প্রচ্ছদ

মশা নিধন করবে নীল কানপোনা

নিজস্ব প্রতিবেদক, ধূমকেতু ডটকম: চট্টগ্রাম নগরে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে পরিত্যক্ত একটি বাড়িকে ঘিরে গড়ে ওঠা জলাশয়ে কোনো মশার লার্ভা কখনও খুঁজে পাননি একদল গবেষক। এতে বিস্মিত হন তারা। তারপর অনুসন্ধান করতে গিয়ে সেখানে খুঁজে পান নীল কানপোনা মাছ। পরীক্ষা-পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে গবেষক দল দেখে, মশার লার্ভা পেলেই খেয়ে ফেলে দেশীয় প্রজাতির এই মাছ।

মশার লার্ভা ধ্বংসে নীল কানপোনা মাছের এই কার্যকারিতা দেখে সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই গবেষকরা পরামর্শ দিয়েছেন, কীটনাশকের পরিবর্তে জৈবিক নিয়ন্ত্রণের ওপর গুরুত্বারোপ করার। তারা বলছেন, মশা নিধনে কীটনাশকের ব্যবহারের কারণে মানুষের ফুসফুস ক্যান্সারসহ নানারকম স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দিচ্ছে। ধ্বংস হচ্ছে জলজ বাস্তুসংস্থান।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘প্রাকৃতিক উপায়ে মশার লার্ভা ধ্বংস করা গেলে পরিবেশ বাঁচবে, বাঁচবে উপকরণ ও ওষুধ কেনার কোটি কোটি টাকা। গবেষকদের সঙ্গে পরামর্শ করে দেখা হবে এই উদ্ভাবন প্রয়োগ করা যায় কিনা।’

গবেষক দলটি চট্টগ্রাম নগরের ৫১টি স্থানের মধ্যে ৩৩টিতে সংগৃহীত লার্ভায় ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার উপস্থিতি পেয়েছে। ম্যালেরিয়ার জীবাণুবাহী অ্যানোফিলিস মশার উপস্থিতি পেয়েছে ৩৯টি স্থানে। আর এই দুই ধরনেরই মশার লার্ভা পাওয়া গেছে ২২টি স্থানে। ৩৩টি স্থানের মধ্যে ১৫টি থেকে সংগ্রহ করা নমুনার শতভাগই ছিল এডিসের লার্ভা। আর অ্যানোফিলিস লার্ভার শতভাগ উপস্থিতি ছিল দুটি জায়গায়।

মশার লার্ভা সংগ্রহ করতে গিয়ে নীল কানপোনা মাছের সন্ধান পায় গবেষক দল। মাছটির ইংরেজি নাম Blue panchax। বৈজ্ঞানিক নাম Aplocheilus panchax। এটি Aplocheilidae পরিবারের Aplocheilus গনের দেশীয় স্বাদু পানির মাছ। মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, মাছটি পানির উপরস্তরে বসবাস করে। জলাশয় ছাড়াও নালা-নর্দমায়ও মাছটি টিকে থাকতে পারে।

গবেষক দলের সদস্য সচিব ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, ‘গবেষণার জন্য নগরের বিভিন্ন স্থান থেকে মশার লার্ভা সংগ্রহ করেছি। এর মধ্যে নগরের ডিসি রোডে একটি পরিত্যক্ত বাড়ির নিচতলা পানিতে ডুবে আছে দেখে স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে জানতে চাই।

তারা জানান, এটি ১২ থেকে ১৫ বছর ধরে এভাবেই পানিতে ডুবে আছে। ভেবেছিলাম, এখানে মশার অনেক লার্ভা পাওয়া যাবে। কিন্তু তন্নতন্ন করে খুঁজেও মশার কোনো লার্ভা পাইনি। বিষয়টিতে বিস্মিত হই। পরে দেখি সেখানে এক প্রজাতির মাছ আছে। মাছগুলো ধরে এনে পরীক্ষা করে দেখি, এগুলো প্রচুর মশার লার্ভা খেয়ে থাকে।

