বিনোদন

যেভাবে ঢাকাই চলচ্চিত্রের ‘মিষ্টি মেয়ে’ হলেন কবরী

নিজস্ব প্রতিবেদক, ধূমকেতু ডটকম:  সত্তর ও আশির দশকে বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে শহুরে মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তরাও কবরীকে নিজেদের মানুষ হিসেবে আপন করে নিয়েছিলেন। আর সেজন্যেই ‘মিষ্টি মেয়ে’ নামে দর্শকদের কাছে জনপ্রিয় ছিলেন তিনি।

কৈশোর আর যৌবনের পাট চুকিয়ে ফেলার পরও ‘মিষ্টি মেয়ে’ হিসেবে কবরীর সেই গ্রহণযোগ্যতা সবসময়ই ছিল। ২০১১ সালে বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন: ‘‘এখনও দেখা হলে কেউ কেউ বলে, ‘আপনি ঠিক আগের মতই আছেন।’ কিন্তু কেউ কি কখনো একরকম থাকতে পারে! তখন আমি তাকে বলি যে, আপনি আমাকে ভীষণ ভালোবাসেন বলেই এরকম মনে হয়।”

যে কারণে ‘মিষ্টি মেয়ে’ হিসেবে খ্যাতি

অভিনেতা হিসেবে মানুষের হৃদয়ের কাছে যেতে পারা, মানুষের ভালোবাসার পাত্র হতে পারাটাই কবরীর সবচেয়ে বড় অর্জন বলে মনে করেন কবরীর সমসাময়িক অভিনয় শিল্পী মাসুদ পারভেজ, যিনি সোহেল রানা হিসেবেই বেশি পরিচিত।

তার মতে, ‘কবরী তার অভিনয় দিয়ে মানুষকে যতটা প্রভাবিত করতে পেরেছেন, তেমনটা আর কেউ পারেননি। কবরীকে মানুষ মনে করতো, এই শিল্পীটা আমার শিল্পী। আমার কাছের মানুষ। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে কবরীর মত মানুষের হৃদয়ের কাছাকাছি প্রিয় শিল্পী আর কেউ নেই।’

সিনেমার পর্দায় বাংলাদেশি সাধারণ মেয়ে হিসেবে কবরীকে যেভাবে দেখা যেত, বাস্তবের গ্রামীণ নারী বা শহুরে মধ্যবিত্তের ঘরের মেয়ের চরিত্রটা ঠিক সেরকম ছিল। অভিনয় শিল্পী হিসেবে নিজস্ব স্বকীয়তা ও সহজাত প্রবৃত্তি কবরীকে অন্যদের চেয়ে আলাদা অবস্থান দিয়েছে বলে মনে করেন মাহমুদা চৌধুরী, যিনি চার দশকেরও বেশি সময় জড়িত ছিলেন চলচ্চিত্র সাংবাদিকতার সাথে।

তিনি বলেন, ‘মিষ্টি মেয়ে’ ছাড়া তিনি ‘পাশের বাড়ির মেয়ে’ হিসেবেও খ্যাত ছিলেন। কারণ তার চেহারায়, আচরণে, অভিনয়ে সেই বিষয়টা ছিল। খুব বেশি মেকআপ করতো না, এমনকি চুলটাও একদম সাধারণ একটা মেয়ের মত রাখতো। যার কারণে সাধারণ মানুষের কাছে খুব আপন হয়ে ধরা দিতো।

১৯৫০ সালের জুলাই মাসে চট্টগ্রামে জন্ম হয় কবরীর। ১৯৬৪ সালে সুভাষ দত্তের ‘সুতরাং’ ছবির মধ্যে দিয়ে সিনেমায় অভিষেক। এক সাক্ষাৎকারে কবরী বলেছিলেন, ‘সুতরাং’ সিনেমার কিশোরী কবরী দর্শকদের কাছে যে এতটা জনপ্রিয়তা পাবে, সেটা তিনি ভাবতেই পারেননি।

শুরুর দিকে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে তাকে প্রচুর রিহার্সাল করতে হয়েছিল ভাষা থেকে আঞ্চলিক টান দূর করতে। কবরীর ভাষায়: ‘চোখ তুলে তাকাতে সাহস পেতাম না, খুব লজ্জা পেতাম। সব দত্তদা (সুভাষ দত্ত) শিখিয়েছেন। কিন্তু ‘সুতরাং’-এর পর আমাকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি।’

এরপরের দুই দশকে ‘রংবাজ’, ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘দ্বীপ নেভে নাই’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘সুজন সখী’, ‘সারেং বৌ’য়ের মত বহু ব্যবসা সফল এবং আলোচিত সিনেমায় প্রধান নারী চরিত্রে অভিনয় করেন কবরী।

কিংবদন্তীতুল্য রাজ্জাক-কবরী জুটি

বাংলাদেশের সিনেমায় ‘নায়ক রাজ’ হিসেবে পরিচিত রাজ্জাকের সাথে তার জুটি এখন পর্যন্ত নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং আলোচিত জুটি। বাংলাদেশের সিনেমায় কিংবদন্তী তুল্য এই জুটি দর্শকদের কাছে যতটা গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল, তার ধারে কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি আর কোনো জুটি।

দশ বছর আগের এক সাক্ষাৎকারে কবরী বলেছিলেন: “আমার অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। প্রেম করা আমার হয়ে ওঠেনি। কিন্তু রাজ্জাকের সাথে অভিনয় করার সময় এক ধরণের রোমাঞ্চ অনুভব করতাম আমি।”

কবরী মনে করতেন, রাজ্জাকের সাথে অভিনয়ের সময় তাদের দু’জনের আবেগের অকৃত্রিমতার কারণেই জুটির রসায়ন মানুষের মনে দাগ কেটেছে।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পূর্ববর্তী সময়ে বা যুদ্ধ পরবর্তী উত্তাল সময়গুলোতে রাজ্জাক-কবরী জুটি তৎকালীন প্রেক্ষাপটে সমাজের সাধারণ মানুষের চিন্তাধারার প্রতিনিধিত্ব করতো এবং মানুষকে মানসিকভাবে স্বস্তি দিয়েছিল বলে এই জুটি মানুষের মধ্যে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে- এমন মনে করেন বাংলাদেশের সিনেমা গবেষক অনুপম হায়াৎ।

তিনি বলেন, “সে সময়কার সামাজিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করলে, ষাটের দশকের গুমোট পরিস্থিতিতে বিনোদনের মধ্যে দিয়ে একরকম স্বস্তি পেতে চাইতো মানুষ, এই রাজ্জাক-কবরী জুটি সেই স্বস্তিটা দিতে পেরেছিল।”

কবরী ২০০৮ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।

সিনেমায় অভিনয় ছাড়াও সিনেমা প্রযোজনা এবং পরিচালনার সাথে জড়িত ছিলেন তিনি। একাধিকবার পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার। সূত্র: বিবিসি বাংলা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *