শম্পা কর, ধূমকেতু ডটকম: প্রকৃতি যে কী নিপুণ হাতে আমাদের এই দেশটাকে সাজিয়েছে বাংলার গ্রামে-গঞ্জে না ঘুরলে তা বোঝার উপায় নেই। সারিসারি গাছের ছায়াঘেরা পথ-ঘাট, বুনোফুলের ঝোপঝাড়, নদী-নালা, খাল-বিলের টলটলে জল, তাতে ফুটে থাকা নানা রঙবেরঙের জলজ ফুল, নৌকায় মাছ ধরার দৃশ্য, সব যেন পটে আঁকা। অপলক দৃষ্টিতে শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে।
একবার ভাবুন, ছায়া ঘেরা সরু পিচ ঢালা নিরিবিলি রাস্তা ধরে শীতল বাতাস গায়ে মাখতে মাখতে আপনি এগিয়ে চলছেন আর আপনার সাথে সাথে এগিয়ে চলছে রাস্তার দুই পাশে ফুটে থাকা শাপলা, পদ্ম শালুকের ঢেউ! আপনার মনে হবে কোনো এক ছবির দেশে চলে এসেছেন। আর যদি আপনার কবি বা শিল্পী মন হয় তাহলে হয়তো দুই একটা কবিতা লিখে ফেলবেন বা গান গেয়ে উঠবেন আপন মনে। বাস্তবেও আপনি ঠিক এমনই দৃশ্য দেখতে পাবেন গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ার মুসুরিয়া গ্রামে।
রাজধানী ঢাকায় থাকতেই বরিশাল আর তার আশে-পাশের অঞ্চলের নানা বিলের গল্প শুনেছিলাম, তার মধ্যে পদ্মবিলও ছিলো। পদ্ম বর্ষাকাল আর শরৎকালেই বেশি ফোটে। পদ্মবিল দেখারও উপযুক্ত সময় এটা। তাই বরিশাল আসার পর থেকেই পদ্মবিল দেখার তর সইছিলো না আর। আমার সফরসঙ্গীকে বলতেই সে বেশ উৎসাহে রাজী হয়ে গেলো। সে জানালো গতবছর সে গিয়েছিল। পদ্মবিল গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়া থানার মুসুরিয়া গ্রামে। তবে বরিশালের আগৈলঝড়া থানা থেকে খুবই কাছে।
আরো জানালো, পদ্মবিলে সূর্যদোয় দেখতে নাকি দারুণ লাগে, সাথে এই সময় ভালো ছবিও পাওয়া যায়। যেই কথা সেই কাজ। এক ভোরে বাইক নিয়ে আগৈলঝড়া থেকে রওনা হলাম দুজন। আপনারা চাইলে অটোরিক্সা বা ভ্যানেও যেতে পারবেন। যাহোক পয়সারহাট (বরিশাল আর গোপালগঞ্জের সীমানাবর্তী এলাকা) পৌঁছানোর পর বুঝলাম সফরসঙ্গীর পদ্মবিলের ঠিকানা খুব একটা ভালো মনে নেই। তবে আমার তার উপরে অগাধ বিশ্বাস, জানি যে করেই হোক পদ্মবিলে সে নিয়ে যাবেই। আমরা পয়াসাহাট ব্রীজ পাড় হয়ে হাতের ডানের সরু রাস্তা ধরে সামনে এগোতে থাকলাম। চারপাশে শুধু বিল আর বিল আর নানা রঙের শাপলা ফুটে আছে। দেখলাম ডিঙ্গি-নৌকা নিয়ে কেউ কেউ মাছ ধরছে আর কেউ তুলছে শাপলা, কলমি শাক। এগুলো স্থানীয় বাজারসহ আশেপাশের সব বাজারগুলোতে বিক্রি হয়। চাইলে এখান থেকে সদ্য ধরে নিয়া আসা তাজা মাছও কিনতে পারবেন আপনি।
একটু পরপর একটা দুটো বাড়ি আর ছোট ছোট বাজার পড়ছিল। এমন নয়াভিরাম দৃশ্য দেখতে দেখতে কখনো যে আপন মনে হারিয়ে গেছি বুঝতেই পারিনি। হঠাৎ বাইকের ঝাঁকিতে হুঁশ ফিরলো। দেখলাম সামনে শুধু কাদা-মাখা কাঁচাপথ আর পাশে একেবারেই সরু উঁচু আইল মতো, বাইক নিয়া যাওয়া প্রায় অসম্ভব! একজন পথচারীর কাছ থেকে জানা গেলো সামনের অনেকটা রাস্তার এমন অবস্থা। রাস্তার নির্মাণের কাজ চলছে।