খলিশা, দাড়কিনা ও ধানি মাছ : নীল কানপোনার পাশাপাশি দেশীয় প্রজাতির খলিশা, দাড়কিনা এবং ধানি মাছেও মশার লার্ভা নিধনের প্রমাণ পেয়েছেন গবেষকরা। ‘মশার লার্ভা ভক্ষণে সক্ষম মাছ দিয়ে মশার জৈবিক নিয়ন্ত্রণ’ শীর্ষক এ গবেষণা করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক ড. হারুনুর রশীদ ও এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন চট্টগ্রামের বিদেশীয় শিক্ষার্থী ছিমি লামো। তারা চট্টগ্রামের নালা-নর্দমায় প্রচুর বিদেশি ‘মসকুইটো ফিশ’ও পেয়েছিলেন। এ মাছের পেটে প্রচুর মশার লার্ভা পাওয়া গেছে।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক ড. হারুনুর রশীদ বলেন, ‘লিয়েনে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনে কর্মরত থাকার সময় আমি ও আমার এক ছাত্র মিলে গবেষণাটি করি। চট্টগ্রামের নালা-নর্দমায় প্রচুর মসকুইটো মাছ পেয়েছি। এছাড়া দেশীয় প্রজাতির মাছও পেয়েছি। যেগুলো মশার লার্ভা ভক্ষণ করে। মশা নিয়ন্ত্রণে সফল দেশগুলো সারাবছর ধরেই জৈবিক ও রাসায়নিক দমন পদ্ধতির সমন্বিত প্রয়োগে মশা ও মশাবাহী রোগ দমনে সফলতা পেয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে মশার প্রাদুর্ভাব হলেই শুধু তৎপরতা দেখা যায়।’

তিনি বলেন, ‘মশা নিধন করতে হলে মশার জীবন চক্র বুঝতে হবে। বদ্ধ পানিতে মশার জন্ম হয়। সেখানে মাছ ছাড়তে হবে। এর মাধ্যমে হয়তো ৪০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। পেস্টিসাইড ছিটিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে আরও ৪০ শতাংশ। এরপর বাসাবাড়িতে জমে থাকা পানি ও নালা-নর্দমা পরিষ্কার রেখে বাকি ২০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে মশাবাহী রোগ দমন করা যাবে।’

কীটনাশক ব্যবহারে জীবনের ঝুঁকি: চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন মশার লার্ভা নিধনে স্প্রে মেশিন দিয়ে কীটনাশক লার্ভিসাইড ও পূর্ণবয়স্ক বা উড়ন্ত মশা নিধনে ফগার মেশিন দিয়ে ছিটায় অ্যাডাল্টিসাইড। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোনো রাসায়নিক কীটনাশকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার মানুষ, প্রাণী ও পরিবেশের জন্য খুব ক্ষতিকর। তাই মশা নিধনে রাসায়নিকের বিকল্প হিসেবে জৈব নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতিগুলো চালু করা যেতে পারে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, মশা নিধনে যেসব রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়, সেগুলো প্রয়োগমাত্রা অনুযায়ী ব্যবহার করলে কোনো মশা মরে না। গবেষণায় দেখা গেছে, যে ওষুধে মশা মরে সেটি ব্যবহার করতে কেরোসিন ব্যবহার করতে হবে। যা পরিবেশের জন্য খুবই ক্ষতিকর।

এছাড়া রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহারে মানুষের ফুসফুস ক্যান্সার ও অটিজমসহ নানা স্বাস্থ্যঝুঁকি তো রয়েছেই। এসব ছিটানোর মাধ্যমে উপকারী কীটপতঙ্গও মারা যায়। কীটনাশকগুলো নালা-নর্দমার মাধ্যমে নদী ও সাগরে পড়ে পোকামাকড় ও মাছ মারা যায়। সুতরাং বিকল্প হিসেবে জৈব নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতিগুলো চালু করা যেতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *