তাপস হালদার::
কোভিড মহামারির কারণে সারা বিশ্ব গভীর সংকট মোকাবেলা করছে। সবচেয়ে সংকটে পড়বে অর্থনীতি। কোটি কোটি লোক চাকুরি হারাবে, বেকারত্ব বাড়বে, শ্রমজীবী মানুষের আয় কমে যাবে, দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাবে একশ কোটির বেশি মানুষ- এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংকসহ বড় বড় অর্থনীতিবিদগণ। এমন একটি কঠিন সময়ে মানুষের জীবন ও জীবিকার চ্যালেঞ্জকে সামনে রেখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার অদম্য সাহস ও দৃঢ় নেতৃত্বে “অর্থনৈতিক উত্তরণ ও ভবিষ্যত পরিকল্পনা”শিরোনামে ১১ জুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ৫ লক্ষ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেন। গত বছর যা ছিল ৫ লক্ষ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা।
বাজেট বাস্তবায়িত হলে প্রবৃদ্ধি হার ৮.২ শতাংশ হবে বলে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এটা নিয়েই বিএনপি জোটসহ তাদের অর্থনীতিবিদেরা হইহই করে উঠলেন যে, এটা কোনোমতেই সম্ভব নয়।
আরও পড়ুন: কী আনন্দ ! কী আনন্দ ! লকডাউন গেছে খুলে, উন্মাদনায় ছুটে বেড়াই, করোনার অস্তিত্ব ভুলে!
১৮ জুন এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিপি) তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলেছে, ২০২১ সালে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার ৭.৫ শতাংশ হবে। যা এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ। এ থেকেই প্রমাণ হয়, দেশরত্ন শেখ হাসিনার সরকার কোনো মিথ্যা কথা বলে না, মিথ্যা আশ্বাস দেয় না।
বাজেট হচ্ছে একটি রাষ্ট্রের আয়-ব্যয়ের হিসাব। একটি নির্দিষ্ট বছরে কোথায় কত ব্যয় করা হবে সেই মোতাবেক আয়ের খাতগুলোও নির্ধারণ করা হয়। একটি পরিবারেও যেমন আয়-ব্যয়ের হিসাব করে চলতে হয় তেমনি রাষ্ট্রেরও আয়-ব্যয় হিসাব করতে হয়। তবে ব্যক্তির সাথে রাষ্ট্রের একটি মৌলিক পার্থক্য আছে। ব্যক্তি আগে আয় করে,পরে ব্যয় করে। ঠিক তার উল্টোটা করে রাষ্ট্র। আগে ব্যয় করে, পরে ঠিক করে কোন কোন উৎস থেকে টাকা জোগান দিতে হবে। আগে বাজেট পেশের পরই শুনতাম গরীব মারার বাজেট মানি না, মানব না। এ বাজেট ধনীকে আরও ধনী করবে, গরীবকে আরও গরীব করবে। ইদানীং তাদের সুর বদল হয়েছে। তারা হয়ত বুঝেছে এ বক্তব্য আর চলবে না। কারণ জননেত্রী শেখ হাসিনার বর্তমান সময়ের আমলে দারিদ্র্য ৪২ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশে নেমে এসেছে। তাই বলে বাজেটের সমালোচনা করবে না, সরকারের সমালোচনা করবে না, তা কী করে হয়!
