অভিমত

মহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ড কী বার্তা দেয় : মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদার (অব:)

মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদার (অব:) :

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জাতীয় সংকট এখন রোহিঙ্গা ইস্যু। এর ভয়াবহ পরিণতির কথা আমরা কতটুকু উপলব্ধি করতে পারছি সেই প্রশ্নটি বারবার আমার মনে উদ্রেক হয়। ২০১৭ সাল থেকে সকলের দৃষ্টি রোহিঙ্গা সমস্যার ওপর পড়েছে, যদিও ১৯৭৮ থেকে এই সমস্যার সঙ্গে বাংলাদেশ জড়িয়ে পড়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যুটি সম্পূর্ণভাবে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যা। শুধুমাত্র প্রতিবেশী হওয়ার কারণেই বাংলাদেশ আজ এটা নিয়ে বহুমুখী সমস্যার সম্মুখীন। তবে ১৯৭৮ সাল থেকে ২০১৭ পর্যন্ত, ৩৯ বছর বাংলাদেশের কোনো সরকারই বিষয়টিকে যথাযথ গুরুত্ব দেয়নি, বরং চরমভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে। যার পরিণতিতে ব্যাধি এখন সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়ায় ওষুধে তেমন কাজ হচ্ছে না। বরং একেক ওষুধের একেক রকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় নতুন নতুন সমস্যার উদ্ভব হচ্ছে।

সরকারি কর্তৃপক্ষ উপেক্ষা করলেও ২০১৭ সালের আগেই আমি-সহ অনেকেই আমরা বলেছিলাম, রোহিঙ্গা ইস্যুটি বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য বিষফোঁড়া হয়ে আছে, এটিতে পচন ধরলে মহাবিপদ হবে।

২০১৬ সালের জুন মাসের ৬ তারিখে মূলস্রোতের সর্বাধিক প্রচারিত পত্রিকায় আমার লেখা থেকে একটা উদ্ধৃতি দিই। আমি লিখেছিলাম, “প্যান ইসলামিজমের উন্মাদনায় বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্কের আরো অবনতি হবে। বাংলাদেশের ভূ-খণ্ডীয় নিরাপত্তার জন্য জটিল ঝুঁকি সৃষ্টি করবে। কক্সবাজার বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্ট্র্যাটেজিক লোকেশন। সুতরাং সুদূরপ্রসারি দূরদৃষ্টি ও পরিকল্পনা না থাকলে সংকট মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার পর তখন সেগুলো সামাল দেয়া কঠিন হয়ে যাবে। কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মিলে বাংলাদেশে এখন চার লাখের মতো রোহিঙ্গা আছে। আরো পাঁচ লাখ এসে দশ লাখ হলে কী হবে ভাবা যায়! (মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদার (অবঃ), দুর্ভাগা রোহিঙ্গা জাতি সংকট বাংলাদেশ, পৃ-৬৩)।

২০১৭ সালের আগস্ট মাসের ঘটনা এবং গত চার বছরে যা যা ঘটেছে তার দিকে তাকালে ২০১৬ সালে বলা আমার কথার হুবহু মিল পাওয়া যাবে। কিন্তু বিষয় হলো রোহিঙ্গা ইস্যুতে সরকারি কর্তৃপক্ষের উপলব্ধি আমাদের বোঝার সাধ্য নেই। ২০১৭ সালের আগস্ট মাসের পর সকলে একটু নড়েচড়ে বসলেন বলে মনে হলো। কিন্তু চার বছরের মাথায় এসে দেখছি সবকিছু যেন তথৈবচ।

২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে সিভিল সোসাইটির পক্ষ থেকে আমরা একটা বড় প্রতিনিধিদল কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল সরেজমিনে সার্বিক পরিস্থিতি দেখা ও মূল্যায়ন করা। তখন কক্সবাজারের স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে আমাদের একটা মতবিনিময় সভা হয়েছিল। তাতে আমি বলেছিলাম, ভবিষ্যত কোনো ভালো ইঙ্গিত দিচ্ছে না, দ্রুত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কঠিন হবে বলে মনে হচ্ছে। তাই এই অসহায়, নির্যাতিত, ক্ষুব্ধ, দেশান্তরি জনগোষ্ঠীকে দেশী-বিদেশী চক্রান্তকারীরা হীনস্বার্থ উদ্ধারে যেন জিম্মি করতে না পারে তার জন্য প্রতিটি ক্যাম্পের সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা এমন নিরবিচ্ছিন্ন ও নিশ্ছিদ্র হতে হবে যাতে একটা সুঁইও নিরাপত্তা বেষ্টনীকে এড়িয়ে ক্যাম্পের ভেতরে ও বাইরে যেতে-আসতে না পারে। তখন বলেছিলাম এটা শুরু থেকেই করতে হবে, তা না হলে একবার ছাড় দিলে সেটা আর বেষ্টনীর মধ্যে আনা যাবে না।

