দেখা না দেয় সেই বিষয়টির ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে রাজ্য সরকার। অক্সিজেনের জোগান নিরবচ্ছিন্ন রাখতে পুরনো অক্সিজেন প্ল্যান্টগুলোতে উৎপাদন ধরে রাখার পাশাপাশি নতুন প্ল্যাট অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে তৈরি করাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছে কেরালা সরকার। দ্বিতীয় সংক্রমণের ভয়াবহতা এবং সংক্রমণজনিত কারণে অক্সিজেনের লাগামহীন চাহিদাকে ঘিরে আন্তর্জাতিক স্তরে যে সতর্কবার্তা ছিল তাকে কোনো অবস্থাতেই খাটো করে না দেখে পুরনো অক্সিজেন প্ল্যান্টগুলো আধুনিকীকরণ এবং নতুন প্ল্যান্ট তৈরির জন্য আপৎকালীন বিভিন্ন তহবিল থেকে অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতার সঙ্গে যখন কার্যত অসংসদীয় ভাষা প্রয়োগের প্রতিযোগিতা চলছে প্রধানমন্ত্রী মোদির, সেই সময়, অর্থাৎ গত এপ্রিলের প্রথম দিকে যখন জোরদার নির্বাচনি প্রচার চলছে, কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ে অক্সিজেন সংকট মোকাবিলায় নিজের রাজ্যের জন্য হাজার টন তরল অক্সিজেন চেয়ে চিঠি লিখতে দ্বিধা করেননি। ভোটের আগেই দৈনিক অক্সিজেন উৎপাদন ১৪৯ মেট্রিক টন থেকে বাড়িয়ে ১৬০ টন করতে সমর্থ হয়েছিল বিজয়ন সরকার। নতুন প্ল্যান্ট স্থাপন এবং পুরনো প্ল্যান্টগুলোর উৎপাদন বৃদ্ধি করে নিজের রাজ্যে অক্সিজেনের চাহিদা মিটিয়ে পাশের পুদুচারিতে পর্যন্ত কোভিড রোগীদের জন্যে অক্সিজেন সরবরাহ করতে সক্ষম হয়েছে কেরালার বাম সরকার।
নির্বাচনের সময় কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ে গোটা ভারত তীব্র অক্সিজেন সংকটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল। তখন খোদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি কেবলমাত্র ভোট নিয়ে ব্যস্ত। অথচ ভোটের প্রচারপর্বের ভেতরেই কেরালা দৈনিক ২০৪ দশমিক ৭৫ টন অক্সিজেন উৎপাদন করতে থাকে। এর ৩৫ শতাংশ কোভিড রোগীদের জন্য ব্যবহার করা হয়, বাকিটা অন্যান্য রোগীদের জন্য। মনে রাখা দরকার যে, ওই সময় ভারতের অন্য প্রান্তগুলোতে নন-কোভিড রোগীরা অক্সিজেন প্রায় পাচ্ছিলেনই না। রাজনৈতিক বিরোধী হয়েও গোয়ার স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিশ্বজিৎ রানে অক্সিজেন পেয়ে প্রকাশ্যে কেরালা সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন।