স্বাস্থ্য

যক্ষ্মার বিসিজি টিকার কারণেই কি বাংলাদেশে করোনায় মৃত্যু কম

নিজস্ব প্রতিবেদক, ধূমকেতু ডটকম: নতুন একটি গবেষণা বলছে, যক্ষ্মা প্রতিরোধের জন্য বিসিজি টিকা পাওয়া ব্যক্তিরা করোনাজনিত অসুস্থতায় কম ভুগেন। মারাত্মক ক্লান্তিও তাদের মধ্যে কম দেখা যায়। নেদারল্যান্ডস-ভিত্তিক ওই গবেষণায় দেখা গেছে, যক্ষ্মা প্রতিরোধের টিকা বিসিজির প্রভাব আছে করোনার ওপর। তবে বিসিজি টিকার কারণে করোনার সংক্রমণ কম হয় কি না, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। গবেষকরা বলছেন, এ নিয়ে বড় আকারের গবেষণা হওয়া দরকার।

বিসিজি (ব্যাসিলি কালমেটি-গুরেন) টিকা সহজাত রোগ প্রতিরোধক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ীভাবে বৃদ্ধি করে এবং শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের আশঙ্কা কমিয়ে দেয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শৈশবকালীন যক্ষ্মা প্রতিরোধে এই টিকা দেওয়া হয়। বাংলাদেশে ১৯৭৯ সালে শিশুদের বিসিজি টিকা দেওয়া শুরু হয়। বর্তমানে ৯৯ শতাংশ শিশু এই টিকা পায়।

নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্ক, গ্রিস ও জার্মানির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ২৪ জন বিশেষজ্ঞ এই গবেষণায় যুক্ত ছিলেন। ৫ আগস্ট তাদের গবেষণা প্রবন্ধটি চিকিৎসাবিজ্ঞান সাময়িকী সেল রিপোর্টস মেডিসিন প্রকাশ করেছে।

গত ডিসেম্বরে চীনের উহানে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দেওয়ার পর একসময় তা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনার সংক্রমণকে বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে ঘোষণা করে। বিশ্বের ২০৮টি দেশে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লেও সব দেশ ও অঞ্চলে তা সমানভাবে ছড়িয়ে পড়েনি। কোথাও সংক্রমণের হার বেশি, কোথাও মৃত্যুহার বেশি দেখা গেছে।

মহামারির শুরু থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা সংক্রমণের ধরণ ও কারণ বোঝার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে বেশ কয়েকটি ধারণা নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আলোচনা হতে দেখা যায়। এসব নিয়ে বিজ্ঞান সাময়িকীতে লেখা প্রকাশ পেতে থাকে।

গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলে বা বিসিজি টিকা পাওয়া জনগোষ্ঠীতে করোনার প্রকোপ কম দেখা যাচ্ছে— এসব ধারণা একসময় বেশ গুরুত্ব পেতে থাকে।

এপ্রিল মাসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছিল, করোনার ওপর বিসিজি টিকার প্রভাব নিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক কোনো তথ্য-উপাত্ত নেই। তবে বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য একাধিক গবেষণা চলছে।

নেদারল্যান্ডসে গবেষণায় ৪৩০ জনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে ২৬৬ জন ছিলেন বিসিজি টিকা নেওয়া। ১৬৪ জন বিসিজি টিকা পাননি। তবে টিকা পাওয়া ও না-পাওয়া সবাই করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। গবেষকেরা ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত দুই দফায় তাদের ওপর জরিপ পরিচালনা করেন।

গবেষকেরা দেখেছেন, বিসিজি দেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে করোনাজনিত অসুস্থতা তুলনামূলকভাবে কম। টিকা পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে জ্বর, মাথাব্যথা ও ক্লান্তিতে ভোগার হার কম দেখা গেছে। তবে সর্দি বা নাক দিয়ে পানি পড়ার প্রবণতা দুই দলেই প্রায় সমান দেখা গেছে।

গবেষকেরা বলছেন, করোনা মহামারিকালে বিসিজি টিকা নিরাপদ। এই টিকা কোনো মারাত্মক প্রদাহের কারণ হয়ে দেখা দেয় না। এই টিকা পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে করোনাজনিত অসুস্থতা ও মারাত্মক ক্লান্তি কম দেখা গেছে। তবে এই টিকা দেওয়ার কারণে করোনা সংক্রমণ কমে কি না, তা নিয়ে বড় ধরনের গবেষণা হওয়া দরকার।

বাংলাদেশে করোনায় আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যুহার ১ দশমিক ৩২। এই হার ইউরোপ বা আমেরিকার হারের চেয়ে কম। এমনকি ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে কম। প্রতিবেশী এই দুই দেশে মৃত্যুহার যথাক্রমে ২ ও ২ দশমিক ১। ওই দুই দেশে টিকাদানের হার বাংলাদেশের চেয়ে কম।

এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, বিসিজি টিকা নিয়ে একটি গবেষণার সুযোগ আমাদের দেশেও আছে। এ রকম গবেষণা হলে আমরাও দেশের করোনা পরিস্থিতি নিয়ে স্পষ্ট ধারণা পাব।

এ বিষয়ে নিউইয়র্ক ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির কলেজ অফ অস্টিওপ্যাথিক মেডিসিনের পক্ষ থেকে বলা হয়, পৃথিবীর যেসব দেশে বিসিজি টিকাদান কর্মসূচি নেই যেমন ইতালি, নেদারল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তবে দীর্ঘস্থায়ী টিকাদান কর্মসূচি যেসব দেশে চালু আছে ওইসব দেশের মানুষের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা কম।

গবেষণায় দাবি করা হয়, বিসিজি টিকা আসার পর থেকে বিশ্বে মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা হয়, মৃত্যুর হার বেশি হওয়ায় ১৯৮৪ সালে বিসিজি কার্যক্রম শুরু করে ইরান। দেশটিতে বিসজি টিকা দেয়া মানুষের মধ্যে করোনা ভাইরাসের উপস্থিতি তেমন একটা পাওয়া যায়নি।

এছাড়া ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রে বিসিজি টিকা না দেয়ার কারণে চীন এবং ভারতের চেয়ে করোনায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে গবেষণায় দাবি করা হয়। কারণ চীন এবং ভারতে বহুকাল ধরে বিসিজি টিকার প্রচলন রয়েছে।

আর এমন দাবির সঙ্গে মিলে যাচ্ছে বর্তমান পরিস্থিতিও। চীন থেকে করোনা ভাইরাসের উৎপত্তি হলেও এই ভাইরাসে সবচেয়ে বেশি মারা গেছে ইতালিতে। আর সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *