পর্যটন ও পরিবেশ

চট্টগ্রামের প্রবেশদ্বার ‘মিরসরাই’ প্রকৃতিপ্রেমীদের স্বর্গ

লিমন নন্দী :

চট্টগ্রামের প্রবেশদ্বার মিরসরাই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বিশাল এক ভাণ্ডার। গ্রামীণ সংস্কৃতি, গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস-ঐতিহ্য আর মনোরম প্রাকৃতিক শোভায় রুপসী বাংলার অপরুপ মনকাড়া সৌন্দর্যে গড়া মীরসরাই উপজেলা। প্রকৃতির রূপ লাবণ্যে ভরা মীরসরাইয়ের দর্শনীয় স্থানগুলো প্রতিনিয়ত কাছে ডাকছে পর্যটকদের। অপার সৌন্দর্যমন্ডিত পর্যটন স্থানগুলো দেখে যে কেউ বিমোহিত হবেন। ঝর্ণার খনিও বলা হয় মিরসরাইকে! একদিকে পাহাড় অন্যদিকে সাগর। আর ভ্রমণপিপাসুরা চান এমনই একটি স্থান। আঁকা বাঁকা পথে পাহাড় ভ্রমণ কিংবা সাগর। কোলাহল মুক্ত এমনি একটি সাগরের খোঁজে ছুটে চলেন ভ্রমণপিপাসুরা। চট্টগ্রামের প্রবেশদ্বার ‘মিরসরাই’ যেন প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে স্বর্গ।

মিরসরাই মূলত ঝর্ণার জন্য বিখ্যাত। এই অঞ্চলে কম করে হলেও দশটি ট্রেইল আছে যেখানে প্রতিটি ট্রেইলে ছোটবড় মিলিয়ে ৪/৫ টি ঝর্ণার দেখা পাওয়া যায়-

রহস্যময় বোয়ালিয়া ট্রেইল:

মিরসরাই রেঞ্জ-এ যতগুলা ট্রেইল আছে, এর মধ্যে অন্যতম বিপদজ্জনক দুর্গম ট্রেইল হলো বোয়ালিয়া ট্রেইল। চারিদিক ঘন জঙ্গলে ঘেরা উচুঁ নিচু আঁকাবাঁকা  পথ ও সম পিচ্ছল পাথর পেরিয়ে ঝর্ণা দর্শনে আপনিও মুগ্ধ হয়ে ভুলে যাবেন দুর্গম পথের সব ক্লান্তি। এই বিপজ্জনক দুর্গম ঝিরি পথটাই এই ট্রেইলকে করেছে আরও আকর্ষণীয়। যাত্রাপথে বুঝতে পারবেন বোয়ালিয়া সম্পূর্ণ ট্রেইলটি নিজেই যেন একটা সৌন্দর্য! অপরূপ ঝিরিপথের সাথে যুক্ত হয়েছে একটু পর পর ছোট্ট ছোট্ট ঝর্ণা! ঝিরিপথের শুরুর দিকেই ডানদিকে গেলে ট্রেইলের মূল বা সবচেয়ে বড় ঝর্ণার দেখা পাবেন। বাকি ঝর্ণাগুলো বামদিকে।

এই ট্রেইলে দেখা মিলবে বুদবুদি, উঠান, পালাকাটা, আন্ধারমানিক, নহাতিকুম, লটকান, কেম্বাতলী, কলাতলী এবং সবচেয়ে বড় ঝর্ণা বোয়ালিয়াসহ অনেক ক্যাডসেটের।  তবে বর্ষার সময় একদিনে সব ঝর্ণা একই সাথে দেখা সম্ভব নয়।

এডভেঞ্চারে ভরপুর কমলদহ ট্রেইল :

মিরসরাই সীতাকুণ্ড মূলত ঝর্ণার জন্য বিখ্যাত। এই অঞ্চলে কম করে হলেও ১০টি ট্রেইলের দেখা পাওয়া যায়। এর মধ্য অন্যতম সুন্দর ও বিপজ্জনক ট্রেইল হলো কমলদহ ট্রেইল। এখানে বড় বড় চারটি ঝর্ণাসহ আরও ছোট বেশ কিছু ঝর্ণার দেখা মিলবে। পাহাড়ি ঝিরি পথ যেমন সুন্দর তেমনি বিপজ্জনক। এডভেঞ্চার প্রিয় মানুষের জন্য এই ট্রেইল সবসময় আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। তবে মূল এডভেঞ্চার শুরু হয় রূপসী ঝর্ণার (Ruposhi waterfalls)  পর থেকে। খাড়া পাহাড় দিয়ে, ঝর্ণার বুক চিরে আপনাকে এগিয়ে যেতে হবে। তবে আরও বিপজ্জনক হিসেবে ধরা দেয় ছাগলকান্দার পর থেকে। পাথুরে ঝিরিপথ, পাহাড়, ঝরনা সব মিলিয়ে প্রকৃতি যেন নিজ হাতে ঠেলে সাজিয়েছে এই সৌন্দর্য।

বুনো পথের সোনাইছড়ি ট্রেইল :

