নবনীতা দত্ত তিথি :
“আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জিল,
ধরণীর বহির্আকাশে-অন্তরিত মেঘমালা,
প্রকৃতির অন্তর আকাশে জাগরিত জ্যোতির্ময়ী
জগৎমাতার আগমন বার্তা।”
দুর্গাপূজা যে চলে এসেছে তার বার্তা বয়ে আনে মহালয়া। মহালয়া মানেই বাংলার হৃদয় জুড়ে ধ্বনিত হয় দেবী বন্দনার সুর। দূর থেকে ভেসে আসে ঢাকের আওয়াজ। মহালয়া চুপটি করে জানিয়ে যায় “মা আসছেন”।
কৃষ্ণপক্ষের অবসান এবং শুক্লপক্ষ বা দেবীপক্ষের সূচনায় অমাবস্যার এ বিশেষ তিথিটি সনাতন ধর্মে বিশেষ জায়গা দখল করে আছে। কেন এর নাম মহালয়া? ‘মহালয়া’ শব্দের অর্থই আবার কী?
বাংলা ব্যাকরণ অনুযায়ী, ‘মহালয়’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত উৎস ‘মহৎ’ এবং ‘আলয়’। অর্থাৎ মহৎ যে আলয় বা আশ্রয়, তাই হল মহালয়। এই মহালয় শব্দ থেকেই মূলত মহালয়া এসেছে। মহালয়ের স্ত্রীবাচক শব্দই ‘মহালয়া’।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ অনুযায়ী, যে ক্ষণে পরমাত্মায় অর্থাৎ পরমব্রহ্মে লয়প্রাপ্তি হয়, তাই হলো মহালয়। সুতরাং নিরাকার ব্রহ্মের আশ্রয়ই হলো মহালয়।
আবার শ্রীশ্রীচণ্ডীতে ‘মহালয়’ বলতে পিতৃলোককে নির্দেশ করা হয়েছে। পিতৃলোককে, পূর্বপুরুষদের স্মরণের ক্ষণকে বলা হয়েছে মহালয়া। কৃষ্ণপক্ষে কালিমার ক্রমশ লয় হতে হতে অমাবস্যার পূণ্য এ তিথিতে সে লয় পূর্ণতা পায়, তাই একে বলে মহালয়া।
আমরা যদি ‘মহালয়’ শব্দটির সন্ধিবিচ্ছেদ করি তবে এর দুটি অর্থ খুঁজে পাই। একদিকে ‘মহ’ শব্দের অর্থ দাঁড়ায় পূজা বা উৎসব। এক্ষেত্রে ‘মহ+আলয়=মহালয়’ এর অর্থ হয় পূজা বা উৎসবের আলয় বা আশ্রয়।
অন্যদিকে ‘মহ’ শব্দের একটি অর্থ প্রেত। এক্ষেত্রে ‘মহালয়’ এর অর্থ হয়ে যায় প্রেতের আলয় বা আশ্রয়। সনাতন ধর্ম অনুসারে, এই দিনে প্রয়াত আত্মাদের মর্ত্যে পাঠানো হয়। প্রয়াত আত্মাদের এ সমাবেশকেই বলে মহালয়। এই মহালয় থেকেই মহালয়া।
ব্যাসদেব লিখিত মহাভারত থেকে দেখতে পাওয়া যায়, সেখানে ‘মহালয়’ বলতে বুঝানো হয় পিতৃলোককে। বিদেহী পিতৃপুরুষদের অবস্থানের স্থানই হলো মহালয়। আর এ পিতৃলোককে স্মরণের অনুষ্ঠানই হলো মহালয়া।
বিভিন্ন শাস্ত্র বিশেষজ্ঞদের মতে, পিতৃপক্ষের অবসানে, অমাবস্যার অন্ধকার পেরিয়ে আমরা আলোকজ্জ্বল দেবীপক্ষকে আহ্বান করি, এই মহালগ্নই হলো মহালয়া। এখানে দেবীদুর্গাই সেই মহান আশ্রয়। আঁধার পেরিয়ে আলোকে উত্তরণের এই লগ্নই হলো মহালয়া।
মহালয়া পিতৃপূজা ও মাতৃপূজার মহাসন্ধিক্ষণ। মহালয়া মানেই দুর্গাপূজার দিন গোণা। মহালয়ার পূণ্য প্রভাতে- ‘ময়া দত্তেন তোয়েন তৃপ্যান্ত ভুবনত্রয়ম, আব্রহ্ম স্তম্ভ পর্যন্তং তৃপ্যন্ত’ – মন্ত্র উচ্চারণের মাধ্যমে তিন গণ্ডুষ জল অঞ্জলি দিয়ে কোটি কোটি মানুষ স্মরণ করেন তাদের পূর্বপুরুষদের।
পুরাণ মতে, মহালয়ার দিনে, দেবী দুর্গা মহিষাসুর বধের দায়িত্ব পান। ব্রহ্মার বর অনুযায়ী কোনও মানুষ বা দেবতা কখনও মহিষাসুরকে হত্যা করতে পারত না। অসীম ক্ষমতাশালী মহিষাসুর দেবতাদের স্বর্গ থেকে তাড়িয়ে দেয় এবং বিশ্বব্রহ্মান্ডের অধীশ্বর হতে চায়।
এ অবস্থায় যখন দেবতারা ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরের শরণাপন্ন হলেন তখন ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর ত্রয়ী সম্মিলিতভাবে ‘মহামায়া’ এর রূপে অমোঘ নারীশক্তি সৃষ্টি করলেন এবং দেবতাদের দশটি অস্ত্রে সুসজ্জিত সিংহবাহিনী দেবী দুর্গা ৯ দিন ব্যাপি যুদ্ধে মহিষাসুরকে পরাজিত ও হত্যা করলেন।
বাঙালি জীবনে মহালয়া মানেই দেবীর আগমনী বার্তা। মহালয়া এবং বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে ‘আশ্বিনের শারদপ্রাতে’ শুনতে শুনতে বাংলার বুকে সূচিত হয় দেবীপক্ষ।
মহালয়া মানেই সিংহবাহিনী মা আসছেন। মহালয়া মানেই অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটতে চলেছে। শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে। সিংহবাহিনী মা দুর্গার কাছে আমার এই প্রার্থনা, সমস্ত রোগ-শোক, জরা ব্যাধি কাটিয়ে, সমস্ত অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটিয়ে পৃথিবী আবার হয়ে উঠুক শান্তিময়, সমৃদ্ধিময়।