তাপস হালদার:
৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে অন্যতম ঐতিহাসিক দিবস। মুক্তিযুদ্ধে নতুন মাত্রা যুক্ত করে ভারত কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান। যখন ৯ মাস পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে শেষ মুহূর্তের লড়াই চলছিল, বাঙ্গালীরা যখন স্বাধীনতার জন্য অধীর আগ্রহে ব্যাকুল হয়ে মরণপণ লড়াই করে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই ভারত কর্তৃক স্বীকৃতিদান রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাসহ সকল বাঙ্গালীকে উজ্জীবিত করে তোলে। মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বিপুলভাবে বৃদ্ধি পায়।
বাংলাদেশের সর্বত্র শত্রুদের বিপক্ষে মুক্তি বাহিনী ও যৌথ বাহিনীর আক্রমণের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। পিছু হটতে থাকে হানাদার বাহিনী। এদিনেই শত্রুমুক্ত হয় যশোর, ঝিনাইদহ ও কুড়িগ্রাম জেলাসহ বাংলাদেশের অনেক অঞ্চল। মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় বাহিনীর যৌথ আক্রমণে যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে যায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী।
১৯৭২ সালের ৬ ডিসেম্বর দৈনিক বাংলা পত্রিকায় প্রকাশিত তাজউদ্দিন আহমদ একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের অনুরোধ জানিয়ে ১৯৭১ সালে ১৫ অক্টোবর শ্রীমতি ইন্দরা গান্ধীকে চিঠি লিখি। এরপর ২৩ নভেম্বর আরো একখানা চিঠি দেই। ভারতের বিরুদ্ধে ঘোষিত যুদ্ধের আগের দিন ২ ডিসেম্বর এবং ৪ ডিসেম্বর ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে আবারও বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী স্বাক্ষরিত চিঠি দিয়েছি।৬ ডিসেম্বর বেলা ১১টায় ভারতীয় পার্লামেন্ট বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের কথা ঘোষণা করার পর শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী আমাকে একখানা আনুষ্ঠানিক চিঠি দেন। ৭ ডিসেম্বর মঙ্গলবার বিকেল সোয়া ৩টায় মুজিবনগরে সেই চিঠি আমার হাতে এসে পৌঁছে।
৬ ডিসেম্বর বেলা ১১টায় ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’ থেকে ঘোষণা করা হয়, ভারত সরকার বাংলাদেশকে আনু্ষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। সেদিন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী লোকসভায় প্রস্তাবটি উত্থাপন করে বলেন, ‘ স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে বিশাল বাধার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রাম এক নতুন অধ্যায় রচনা করছে। সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করার পর ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’ স্বীকৃতির জন্য তিনটি কারণ বর্ণনা করা হয়।
(এক) বাংলাদেশের জনগণের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম শুরু হওয়ার ফলে পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে।
(দুই) প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের আশা-আকাঙ্খাকে প্রতিফলিত করছে এবং এই সরকার জনগণের সমর্থনের উপর প্রতিষ্ঠিত।
(তিন) ডিসেম্বরে পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে আক্রমণ করার ফলে ভারত ও বাংলাদেশের জনগণ একই শত্রুর আঘাতের শিকার হয়েছে এবং যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়েছে।
ইন্দিরা গান্ধীর বক্তব্য শেষ না হতেই ভারতের সংসদ সদস্যদের তুমুল হর্ষধ্বনি আর ‘জয় বাংলাদেশ’ ধ্বনিতে ফেটে পড়ে গোটা লোকসভা। এবং সর্বসম্মতভাবে প্রস্তাবটি পাশ হয়।
৪ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির জন্য বাংলাদেশ সরকার ইন্দিরা গান্ধীকে অনুরোধ জানিয়ে যে পত্রটি দেন, সেই পত্রের জবাবে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের বিষয়ে যে পত্র পাঠান তা হলো- “সত্যের জয় হোক প্রধানমন্ত্রী, নয়াদিল্লী ডিসেম্বর ৬, ১৯৭১; প্রিয় প্রধানমন্ত্রী, মহামান্য অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও আপনি ৪ঠা ডিসেম্বর আমাকে যে বাণী প্রেরণ করেছেন তাতে আমি ও ভারত সরকারে আমার সহকর্মীবৃন্দ গভীরভাবে অভিভূত হয়েছি। এই পত্র পাবার পর আপনার বিচক্ষণ নেতৃত্বে পরিচালিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি স্বীকৃতি প্রদানের অনুরোধ ভারত সরকার পুনরায় বিবেচনা করেছে। আমি সানন্দে জানাই, বর্তমানে বিরাজিত পরিস্থিতির আলোকে ভারত সরকার স্বীকৃতি অনুমোদনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। আমি একটি অনুলিপি সংযুক্ত করছি। আপনার বিশ্বস্ত ইন্দিরা গান্ধী।”
৩ ডিসেম্বর ভারতের ওপর পাকিস্তানের বিমান বাহিনীর আক্রমণই মূলত পরিস্থিতি দ্রুত বদলানোর পেছনে ভূমিকা রেখেছে। সেদিন থেকে পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধা ও যৌথবাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণে একের পর এক শহর ও এলাকা দ্রুত দখল হতে থাকে এবং পাক বাহিনীর কবল থেকে এক একটি এলাকা মুক্ত হয়।
নিজেদের পরাজয় ঠেকাতে পাক হানাদার বাহিনী তখন যুদ্ধের মাঠে এবং পাকিস্তান সরকার কূটনৈতিক পর্যায়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু যুদ্ধের মতই কূটনৈতিকভাবেও একের পর একটি পরাজয় হচ্ছিল। যুদ্ধে ভারতের অংশগ্রহণে পাকিস্তান নিশ্চিত পরাজয় দেখতে পায় সে জন্য জাতিসংঘের কাছে মধ্যস্ততার সুপারিশ করে ভারতকে যুদ্ধ বিরতিতে চাপ দেয়। এদিন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পাক-ভারত যুদ্ধ বিরতি প্রস্তাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্বিতীয় দফা ভেটো দেয়। পোল্যান্ড সোভিয়েত ইউনিয়নকে সমর্থন করে। ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য ভোটদানে বিরত থাকে। যার কারণে পাক-ভারত যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়।
একটি বিতর্ক চর্যিত বহুদিন থেকে, বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতিদানকারী দেশ নিয়ে। কেউ বলেছেন ভারত, আবার কেউ বলেন ভুটান। কিন্তু দুইটি দেশই ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, ভারতের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির কয়েক ঘন্টা আগে ভুটান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান করে। ভুটানের স্বীকৃতিদান ভারতের কূটনৈতিক কৌশলেই হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ও ভুটানে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ভারতীয় কূটনীতিবিদ ইন্দর পাল খোসলা একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “ভারত ও ভুটানের মধ্যে ১৯৪৯ সালে সই হওয়া ‘ফ্রেন্ডশিপ ট্রিটি’র প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ওই মৈত্রী চুক্তি অনুসারে ভুটানের প্রতিরক্ষা, বিদেশনীতি বা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভারতের একটা বলিষ্ঠ মতামত দেওয়ার সুযোগ ছিল। ফলে ভুটান তখন বিদেশনীতির ব্যাপারে ভারতের সঙ্গে পরামর্শ না করে কোনও স্বাধীন মতামত নিতো না। আর সেটা প্রয়োগ করেই কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ভুটানকে বলেছিলেন অবিলম্বে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে।
ভারত চেয়েছিল, যে দেশ সরাসরি ওই যুদ্ধে জড়িত, তার চেয়ে তৃতীয় কোনও দেশের থেকে স্বীকৃতি এলেই সেটা আন্তর্জাতিকভাবে বেশি গ্রহণযোগ্য হবে। এ বিষয়টা চিন্তা করেই ভারত সরকার ভুটানকে স্বীকৃতি দিতে অনুরোধ জানিয়েছিল।
৬ ডিসেম্বর থেকেই মুক্তির ক্ষণ গণনা শুরু হয়েছিল। তখন বিজয় শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা ছিল। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয়কে ত্বরান্বিত করেছিল ভারতের স্বীকৃতিদানই । স্বল্পতম সময়ের মধ্যেই অর্জিত হয়েছিল বিজয়, একটি লাল সবুজের পতাকা, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
লেখক: সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা।
ইমেইল: haldertapas80@gmail.com