আমরা মুসুরিয়া গ্রামের প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলাম। মাথায় পদ্মবিল দেখার নেশা। তাই পেছনে ফেরার কোনো অবকাশই ছিলো না আমাদের। তবে আপনারা ভয় পাবেন না, পয়সারহাট ব্রীজের নিচ থেকে, রামশীল কলেজের পাশে দিয়ে মুসুরিয়া গ্রামে যাওয়ার ভালো রাস্তা আছে। আমাদের জানা না থাকায় এই পথে চলে এসেছিলাম। যাহোক, আমি বাইক থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করলাম আর বাইকার ধরলো কাদা ঠেলে, সরু আইল ধরে বাইক নিয়ে সামনে এগোনোর পণ।
এদিকে পুব আকাশেও লাল আভা দেখা দিচ্ছে মানে সূর্য দেবতা উঠি উঠি করছে। বুঝলাম ভোরের সূর্যদোয় আর দেখা হবে না। কিছুক্ষণ পর আমরা সেই পথ পার হয়ে ভালো রাস্তা পেলাম। এরপর বাইক ছুটিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম মুসুরিয়া গ্রামে।
রাস্তা থেকেই দূরের পদ্মবিল চোখে পড়ছিল। শুরু হলো নৌকা খোঁজা। আগে রাস্তার পাশ থেকেই নৌকা পাওয়া যেত কিন্তু এবার পাওয়া যাচ্ছে না। জানা গেল- করোনার কারণে স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় এলাকার যুবকেরা এবার নৌকা চালানোর ভার নিয়েছে। তারা শৃঙ্খলার জন্য নৌকা ছাড়ার নির্দিষ্ট জায়গা নির্ধারণ করেছে, দিয়েছে সিরিয়াল নাম্বার। অবশেষে একটা বাড়ির পেছনের খালের পাড় থেকে আমরা নৌকা ভাড়া নিলাম। ছোট-বড় আর সময়ানুপাতে নৌকা ভাড়ার মূল্য বুঝে নেয় মাঝিরা। ভাড়া ১৫০-৫০০ পর্যন্ত গড়াতে পারে। এখানে সব ডিঙিনৌকা। লম্বা এক টুকরো বাঁশকে বৈঠা হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
আমরা যখন নৌকায় উঠলাম তখন সুর্য উঠে গেছে। তবুও খারাপ লাগছিলো না। নতুন দিনের নতুন সোনালী আলো পদ্মপাতায় চিকচিক করছিল। আমাদের টেকনিক্যালে পড়ুয়া তরুণ মাঝি জানায় বিকেলের দিকে এলে বেশি ভালো লাগে। শান্ত-ঠান্ডা জলে নৌকায় ঘোরার মজাই আলাদা। তবে পদ্মপাতায় সোনা-রাঙা লাউডগা সাপের রোদ পোহানো দেখতে চাইলে কিন্তু সকালেই আসতে হবে। মুগ্ধ চোখে দেখছিলাম আমি। পদ্ম আমার পছন্দের ফুল। এতো পদ্মফুল আমি একসাথে আগে কখনো দেখিনি। তারসাথে বড় বড় পদ্মপাতায় টলটল করছে শিশিরের জল আর তাতে চিকচিক করছে সূর্যের আলো! এ এক অপরূপ দৃশ্য! মনে পড়ে গেলো “জীবন সে তো পদ্মপাতায় শিশির বিন্দু” গানটা। গুনগুন করে দুই-লাইন গেয়েও ফেললাম। পরম আনন্দে ফুটে আছে পদ্মফুল আর তাতে ঘুরে ঘুরে মধু সংগ্রহ করছে মৌমাছি আর ভোমরেরা।
একটু পরই চোখে পড়লো সেই দৃশ্য “পদ্মফুলের মাথায় সাপ আর ভোমরেরা খেলা করে” যা আমি এতো দিন সাহিত্য সৃষ্ট কল্পনা দৃশ্যই মনে করতাম। দেখলাম ফুটন্ত পদ্মফুলের পাশেই পাদ্মপাতায় মাথা উঁচু করে আয়েসি ভঙ্গিতে শুয়ে আছে সোনালী রঙের সাপ আর পদ্মফুলের উপর উড়ছে হলুদ ভোমর। আমি অভিভূত! একের পর এক ছবি তুলছিলাম। আমাদের মাঝি হেসে বলে –“এ বিল ভরা এই লাউডগা সাপে। মাঝে মাঝে তো লাফ দিয়ে নৌকায়ও উঠে পড়ে”। প্রাণোঞ্জল তরুণ মাঝি সুঠাম দুই হাত দিয়ে কলমিলতার শক্ত বাঁধ ঠেলে নৌকা ঘন ফুলের দিকে নিতে থাকে আর নানা গল্প শোনায় আমাদের। কোনো এক ওঝার গল্প যে দূরে বসেই বলে দিতে পারতো সাপে কাটা রোগীটা বেঁচে আছে কিনা, তার পরিবার, আর সুখ-দুঃখের গল্প। জানায় বাংলার বিয়ার গ্রিলস হওয়ার শখ ছিলো তার। এমন কিছু ভিডিও বানিয়ে ফেসবুকেও দিয়েছিল কিন্তু কারা যেন রিপোর্ট করে সরিয়ে দিয়েছে। প্রমাণ দিতে গিয়ে সে বিলের জল খেয়ে দেখায়। তরুণ ছেলেটার সরলতা আমাদের মুগ্ধ করে। হাসতে হাসতে বলে- “নীলপদ্ম দেখেছেন আপনারা? নাম নীলপদ্ম বটে তবে তার রঙ কিন্তু নীল না”। সে আমাদের নীলপদ্ম দেখায়।
না না এই নীল পদ্মের রহস্য আমিও বলবো না, আপনারা এসে উৎঘাটন করবেন।
বিল জুঁড়ে শুধু সৌন্দর্য আর সৌন্দর্যই ছড়িয়ে আছে। আপনাদের চোখে পড়বে নানা জাতের পাখি বিলে উড়ে উড়ে খাবার খুঁজছে, মাছ লাফিয়ে লাফিয়ে পদ্মপাতায় উঠে পড়ছে। মাঝে মাঝে মাছ ধরার ভেসাল জাল পাতা। বিলের মাঝে বট আর কদম গাছে ছাওয়া, টিনের তৈরি ছোট্ট একটা মন্দিরও আছে। মন্দিরটা গঙ্গাদেবীর। চৈত্রমাসে যখন বিল শুকিয়ে যায় তখন এই মন্দিরে পূজা হয়। মেলাও বসে। দূরদূরান্ত থেকে লোকজন আসে নানা মানত দিতে আর পূজা করতে। কথিত আছে এই গঙ্গাদেবীর বরেই বিলে পদ্মফুল এসেছে। আপনারা চাইলে মন্দিরের পাশে নৌকা ভিড়িয়ে বটের ছায়ায় একটু জিরিয়ে নিতে পারবেন। একটু পরপর গায়ে হাওয়া দেবে শীতল বাতাস। আর হ্যাঁ বেশিক্ষণ বিলে থাকতে চাইলে সাথে নিয়ে নিতে পারেন পানি আর স্ন্যাকস। তবে বোতল আর প্যাকেটগুলো বিলের জলে ফেলবেন না। পরিবেশ রক্ষার দায় আপনারও।
আমরা বেশ কয়েক ঘন্টা কাটিয়ে পদ্মফুল হাতে আর মাথার গুঁজে ফিরে এলাম। এবার আর আমাদের ভুল হয়নি ভালো পথেই এসেছি। আমাদের বাংলার বিয়ার গ্রিলস দোকান থেকে চা-বিস্কুট খাইয়ে রামশীল কলেজ পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেল।
ঢাকা থেকে যেভাবে যাবেন পদ্মবিলে
ঢাকা থেকে বেশ কয়েকটি উপায়ে আপনারা পদ্মবিল যেতে পারবেন। ঢাকা থেকে কোটালিপাড়াগামী বাসে উঠে সোজা চলে আসতে পারেন কোটালিপাড়া। এরপর এখান থেকে ভ্যানে বা অটোরিক্সায় করে চলে আসতে পারেন পয়সারহাট। কোটালিপাড়া থেকে আসতে ভাড়া পড়বে জনপ্রতি ৩০-৫০টাকা। কিছু লোকাল বাসও আসে কোটালিপাড়া থেকে পয়সারহাট। এবার পয়সারহাট থেকে অটো বা ভ্যান রিজার্ভ করে যেতে হবে মুসুরিয়া গ্রামে। ভাড়া ৮০-১৫০ টাকা পড়তে পারে। এছাড়া ঢাকা থেকে চলে আসতে পারেন বরিশালের গৌরনদী বাসস্ট্যান্ড। এখান থেকে পয়সারহাট যাওয়ার অটো রিক্সা এবং মাহেন্দ্র পাবেন। ভাড়া পড়বে জনপ্রতি ৪৫-৫০ টাকা। বাসও পাওয়া যায় তবে অনেক দেরিতে দেরিতে। তাই বাসের আশা না করাই ভালো। পয়সারহাট থেকে আগের উপায়ে চলে যাবেন মুসুরিয়া গ্রামে। ঢাকা থেকে সরাসরি কিছু বাস পয়সারহাট আসে যেমন- গ্লোবান, গোল্ডেন লাইন। এই বাসে করেও চলে আসতে পারেন পয়সারহাট।
পুরো একদিন শুধু ঘোরাঘুরির জন্য হাতে নিয়ে আসলে পদ্মবিলের পাশাপাশি আরো অনেক কিছুই দেখতে পারবেন। যেমন সাতলার বিল, কবি সুকান্তের বাড়ি, আরো বেশ কিছু জায়গা।
আরো পড়ুন: