লায়লা নাজনীন:
স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল, হ্যাঁ কথাটি একদম খাঁটি এবং তা আমরা ততক্ষণ পর্যন্ত বুঝতে পারি না যতক্ষণ আমরা সুস্থ থাকি। একমাত্র অসুস্থ অবস্থাতেই আমরা বুঝতে পারি জীবনে টাকা-পয়সা, খ্যাতি ধন দৌলতের চাইতে সুস্থ থাকা যে কত গুরুত্বপূর্ণ। আর এই করোনা ক্রান্তিকালে এটাই আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। যখন অর্থবৃত্ত থাকা সত্ত্বেও আমরা জীবিত থাকতে পারছি না। এই সময়ে যারা আগে থেকেই অসুস্থ এবং বডি ইমিউনিটি কম তাদেরই পরাজয় সবচাইতে বেশি। তাই সর্বদা স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন থাকা উচিত।
যদিও ইদানিং আমরা শারীরিক সুস্থতার প্রতি সচেতন হয়েছি কিন্তু এখনো মানুষ মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি ততটা সচেতন নয়, মানসিক স্বাস্থ্যের দরুণ একজন মানুষ সেই ক্ষমতা অর্জন করে, যা তাকে নিজের সঙ্গে এবং তার চারপাশে থাকা অন্যান্যদের সঙ্গে যুক্ত হতে বা একাত্ম হতে সাহায্য করে। শুধু তাই নয়, এই দক্ষতার জোরে মানুষ তার জীবনের নানাবিধ চ্যালেঞ্জকেও গ্রহণ করতে সক্ষম হয়।
মানসিক স্বাস্থ্যের ধারণার সঙ্গে মানসিক দুর্বলতা বা অস্বাভাবিকতার কোনও সম্পর্ক নেই। পেনডেমিক এর কারণে মানুষকে লকডাউন এ থাকতে হয়েছে। তাছাড়া যারা এই সময়ে অফিস করেছেন সারাক্ষণ করোনা আক্রান্ত হওয়ার ভয়, মৃত্যুভয়, চাকরিচ্যুতির ভয়, চাকরিচ্যুতি, সব কিছু মিলিয়ে মানসিক বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে সময় পার করছেন। তাই এখন মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সিরিয়াস হওয়ার সময় হয়েছে।
আসুন জেনে নেই এই মানসিক স্বাস্থ্য কী?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতে, মানসিক স্বাস্থ্য হলো শরীর, মন এবং সমাজের ভাল দিকগুলির মেলবন্ধন। এই ভাবনার সঙ্গে রোগ বা দুর্বলতার দিকটি যুক্ত নয়। ‘হু’ আরও বলেছে যে, সুচিন্তার অধিকারী মানুষ তার দক্ষতা বাড়াতে সব সময়ই সচেষ্ট, এই দক্ষতাই তাকে জীবনের বিপর্যয়গুলির মোকাবিলা করে সুস্থ, স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে সাহায্য করে, উৎপাদনশীল কাজে সে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারে এবং নিজের গোষ্ঠী ও সমাজের জন্যও অবদান রেখে যেতে পারে।
মানসিক স্বাস্থ্য কিভাবে ভালো রাখা যায়?
১. ইতিবাচক মনোভাব গড়ে তোলা: মানুষের ভালো দিক নিয়ে সব সময় আলোচনা করা, মন্দ বিষয়গুলো এড়িয়ে যাওয়া।
২. বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনের সাথে যোগাযোগ: প্রতিদিন সময় করে বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনের সাথে নিয়মিত ফোন আলাপ ও ভিডিও চ্যাটিং এর মাধ্যমে যোগাযোগ রাখা। সময় করে বন্ধুদের সাথে গ্রুপ চ্যাটিং বা আড্ডা দেয়া যেতে পারে।
৩. পরিবারের জন্য নতুনত্ব কিছু করা: যেমন পরিবারের মানুষকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্যে তাদের পছন্দের কোনো মজার ডিশ রান্না করতে পারেন বা তাদের জন্য ছোটোখাটো কোনো গিফট এর ব্যবস্থা করতে পারেন।
৪. পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমানো।
৫. ফযরের নামাজের পরে ফ্রেশ এয়ারে কিছুক্ষণ হাঁটা, প্রাণখুলে নিঃশ্বাস নেয়া।
৬. নিজেকে ব্যস্ত রাখা।
৭. প্রতিদিনের কাজগুলো যাতে একঘেঁয়েমি না হয় সেই দিকে খেয়াল রাখা।
৮. সোশ্যাল মিডিয়ার নেগেটিভ বিষয়গুলো থেকে নিজেকে দূরে রাখা।
৯. প্রতিদিন চিত্তবিনোদনের জন্য সময় রাখা।
১০. গল্পের বই পড়া।
১১. যা কিছুই করবেন কনফিডেন্স নিয়ে করা।
১২. কেউ মিসবিহেভ করলে বা কারো প্রতি ক্ষোভ থাকলে সেটা নিয়ে বেশিক্ষণ না ভাবা এবং ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করা।
১৩. প্রতিদিন সময় বের করে নিজের শখগুলোকে সময় দেয়া যেমন- যদি আপনার গান গাইতে ভালো লাগে তবে তা করা, পেইন্টিং, রাইটিং, ড্যানসিং, লিসিনিং সং, ওয়াচিং মুভি, কুকিং যেটা ভালো লাগে প্রতিদিন সময় বের করা।
১৪. গাছ-গাছালি, পেট- লাইক, ক্যাটস, ডগস, বার্ড থাকলে এদের পরিচর্যায় সময় কাটানো।
১৫. সমাজসেবামূলক কাজে সময় বের করা।
১৬. বাজে খাদ্যাভ্যাস পরিত্যাগ করা।
১৭. ব্যায়াম বা মেডিটেশন করা।
১৮. মুসলিমরা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ এবং অন্য ধর্মাবলম্বীগণ তাদের ধর্ম অনুযায়ী প্রার্থনা করা।
১৯. মনকে সর্বদা প্ৰফুল্ল রাখা, সর্বদা হাসিখুশি থাকা, চাইলে মাঝে মাঝে হাসির নাটক, কমেডি শো বা কমিস বুক পড়তে পারেন।
২০. লার্নিং এন্ড স্কিল ডেভেলপ এ সময় বের করা।
২১. এমবিশন এবং ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে আলাপচারিতা করা।
২২. ভবিষৎতে কী হবে সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা না করে বর্তমানকে নিয়ে খুশি থাকা।
২৩. পরিবারের মানুষের সাথে সদাচারণ করা। কাজের লোক, বাসার সিকিউরিটি গার্ড সবার সাথে হাসি মুখে কথা বলা।
২৪. অফিসের কাজকর্মের জন্য দুশ্চিন্তা না করা বা ওভার স্ট্রেস না নেয়া।
২৫. যে কোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা এবং সন্তুষ্ট থাকা। সৃষ্টিকর্তার শুকরিয়া আদায় করা।
আপনি বা আপনার পরিবারের কেউ মানসিক রোগে ভুগছে কিভাবে বুঝবেন?
অবসাদ, মানসিক উদ্বিগ্নতা, কাজেকর্মে মন না বসা, কোনো কিছুতেই ইন্টারেস্ট না পাওয়া, দিন দিন খাওয়া-দাওয়ায় অনীহা ও একা একা থাকা ভালো লাগে, অল্পতেই রেগে যাওয়া, বিনা কারণে রাগারাগি খিটমিট করা, মানুষের সঙ্গ ভালো না লাগা, (তবে মানসিক স্বাস্থ্য ছাড়াও অন্যান্য রোগের উপসর্গ থেকেও এগুলো হতে পারে। তাই একজন মনোবিজ্ঞানীর সাথে পরামর্শ করে নিশ্চিত হওয়াই ভালো)। এছাড়াও রয়েছে স্কিৎজোফ্রেনিয়া এবং বাইপোলার সমস্যা হলে।
মানসিক সমস্যা সমাধানের জন্য উপসর্গগুলিকে চিহ্নিত করে উপযুক্ত চিকিৎসা করলে সমস্যার হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। অন্যান্য রোগের চিকিৎসার মতোই এই রোগ নিরাময়ের জন্য সাইকোথেরাপি এবং মেডিটেশনের সাহায্য নেওয়া হয়।
সময় এখন শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন হওয়া। মহান রাব্বুল আলামিন আমাদের সকলকে শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ রাখুন। আমিন।
লেখক: হেড অফ এইচআর, স্টার সিনেপ্লেক্স।