এখন সমালোচনার ধরণ বদলিয়েছে। বাজেট উচ্চাভিলাসী, বাজেট বাস্তবায়নযোগ্য নয়। কর আদায়যোগ্য নয় ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমি অর্থনীতির মার-প্যাঁচ বুঝি না, অতি সাধারণ একজন মানুষ। আমি বাজেট বলতে বুঝি সাধারণ মানুষের নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে কিনা? দেশের সাধারণ মানুষের জন্য কী কী সুবিধা দেয়া হয়েছে। এবার বাজেট পেশের পরই বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়েনি, বাজার স্থিতিশীল আছে। তাই একবাক্যে আমি বলব ভাল বাজেট।
বাজেটে দাম কমতে পারে এমন খাতগুলো হলো- এলজিডি সিলিন্ডার, সরিষার তেল, চিনি, করোনাভাইরাস মোকাবেলার জন্য মাস্ক, গ্লাভস, পিপিই, ভেন্টিলেটর, এ সংক্রান্ত যন্ত্রপাতির শিল্পের কাঁচামাল আমদানি, কৃষি যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ, কাগজ, কীটনাশক, সার, বীজ, ঔষধ ইত্যাদি।
দাম বাড়তে পারে এমন খাতগুলো হলো- তামাক জাতীয় পণ্য, আমদানি করা অ্যালকোহল, অনলাইন কেনাকাটা, আসবাবপত্র, প্রসাধন সামগ্রী, গাড়ির নিবন্ধন, চার্টার্ড বিমান ও হেলিকপ্টার ভাড়া, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত লঞ্চ সার্ভিস, আলোকসজ্জা ইত্যাদি।
তালিকাগুলো দেখেই বুঝা যায় সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করেই বাজেট করা হয়েছে। এটা বুঝতে আর অর্থনীতিবিদ হওয়া লাগে না।
করোনা পরিস্থিতিতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে নিম্ন-মধ্যম আয়ের লোকজন। সেজন্য বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর মাধ্যমে সমাজের পিছিয়ে পড়া ও নতুনভাবে দারিদ্র্যসীমার নিচে যাওয়া মানুষের কথা বিবেচনা করে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ৯৫ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। নতুন করে আরো ১১ লক্ষ ৫ হাজার উপকারভোগীর তালিকা করার কথা বলা হয়েছে। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাতে অগ্রাধিকার দেয়া হবে, সেটাই ছিল স্বাভাবিক। এ খাতে ৪১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। যদি প্রয়োজন হয় জরুরী পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য আরো ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। করোনা পরিস্থিতি দীর্ঘ হলে কর্মহীন লোকের সংখ্যা বাড়তে পারে সেজন্য বেকার যুবকদের জন্য দুই হাজার কোটি টাকা ঋণ সুবিধা রাখা হয়েছে। ১ কোটি লোকের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রস্তাবিত ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের মধ্যে ৯৩টির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কৃষি খাতে সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
তবে এবারের বাজেটে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে কালো টাকা সাদা করার ব্যবস্থা রাখার জন্য। অর্থমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন, নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করা যাবে। কালো টাকা মানে অপ্রদর্শিত অর্থ। আপনি যে টাকার কর দেননি। সেটা আপনার বৈধ আয় হতে পারে। বার্ষিক করমুক্ত আয় ধরা হয়েছে ৩ লক্ষ টাকা (অর্থ্যাৎ মাসিক ২৫ হাজার টাকার উপরে যাদের আয় তাদেরকেই কর দিতে হবে)।
গত বছর কর দিয়েছে মাত্র ২২ লক্ষ লোক। অথচ ১৬ কোটি জনসংখ্যার দেশে ১ কোটি লোকের কর দেয়ার সক্ষমতা আছে। বাদ বাকি যে লোকগুলো কর দেয়নি মূলত তাদেরকে প্রলুব্ধ করার জন্যই এই ঘোষণা। এরা যে প্রত্যেকেই অবৈধ সম্পদের মালিক তা নয়। এর মধ্যে যদি কিছু দুষ্ট লোক সুবিধা নিতে চায় তাদের জন্য তো দুদক রেডি আছে।
যারা গলাবাজি করেন তাদের অতীত স্মৃতি এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে চলবে না। জনগণ কিন্তু এত সহজে ভুলে না। বেগম খালেদা জিয়া নিজে এবং তাঁর অর্থমন্ত্রী কিন্তু কালো টাকা সাদা করেছিলেন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী করোনা প্রাদুর্ভাবের পর ইতিমধ্যে যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন তাকেও অন্তবর্তীকালীন বাজেট বলা যেতে পারে। ১৯টি প্যাকেজে ১ লক্ষ ২ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকার প্রণোদনা দিয়েছেন। যা জিডিপির ৩.৭ শতাংশ। যা বিশ্বের কোনো দেশ করতে পারেনি।
অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন নয়, এবারের বাজেটে মানুষকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। মানুষ না থাকলে বাজেট কার জন্য? বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকে মানুষকে বাঁচাতে হবে। এবারের বাজেট মানুষকে রক্ষা করার বাজেট।
লেখক- তাপস হালদার: সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ এবং সাবেক ছাত্রনেতা।