অভিমত

মানুষ কচু কিনে খায় অতি সুখাদ্য, কচুরিপানাও উঠবে জাতে যদিও গোখাদ্য

খোকন কুমার রায়:

এমন খাদ্য সংকটে বোধ হয় পৃথিবী আগে কখনো পড়েনি। কাড়ি কাড়ি টাকা থাকা সত্ত্বেও মানুষ গৃহবন্দী, দোকানপাট বেশিরভাগই বন্ধ, বা খোলা থাকলেও ঝুঁকি নিয়ে যাওয়ার সাহস নেই। ভয়- “করোনা”।

এক অদ্ভূত সময় পার করছি আমরা সবাই। আগামীর পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সংকট হবে বোধ হয় খাদ্য সংকট এবং মহামারীতে যত মানুষ মারা যাচ্ছে তার চেয়ে বেশি মারা যেতে পারে খাদ্যের অভাবে এবং পুষ্টিহীনতায়।

ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় টাকা-পয়সা, ধন-দৌলতই মুখ্য। যাদের আছে তারা আলিশান হালে, আর যাদের নেই তারা অনাহারে বা অর্ধাহারে। এই ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার নিদারুণ চিত্র বিশ্ববাসী দেখতে শুরু করেছে এবং নিকট ভবিষ্যতে আরো দেখবে।

এই দুনিয়ার বেশিরভাগ মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণ হয় না অর্থাভাবে। এদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম এবং অসুস্থ থাকলেও প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারে না। বিশ্বজুড়ে সম্পদের এক চরম অসম বণ্টন রয়েছে এবং এর ভয়াবহ ফল পেতে যাচ্ছে গোটা বিশ্ব। সৌভাগ্য যে আমাদের দেশ এখনো উন্নত দেশগুলোর মতো চরম ধনতান্ত্রিক হয়নি। মিশ্র ব্যবস্থায় পরিচালিত হচ্ছে। যে কারণে টিসিবি’র মতো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্যোগ, মূল্যস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে থাকে।

পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো আমরাও খাদ্য সংকটে পড়তে পারি যদিও আমাদের কৃষি ব্যবস্থা ও উৎপাদন তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থানে রয়েছে। কিন্তু এ উৎপাদন কার্য যদি কোনো কারণে ব্যাহত হয় তাহলে বিপুল সংখ্যক মানুষের আহারের ব্যবস্থা করাই আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

এ ক্ষেত্রে মানুষের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনে নজর দিতে হবে। যেমন- আমাদের আদিবাসী সম্প্রদায়ের খাদ্যাভ্যাসের দিকে যদি নজর দিই তাহলে বুঝতে পারবো আমরা সাধারণত যেসব খাবার খাই না যেমন- বাঁশ কোরল, কলার থোর, কাঁঠাল মুচি, কেশর আলু বা ঠান্ডা আলু, সাংফোয়া, তোজাহ, নানান রকম শাকপাতা ও অন্যান্য পাহাড়ি প্রাকৃতিক খাবার; তারা সেগুলো খেয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী টিকে আছে। পাহাড়ে গিয়ে আমরা অনেকেই এই অপ্রচলিত খাবারগুলোর স্বাদ নিয়েছি এবং নিঃসন্দেহে সুস্বাদু ও পুষ্টিকর খাবার বলে মনে হয়েছে।

অনেক দিন আগে “বেশি করে আলু খান, ভাতের ওপর চাপ কমান” এটি একটি স্লোগান হয়ে গিয়েছিল এবং আলু থেকে নানান রকম সুস্বাদু খাবার বানানোর ব্যাপারে জনগণকে যথেষ্ট উৎসাহ দেয়া হয়েছিল।

কিছুদিন আগে আমাদের মাননীয় পরিকল্পনা মন্ত্রী জনাব এম এ মান্নানের একটি উক্তি বেশ ব্যাঙ্গাত্মক সমালোচনার মুখে পড়েছিল। তিনি বলেছিলেন, কচুরিপানার মতো সহজলভ্য উদ্ভিদগুলোকে নিয়ে গবেষণা করতে, যাতে বিকল্প পুষ্টিকর খাদ্য তৈরি করা যায়। উনার প্রস্তাবটি যথার্থই ছিল যা আমরা নিকট ভবিষ্যতে আরো ভালো বুঝতে পারবো।

মানুষের খাদ্যাভাস পরিবর্তনে দরকার ব্যাপক প্রচারণা ও বিকল্প খাবারের সহজলভ্যতা। বর্তমানে আমরা দেখতে পাচ্ছি ১০ কেজি চালের সাথে হয়তো ২ কেজি আলু দেয়া হচ্ছে। তা না করে ১০ কেজি আলুর সাথে যদি ২ কেজি চাল দেয়া হয় তাহলে কী হবে? খাবারে ভাতের চেয়ে আলুর পরিমাণ বেশি থাকতো এবং পুষ্টির চাহিদাও পূরণ হতো। আর বাঁচার তাগিদে মানুষ এ সমস্ত খাবার খেতে বাধ্য।

নানান রকম আলুর উৎপাদন আমাদের যথেষ্ট এবং দামেও চালের চেয়ে সস্তা ও সহজলভ্য। আলু মোটামুটি অপচনশীল এবং প্রয়োজনে দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায়। কাজেই আমাদের বিকল্প সহজলভ্য ও দামে সস্তা খাদ্যসামগ্রীর সংস্থান ও ব্যবহারে জোর দিতে হবে। আমাদের মানুষকে বিকল্প খাবারে অভ্যস্ত করতে হবে যেমনটা ইতিমধ্যে করেছে পশ্চিমা ফাস্টফুড- বার্গার, স্যান্ডউইচ, চিকেন ফ্রাই প্রভৃতি নানান প্রচারণা ও চটকদার বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে।

বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি ত্রাণে বিকল্প ও অপ্রচলিত খাবারগুলো যদি বরাদ্দ করা যেত তাহলে হয়তো অনেক মানুষের খাদ্যাভ্যাস কিছুটা হলেও পরিবর্তিত হতো।

কাজেই আসুন- আমরা অপ্রচলিত বিকল্প খাবারের সংস্থান করি, মানুষের অভ্যাসগুলোকে বদলে দিই এবং আসন্ন খাদ্যাভাব দূর করি। সবাই মিলে একসাথে বাঁচি।

আমাদের অর্থনীতিতে কৃষিনির্ভরতা আবার ফিরিয়ে আনার সময় বুঝি এসে গেছে।

লেখক: সম্পাদক ও প্রকাশক, ধূমকেতু.কম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *