খোকন কুমার রায়:
মনে হচ্ছে অন্তহীন পথ, ক্লান্তিতে, শ্রান্তিতে পা আর চলছে না। তবু পথ চলতে হবে কারণ গার্মেন্টস খোলা।
কী অবাক কাণ্ড! সরকার যেখানে ছুটি দিয়ে সবাইকে ঘরে অবস্থান করতে বলেছেন এবং ঘরে ঘরে খাদ্যসামগ্রী পাঠাচ্ছেন – এ অবস্থায় লাখো শ্রমিক ঘর ছেড়ে দলে দলে পথ হাঁটছেন, কেউ বা একশ মাইল, কেউ বা দুশ মাইল, কেউ বা আরো বেশি। উপায় নেই, চাকরি বাঁচাতে হবে, বেতনটা তুলতে হবে। বাঁচতে হবে মৃত্যু ঝুঁকি নিয়েই। এ রকম গোটা বিশ্বে বিরল।
যানবাহন বন্ধ, সরকারি সকল বাহিনী মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন মানুষগুলোকে ঘরে রাখতে যাতে ভাইরাস সংক্রমণ খুব বেশি না ঘটে। এ ঘটনায় তাদের সকল পরিশ্রম মনে হয় ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে।
সরকার ছুটি ঘোষণার সাথে সাথে দলে দলে লোক করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়ে শহর ছেড়ে ছুটলো গ্রামের দিকে। আর গার্মেন্টস খোলার সংবাদে আবার দলে দলে হেঁটে ফিরে আসলো। কেউ জানলো না যাওয়া এবং আসার বেলায় কতই না ঘটেছে ভাইরাস সংক্রমণ!
কারণ প্রায় তিন লক্ষ প্রবাসী করোনা ঝুঁকি নিয়ে এসে শহর পেরিয়ে গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছেন এবং এদের সবাই নিরাপদ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করেননি। এদের কেউ কেউ ভাইরাস আক্রান্ত হয়ে মারাও গেছেন, আর কতনা ভাইরাস ছড়িয়ে গেছেন দেশজুড়ে! কেউ কেউ বা এখনো ভাইরাস ছড়িয়ে বেড়াচ্ছেন।
আমরা প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকায় ভাইরাস সংক্রমণের খবর পাচ্ছি। এ অবস্থায় লক্ষ লক্ষ গার্মেন্টস শ্রমিকসহ গোটা সমাজকে ঝুঁকিতে ফেলা মোটেই উচিত হয়নি। এমনওতো হতে পারে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলোকেই কোয়ারেন্টাইন বা আইসোলেশন সেন্টার ঘোষণা করতে হতে পারে। কারণ গার্মেন্টস শ্রমিকদের বাসস্থান, জীবনযাত্রার মান, এবং কর্মপরিবেশটা কেমন ঘনত্বের, কম-বেশি আমরা অনেকেই জানি। এই ভয়াবহ ছোঁয়াচে ভাইরাস সংক্রমণের পরিণাম সম্পর্কে হয়তো আমাদের শ্রমিক শ্রেণীটা অতোটা অবগত এবং সচেতন নয়। এ প্রসঙ্গে ইতালির একজন ডাক্তারের উক্তিটি ছিল এ রকম- “আমরা যদি এই ভাইরাসের ভয়াবহতা সম্পর্কে আগে জানতাম তাহলে হয়তো ঘরের জানালা দিয়েও বাইরে তাকাতাম না।”
আমার মনে হয় গোটা বিশ্বের করুণ পরিণতি থেকে আমরা এখনও শিক্ষা নিতে পারিনি। এর মূল্য হয়তো দিতে হতে পারে বহু প্রাণের বিনিময়ে।
সরকার ও স্বেচ্ছাসেবকগণ যদি পারেন কোটি মানুষের ঘরে খাবার পৌঁছে দিতে, তাহলে গার্মেন্টস মালিকরাও পারতেন ডিজিটাল লেনদেনের যুগে শ্রমিকদের মজুরি ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে।
সরকার ইতিমধ্যে শ্রমিকদের মজুরি পরিশোধের জন্য ৫,০০০ কোটি টাকার তহবিলও দিয়েছেন প্রনোদনা হিসেবে। ব্যাংক ঋণের কিস্তি শিথিল করেছেন, গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি প্রভৃতির বিল জরিমানা ছাড়া পরিশোধের মেয়াদ বাড়িয়েছেন। তাহলে কেন সমগ্র জাতিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলা?
সকলেই মনে হয় ভুলে গেছেন- আমরা কৃষক জাতি। ফসল ফলাতে পারি। ভোগ বিলাসিতা না করলেও প্রয়োজনীয় খাবারটুকুর সংস্থান নিজেরাই করতে পারি।
মানছি গার্মেন্টস শিল্প আমাদের অর্থনীতিতে অনেক অবদান রাখছে উন্নত জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবার জন্য। কিন্তু বর্তমানে এ রকম হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাদের সবাইকে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ফেলেছেন এবং আপনারাও কিন্তু নিরাপদ নন।
আমাদের দরিদ্র মানুষগুলোর কোনো দোষ নেই। আমরা কিছু মুনাফাখোর ও লোভী শিল্প মালিকরাই তাদের বিশ্বাস ও আস্থার জায়গাটা নষ্ট করেছি। নইলে সারা মাস খাটুনির পর প্রাপ্য বেতন-বোনাসের দাবিতে বার বার তাদের রাস্তায় নামতে হতো না। ভয়াবহ ভাইরাসের ঝুঁকি নিয়ে শত মাইল হাঁটতে হতো না। তারা শেষ আশ্রয়স্থল সৃষ্টিকর্তার ওপর বিশ্বাস রেখে পথ চলেছেন। হয়তো তিনিই রক্ষা করবেন সকল বিপদ-আপদ থেকে।
কাজেই যা হবার হয়ে গেছে। আরো কী কী বাকি আছে তা দেখার অপেক্ষায় থাকি আর প্রার্থনা করি “হে প্রভু দয়াময়, করোনা ভাইরাসে মৃতদের যেন বেহেশত নসীব হয়”।
লেখক: সম্পাদক ও প্রকাশক, ধূমকেতু.কম।