চট্টগ্রাম জেলার মীরসরাই পাহাড় রেঞ্জ এর হাদি ফকিরহাট বাজার এলাকায় অবস্থিত সোনাইছড়ি ট্রেইল। এই ট্রেইল বারৈয়াঢালা অভয়ারণ্যের আওতাভুক্ত। বৈচিত্র্যময় এই ট্রেইল পুরোমাত্রায় বুনো এবং পাথুরে! বর্ষায় এর দুর্গমতা বেড়ে যায় অনেক বেশি। তিন্দুর মত বড় বড় পাথর, বাদুজ্জাকুমের ভয়াবহতা টেনে নিয়ে যায় অ্যাডভেঞ্চার প্রেমীদের। বৃষ্টি বা বর্ষায় বেশ পিচ্ছিল হয়ে যায় পাথরের বড় বড় বোল্ডারগুলো। একদিনে এর মধ্যে ট্রাকিং, এডভেঞ্চার সবই পাবেন এই ট্রেইলে। এই ট্রেইলে বিশাল বিশাল সাইজের পাথর পাড়ি দিলে অন্যরকম অনুভূতি হবে।

এই ট্রেইলে আরও দেখতে পাবেন বাদুড়ে কুম অর্থাৎ দুই পাহাড়ের গিরিপথে অসংখ্য বাদুড়ের ডানা ঝাপটে উড়াউড়ি। ট্রেইলের শেষ প্রান্তে ঝর্ণাও আছে।

আট স্তরের খুইয়াছড়া ট্রেইল : 

ঝম ঝম শব্দে বয়ে চলা ঝর্ণাধারায় গা ভিজিয়ে মানুষ যান্ত্রিক জীবনের অবসাদ থেকে নিজেকে ধুয়ে ফেলে সজীব করে তার নাম খৈয়াছরা ঝর্ণা। পাহাড়ের সবুজ রং আর ঝর্ণার স্বচ্ছ জল মিশে মিশে একাকার হয়েছে মিরসরাইয়ের প্রাকৃতিক জলপ্রপাত খৈয়াছরা ঝর্ণায়। প্রকৃতির নান্দনিক তুলিতে আঁকা এ ছবি দেখে মুগ্ধ হচ্ছে দেশের ভ্রমণ পিয়াসী মানুষ। মিরসরাই সীতাকুন্ড রুটের সবচেয়ে জনপ্রিয় ট্রেইল এটি। এখানে রয়েছে ৮ স্টেপ বিশিষ্ট ঝর্ণা। আরো উপরে গেলে ডাবল ফলস। খৈয়াছড়ার ঝর্ণার সবগুলো স্টেপ ছাড়িয়ে আরো অনেকটুকু গেলে শেষ সীমা “আমতলী কুম” , সেখান থেকে হাতের ডানপাশে (দক্ষিণ) একটি চিকন ঝিরি। সেই পাথুরে সংকীর্ণ ঝিরিপথে একটু এগুলে পাবেন ৩ স্টেপ বিশিষ্ট “শিমুলতলী ঝর্ণা”।

মহামায়া লেকের রংধনু :

শরতের মোহনীয় সাজে সেজেছে প্রাকৃতিক রূপবৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ মহামায়া লেকের চারিধার, ভাদ্রের বর্ষণমুখর বৃষ্টির ছন্দে মহামায়া লেকের সৌন্দর্য আরেক নতুনরূপ ধারণ করেছে সম্প্রতি। এবারের শরতের রূপের সৌন্দর্যে অবগাহন করতে দর্শনার্থীরা যেন মাতোয়ারা। যে-ই এখানে আসছে হচ্ছে বিমোহিত। বিমুগ্ধচিত্তে সে প্রকৃতির কোলে নিমজ্জিত হচ্ছে ভিন্ন সত্তায়। রূপরানী চট্টলার প্রবেশদ্বার মিরসরাইতে গড়ে ওঠা দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মহামায়া লেকে সম্প্রতি দর্শনার্থীদের ভিড় বর্ণনাতীত।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাস্তবায়ন করা এই সেচ প্রকল্পে দিন দিন নজরকাড়া রূপ দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসছে অগণিত দর্শনার্থী। ভাদ্রের এই ভরা বর্ষায় প্রকল্পটি ভিন্ন রকম সাজে এখন। পুরো লেক জলে টুইটুম্বুর। অতিরিক্ত পানি ইনটেক স্ট্রাকচার দিয়ে ছেড়ে দেয়ায় তা হয়েছে নয়নাভিরাম স্রোতস্বিনী। দর্শনার্থীরা সেখানে ব্লকের ওপর গড়িয়ে পড়া জলে সৃষ্টি হওয়া ক্ষুদে জলপ্রপাতে আনন্দে কেউ হাঁটছে, কেউ খেলছে, কেউ ঝরনার জলে স্নানে মত্ত। প্রায় ১০ বর্গ কিলোমিটার লেকের জলে অনেকে নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। লেকের বিভিন্ন অংশে পাহাড়ের চূড়া, বনানী, সারি সারি বাগান, জুম চাষ, পাহাড়ি রকমারী ফুলের মেলা, ঝোপে ঝোপে মাছরাঙ্গা আর বকের শিকারি মগ্নতার দৃশ্য। এ ছাড়া অতিথি পাখি, পানকৌড়ি দর্শনার্থীদের বিমোহিত করে। যে যার মতো ছোট্ট ডিঙ্গি কিংবা সপরিবারে বড় নৌকা নিয়ে লেকে সারাবেলা ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনেকে ছুটে যাচ্ছে গহিন বনের নানা দৃশ্য অবলোকন করে ঝরনা দেখতে। অনেকাংশে সিলেটের মাধবকুণ্ডের মতো দৃষ্টিনন্দন এই ঝরনা যে কোনও দর্শনার্থীকেই করছে বিমুগ্ধ।

পাখির কলতানে মুখর বাওয়াছড়া :

পাহাড়িয়া সবুজ গাছের সমারোহ অতিথি পাখিদের কলতান কার না মন জুডায়। শিশু থেকে বৃদ্ধ যে কেউ মুগ্ধ হবেন বাওয়াছড়া দেখে। সে যেন সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি পর্যটকদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। চট্টগ্রাম শহর থেকে ৪০ কিলোমিটার উত্তরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মিরসরাইয়রে ছোট কমলদহ বাজার থেকে দেড় কিলোমিটর পূর্বে পাহাড়ের পাদদেশে এ স্পটের অবস্থান। নীল আকাশের বিশালতার নিচে সবুজের সমারোহ। দুই পাশে থাকা বনাঞ্চলের দিকে তাকালে হয়তো সহজেই দেখা যাবে জীববৈচিত্র। দেখা যাবে শেষ বিকেলের সূর্যের আলো যখন লেকে পড়ে তখন দূর থেকে মনে হয় পুরো প্রকল্পটি যেন একটি পর্যটন কেন্দ্র। মনোমুগ্ধ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের চাদরে ঢাকা প্রকল্পটিতে ঝর্ণার পানি আছড়ে পড়ছে। চিকচিক বালুতে যেন সকালের মিষ্টি রোদ আলো ছড়ায় আর অস্তগামী সূর্যের লালিমা মাখা অনন্ত ছায়া যেন ঢেলে দেয় দিগন্তজুড়ে। অপরূপ বাওয়াছড়া স্বর্ণালি স্বপ্নের মতোই বর্ণালি শোভাঘেরা সৌন্দর্যপিপাসু পর্যটন। এখানে এলেই বাওয়াছড়ায় মনমোহনী রূপ তাদের আকৃষ্ট করবে।

 নাপিত্তাছড়া ট্রেইল :

মিরসরাই রুটের অন্যতম সুন্দর একটি ট্রেইল নাপিত্তাছড়া ট্রেইল। নাপিত্তাছড়া, বাঘবিয়ানী ও বান্দরকুম ও কুপিকাটাকুম নামে চারটি ঝর্ণা এই ট্রেইলে। ঢাকা থেকে নামবেন মিরসরাইয়ের পর নয়াদুয়ারী বাজারে।

হরিণমারা হাঁটুভাঙ্গা  ট্রেইল :

এই ট্রেইলটা মিরসরাই রুটের অন্যতম সুন্দর একটি ট্রেইল। এই ট্রেইলে পাবেন হরিণমারা, হাঁটুভাঙ্গা এবং সর্পপ্রপাত ঝর্ণা। এছাড়াও সর্পপ্রপাতের পাশে বাওয়াছড়ার মুখ। এই রুটে ঢুকতেই পাবেন অপূর্ব নীলাম্বর লেক।

ঝরঝরি ট্রেইল :

সীতাকুন্ড ও মিরসরাই অঞ্চলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুন্দর ট্রেইল এটি। এটি মিরসরাই সীতাকুন্ড অঞ্চলের সবচেয়ে লম্বা ট্রেইল। তবে এটি অপরিচিত ট্রেইল। অপূর্ব সব ঝর্ণা ক্যাসকেড এবং ঝিরিপথের সমন্বয়ে এই ট্রেইল। ঢাকা থেকে নামবেন সীতাকুন্ডের পন্থিছিলা বাজারে। ওখান থেকে হেঁটে পূর্ব দিকের রাস্তা ধরে আধা ঘন্টা হেঁটে ঝিরিপথ ধরবেন।

পাহাড়, সমুদ্র, ঝরনা, ঝিরিপথ, সুবিশাল পাথর, লেক, প্রাণবৈচিত্র্যে ভরপুর মিরসরাইয়ের প্রতিটি অঞ্চল। সরকারের পর্যটন পরিকল্পনার আওতায় এই এলাকটিকে নিয়ে আসলে দেশের অন্যতম সেরা পর্যটনের জায়গা হতে পারে এই অঞ্চলটি। তবে যেখানেই ভ্রমণ করি না কেন, পরিবেশের প্রতি আমাদের সচেতন হতে হবে, যেখানে সেখানে ময়লা ফেলা যাবে না। তবেই পরবর্তী প্রজন্ম এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবে।

আরো পড়ুন:

পর্যটনে অপার সম্ভাবনাময় সুসং দুর্গাপুর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *