নিজস্ব প্রতিবেদক, ধূমকেতু ডটকম: পরবর্তী প্রজন্মের কোয়ান্টাম সেন্সর প্রযুক্তি আমাদের পৃথিবী এবং মহাবিশ্বকে বুঝতে অভূতপূর্ব সহায়তা করতে পারবে বলে ধারণা করছেন বিজ্ঞানীরা। শুধু পৃথিবীতেই নয়, মহাবিশ্বের পরিচালনা পদ্ধতি পরিবর্তন করতে সক্ষম এটি। বর্তমানে আমেরিকা, চীন এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশ মহাকাশ পর্যবেক্ষণে বিপুল বিনিয়োগ করছে। এ বিনিয়োগের সাথে তাল মিলিয়ে গবেষণাও হচ্ছে প্রচুর। আজ না হয় কাল তাদের এসব গবেষণালব্ধ পরিবর্তন আমরা দেখতে পাবো।
তাহলে কিভাবে মহাকাশ-ভিত্তিক কোয়ান্টাম প্রযুক্তিগুলি পরিবর্তন আনবে?
অস্ট্রিয়াতে কোয়ান্টাম অপটিক্স এবং কোয়ান্টাম তথ্য ইন্সটিটিউটে রেইনার কাল্টেনবায়েক এবং ইউরোপজুড়ে তার সহকর্মীরা এই গবেষণার কাজের একটি সামগ্রিক ধারণা দিয়েছেন। এই বিজ্ঞানীরা কোয়ান্টাম সেন্সরের ভবিষ্যত কাজের একটি মানচিত্র তৈরি করেছেন ও প্রযুক্তির মাধ্যমে কিভাবে মহাকাশ ভিত্তিক কোয়ান্টামের অগ্রগতি হবে নির্ধারণ করেছেন।
বর্তমানে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এবং কোয়ান্টাম যোগাযোগ ব্যবস্থা বেশি আলোচিত হলেও কল্টেনবেক এবং তার সহকর্মীরা উল্লেখ করেছেন যে, অন্যান্য কোয়ান্টাম প্রযুক্তিগুলো সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এর মাঝে উল্লেখযোগ্য- কোয়ান্টাম সেন্সরযুক্ত পরমাণু ইন্টারফেরোমিটার।
মহাকাশ-ভিত্তিক কোয়ান্টাম প্রযুক্তির মাধ্যমে কক্ষপথে স্যাটেলাইটের গতিতে যে কোনো পরিবর্তন অভূতপূর্ব নির্ভুলতার সাথে পরিমাপ করা যায়। এই পরিবর্তনগুলো সাধারণত ঘটে থাকে গভীর সমুদ্রের উচ্চ ঘনত্বের জলপ্রবাহ, বন্যা, মহাদেশগুলোর অভ্যন্তরীণ প্লেটগুলোর চলাচল এবং বরফ প্রবাহের মত কারণে।
জলবায়ু নির্দেশক
কোয়ান্টাম সেন্সরগুলো মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের ক্ষুদ্র কণা দ্বারা ঘূর্ণিত হবার কারণে পৃথিবী পর্যবেক্ষণের নতুন যুগের পথ সুগম করবে। এই অধ্যয়নগুলোর মাধ্যমে গভীর সমুদ্রের মাঝে কেমন পরিবর্তন হচ্ছে, মহাদেশগুলোর মাঝে পরিবর্তন কীরূপ হচ্ছে ইত্যাদি বুঝতে সহায়তা করবে। অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে ভূতত্ত্বগত তুলনামূলক ভাবে পূর্বের চেয়ে ভালো ধারণা দিবে।
কল্টেনবেক এবং তার সহকর্মীদের মতে, “স্পেস-ভিত্তিক কোয়ান্টাম সেন্সরগুলি পৃথিবীর সম্পদের উপর আরো ভালো নজরদারি করতে সক্ষম করবে এবং ভূমিকম্পের পূর্বাভাস, খরা ও বন্যার মতো জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবগুলিকে উন্নত করবে।”
ভালো কোয়ান্টাম ঘড়ি বা টাইম কিপিং নেটওয়ার্ক এই প্রযুক্তিকে প্রভাবশালী হয়ে উঠতে সাহায্য করে। তবে মহাকাশ ভিত্তিক কোয়ান্টামের মূল উদ্দ্যেশ্য অধিক সময় ধারণ ক্ষমতা নয়, বরং উচ্চ নির্ভুলতার সাথে এই তথ্য অন্য স্থানে স্থানান্তর করার ক্ষমতা। তথ্য নির্ভুলতার সাথে স্থানান্তর করার ক্ষমতাটি মহাকাশ ভিত্তিক ঘড়ির নেটওয়ার্ককে আরো সুনির্দিষ্টভাবে গোছাতে পারবে।
টাইম কিপিং নেটওয়ার্ককে ইতিমধ্যেই গ্লোবাল ন্যাভিগেশন স্যাটেলাইট সিস্টেম, জিপিএস ব্যবস্থার ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। পরবর্তী প্রজন্মের কোয়ান্টামে যখন তথ্য দ্রুত নির্ভুলভাবে স্থানান্তর করবে তখন সময় ধারণ ক্ষমতা বা টাইম কিপিং আরো উন্নত হবে যার ফলস্বরূপ ভৌগলিক পরিসেবার মান আরো সঠিক ও নির্ভুল হবে।
তবে এটি মাত্র শুরু। এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চালনা হবে দৃশ্যমান আলোর জন্য সিনথেটিক অ্যাপারচার টেলিস্কোপ তৈরি করা। এখানে ধারণাটি হল দুটি পৃথক স্থানের কোনো আলোক তরঙ্গের আগমনের সময় রেকর্ড করা এবং তাদের উৎসের কোনো ছবি যেমন একটি দূরবর্তী নক্ষত্রের দূরত্ব গনণা করা। এরূপ বিশ্লেষণের মাধ্যমে দুটি পৃথক স্থানের মধ্যে দুরত্ব-র সমান একটি অ্যাপারচার বা ফাঁকা স্থান মিলে যায়। যার কারণে এর নাম সিনথেটিক অ্যাপারচার টেলিস্কোপ। রেডিও তরঙ্গের মতো দীর্ঘ তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের বিকিরণের জন্য এটা সম্ভব হয়। রেডিও তরঙ্গের জন্য এই কৌশল ব্যবহার করে ২০১৯ সালে একটি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলের প্রথম ছবি তৈরি করা হয়েছিলো।
উল্লেখ্য, দৃশ্যমান আলোর দৈর্ঘ্য সাধারণত মিটারের পরিবর্তে ন্যানোমিটারে পরিমাপ করা হয়। এই আলোক দৈর্ঘ্যের আগমন রেকর্ড করার জন্য আরো সুনির্দিষ্ট সময় পরিমাপ প্রয়োজন, যা মহাকাশ ভিত্তিক কোয়ান্টাম সময় রাখার (টাইম কিপিং নেটওয়ার্ক) ডিভাইসের পরবর্তী প্রজন্মকে আরো সক্ষম করবে।
এক্সোপ্লানেট বা বহিঃগ্রহের বায়ুমণ্ডল পর্যবেক্ষণ
এধরনের সিনথেটিক অ্যাপারচার টেলিস্কোপ পূর্বের বা বর্তমানের যে কোনো যন্ত্রের চেয়ে বেশি সংবেদনশীল হবে। যার মাধ্যমে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদেরকে আরো বড় আকারের অন্যান্য নক্ষত্রের গ্রহ অধ্যয়ন করার অনুমতি দেবে। এছাড়াও এর মাধ্যমে মহাকাশ ভিত্তিক পর্যবেক্ষণ সূক্ষ্মতর হবে। মহাকর্ষীয় তরঙ্গ গবেষণার দ্বারা ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর তরঙ্গদৈর্ঘ্য পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হবে।
সংক্ষেপে বললে, মহাকাশ ভিত্তিক কোয়ান্টাম প্রযুক্তিলব্ধ তথ্য অনেক বেশি সুরক্ষিত থাকবে।
২০১৬ সালে চীন বিশ্বের প্রথম কোয়ান্টাম যোগাযোগ উপগ্রহ ‘ম্যাকিয়াস’ চালু করেছিল। যার মাধ্যমে প্রথম এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে সুরক্ষিত ভিডিও কল প্রদর্শন করেছে। ইউরোপ এবং আমেরিকা এই ক্ষেত্রে বেশ পিছিয়ে রয়েছে। কোয়ান্টাম যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করতে তাদের ভুমি ভিত্তিক কোয়ান্টাম যোগাযোগ ব্যবস্থাকে মহাকাশ ভিত্তিক কোয়ান্টাম যোগাযোগ ব্যবস্থায় রূপান্তরিত করার পদক্ষেপ নিতে হবে।
অবশ্যই, এইগুলির জন্য উল্লেখযোগ্য পরিকল্পনা, প্রচুর সহযোগিতা আর তহবিলের প্রয়োজন হবে। বিশ্বের তিন ক্ষমতাশীল জাতির মহাকাশ কোয়ান্টামের প্রতিযোগিতায় সবথেকে এগিয়ে আছে চীন। ইউরোপ ভবিষ্যতের কোয়ান্টাম গুরুত্বপূর্ণ তহবিলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে, যেখানে আমেরিকার তুলনামূলক মনোযোগের অভাব পরিলক্ষিত।
আমেরিকা যদি বিশ্বের নেতৃত্ব টিকিয়ে রাখতে চায় তবে তাদের এইদিকে মনোযোগ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।