বলেছিলাম, সময়ের এক ফোঁড়ে যা হয়, অসময়ের দশ ফোঁড়ে তা হয় না। হতে পারে এ কাজ শক্তভাবে করতে গেলে কেউ কেউ অথবা কোনো দেশী-বিদেশী পক্ষ ভালো বা মন্দ উদ্দেশ্যে মানবাধিকারের প্রশ্ন তুলতে পারে। বিষয়টি যদি সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের নিবিড় মনিটরিংয়ের মাধ্যমে হয় এবং তাতে যখন দেখা যাবে এটি সাধারণ রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে, তখন কারো আর আপত্তি থাকবে না। কিন্তু কে শোনে কার কথা। সেদিনের আশঙ্কাই আজ সত্যে পরিণত হয়েছে। এ পর্যন্ত প্রায় ৫০ জন রোহিঙ্গা, ক্যাম্পের ভেতরে রোহিঙ্গা অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীর গুলিতে নিহত হয়েছে।

২০২০ সালের অক্টোবর মাসে এক আক্রমণেই ৭ জন রোহিঙ্গাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। কিভাবে ক্যাম্পের ভেতরে অস্ত্র ঢুকলো, কারা এই অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী, কেন এই অস্ত্র উদ্ধার করা যাচ্ছে না তার কোনো উত্তর কেউ দিচ্ছে না। মনে হচ্ছে সব কিছু রহস্যে ঘেরা।

সুতরাং ২৯ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাত আনুমানিক সাড়ে আট ঘটিকায় ‘শান্তিপূর্ণ প্রত্যাবাসনের কণ্ঠস্বর’ রোহিঙ্গা নেতা মহিবুল্লাহ হত্যাকান্ড কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। মহিবুল্লাহ সব সময় বলে আসছেন, এটি আমাদের দেশ নয়, মিয়ানমার আমাদের দেশ, যত দ্রুত সম্ভব সেখানেই আমাদের ফিরে যেতে হবে।

কিন্তু রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকে গড়ে ওঠা কিছু সন্ত্রাসী গোষ্ঠী, যারা দেশী-বিদেশী চক্রান্তকারীদের সহযোগিতায় মহিবুল্লাহর প্রত্যাবাসন ক্যাম্পেইনের বিপরীতে অস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। কক্সবাজারের সকল ক্যাম্প এবং স্থানীয় মানুষের মুখে মুখে একটাই কথা দেশী-বিদেশী কিছু পক্ষ এবং রোহিঙ্গাদের ভেতর থেকে গড়ে ওঠা সন্ত্রাসী গ্রুপসমূহ, যারা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিরোধী তারাই এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। এই প্রত্যাবাসন বিরোধী কারা, এদের সম্পর্কে কি আমরা কিছুই জানি না? মহিবুল্লাহকে ইতোপূর্বে অনেকবার হুমকি দেয়া হয়েছে, তার ভাই হাবিবুল্লাহকে একবার কিডন্যাপ করা হয়েছিল।

সবার সন্দেহের আঙ্গুল ARSA (Arakan Rohingya Salvation Army) সন্ত্রাসী সংগঠনের দিকে, যারা প্রত্যাবাসন বিরোধী এবং ২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনী কর্তৃক রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর অন্যতম প্রভোকেটর।

‘আরসা’ স্থানীয়ভাবে ‘আল-ইয়াসিন’ নামে পরিচিত। ঘটনার পর নিজস্ব প্যাডে ও নেতা আতাউল্লাহ স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে আরসা জানিয়েছে মহিবুল্লাহ হত্যাকান্ডের সঙ্গে তারা জড়িত নয়।

আরসা সম্পর্কে বিশ্বের নামকরা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কিছু তথ্য তুলে ধরি। ব্রাসেলস ভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের ২০১৬ সালের ১৫ ডিসেম্বরের প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘Myanmar : A new Muslim Insurgency in Rakhine State’. ২০১৭ সালের ২৭ আগস্টের এদের আরেকটি বড় প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘Myanmar tips into new crisis after Rakhine states attacks’. ২০১৭ সালের ২০শে জুন এশিয়া টাইমস পত্রিকায় একটি বড় প্রবন্ধ ছাপা হয় যার শিরোনাম ‘Rohingya insurgency takes lethal form in Myanmar’. ২০১৭ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি হিন্দুস্তান টাইমস পত্রিকায় প্রশান্ত ঝায়ের প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল ‘Lashkar militants inciting Rohingya Refugees India warn Myanmar’.

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট আরসা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী মিয়ানমারের ৩০টি পুলিশ ফাঁড়ির ওপর একযোগে আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণের বিস্তারিত পাওয়া যায় অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ২০১৮ সালের ১০ মে ও ২৭ জুনের প্রতিবেদনে। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের তথ্যানুসারে আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনী নামে একজন পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত রোহিঙ্গা ব্যক্তির দ্বারা ২০১২ সালে আরসা গঠিত হয়। ২০১৬ সালের ৯ই অক্টোবর মিয়ানমারের ৩টি পুলিশ ফাঁড়ির ওপর আরসা আক্রমণ চালায় এবং ৯ জন পুলিশকে হত্যা করে। আরসা নিজেরাই এই আক্রমণের দায়িত্ব স্বীকার করে।

বিগত সময়ের ঘটনার সূত্রে বোঝা যায় আরসা সন্ত্রাসী সংগঠনের উৎপত্তি ও তৎপরতার সঙ্গে পাকিস্তানি জঙ্গি সংগঠন বিশেষ করে লস্কর-ই-তৈয়বার সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা ও সংশ্লিষ্ঠতা রয়েছে। যেটি হিন্দুস্তান টাইমসের ২০১৭ সালের ৭ই ফেব্রুয়ারির  প্রতিবেদনে পাওয়া যায়।

সুতরাং মহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আরসা জড়িত, যে কথা মহিবুল্লাহার পরিবার ও স্থানীয়রা বলেছে তার মধ্যে যুক্তি রয়েছে। রোহিঙ্গা সঙ্কট জিইয়ে রেখে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অস্থিরতা ও নিরাপত্তা সংকট সৃষ্টির জন্যই মহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ড পাকিস্তানি গোয়েন্দা আইএসআই ও তাদের নির্দেশে পরিচালিত জঙ্গি সংগঠনের দ্বারাই হয়েছে। তার সমর্থনে বিগত সময়ের দুয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করি।

এক. ২০১৬ সালের ১২ মে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরে অবস্থিত আনসার ক্যাম্পের ওপর সন্ত্রাসী আক্রমণ হয়। তাতে ১১টি রাইফেল ও ৫৯০ রাউন্ড গুলি লুট হয়। নিহত হন আনসার কমান্ডার আলী হোসেন। পরবর্তীতে এই আক্রমণের হোতাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়, যার নাম ওমর ফারুক এবং তিনি পাকিস্তানি নাগরিক।

দুই. ২০১৭ সালের ৩ জুলাই ঢাকা ট্রিবিউনে একটা প্রবন্ধ ছাপা হয়, তাতে পাকিস্তানি জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বার সঙ্গে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর যোগসাজসের উল্লেখ করা হয় এবং বলা হয় লস্কর-ই-তৈয়বা ও বাংলাদেশের আনসার-উল-ইসলাম একসঙ্গে বাংলাদেশী যুবকদের রোহিঙ্গা সশস্ত্র সংগঠনের সঙ্গে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে।

তিন. পাকিস্তানি বুদ্ধিজীবী  হুসেন হাক্কানীর লেখা – ‘পাকিস্তান বিটুইন মস্ক অ্যান্ড মিলিটারি’ গ্রন্থের ১৯১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে ১৯৮৪ সালে রোহিঙ্গা মুসলিম লিবারেশন ফ্রন্টের জন্য পাকিস্তানের করাচিতে অফিস দেওয়া হয়। আর আরসা প্রধান আতাউল্লাহ পাকিস্তানি নাগরিক হওয়ায় সঙ্গত কারণেই ধরে নেওয়া যায় আতাউল্লাহর উত্থান ও আরসা গঠনে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর ভূমিকা রয়েছে।

বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তের জঙ্গি সংগঠনকেও যে পাকিস্তান আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয় তার কথা হুসেন হাক্কানীর বইয়ে উল্লেখ আছে। সুতরাং আরসা সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে যাতে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান না হয়; এ পর্যন্ত তাদের সকল কর্মকাণ্ডের মধ্যেই এ কথার প্রমাণ পাওয়া যায়। এই অঞ্চলে তাদের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের জন্যেই আরসাকে সৃষ্টি করেছে পাকিস্তান। কিন্তু সেই লক্ষ্যের মূল প্রতিবন্ধক বাংলাদেশে ক্ষমতায় থাকা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার। যার কারণেই দেখা যায় ২০১৮ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখেই ঘটে যায় ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণ।

বাংলাদেশে আরেকটি জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। সেটিকে লক্ষ্য রেখেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন যাতে কিছুতেই না হতে পারে তার জন্যেই প্রত্যাবাসনের কণ্ঠস্বর মহিবুল্লাহ নিহত হলেন ২৯ সেপ্টেম্বর দিবাগত সন্ধ্যারাতে।

আমাদের সজাগ হওয়ার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে।

লেখক: গবেষক এবং রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *