খাদ্য-পুষ্টি

মধু প্রাচীনকাল থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে ওষুধ ও খাদ্য হিসেবে

নিজস্ব প্রতিবেদক, ধূমকেতু ডটকম: প্রাচীনকাল থেকেই মধু ওষুধ এবং খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বিশেষ করে চাইনিজরা প্রতিদিন সকালে দুধ ও মধু মিশিয়ে রুটি দিয়ে খেতো। নিয়মিত মধু খাওয়া চাইনিজদের একটি অভ্যাসে পরিণত হয়েছিলো। শুধু চাইনিজরা নয়, আমাদের দেশেও কেউ কেউ হালকা গরম জলে মধু দিয়ে অথবা চায়ের সাথে মধু দিয়ে খায়।পরিসংখ্যানের দিকে দেখলে দেখা যাবে যে, বিশ্বের প্রায় বেশিরভাগ দেশেই, বিশেষ করে এশিয়ান দেশগুলোতে মধু খাওয়ার প্রচলন অনেক বেশি। আপনি যদি সকাল বেলা এক চামচ মধু খান তাহলে দিনের শুরুটাকে মধুর মত মিষ্টি করে দিবে। শুধু তাই নয়, মধুর আছে অবিশ্বাস্য কিছু স্বাস্থ্য উপকারিতা।

আরও পড়ুন: স্মৃতিশক্তি বাড়ায়, রক্তশূন্যতা দূর করে জিরা

মধুতে যেসব উপাদান বিদ্যমানঃ
শুনতে খুব অবাক লাগলেও এটা সত্য যে, মধুতে প্রায় ৪৫টিরও বেশি খাদ্য উপাদান থাকে। সাধারণত পুষ্টি উপাদান হিসাবে ফুলের পরাগের মধুতে থাকে ২৫ থেকে ৩৭ শতাংশ গ্লুকোজ, ৩৪ থেকে ৪৩ শতাংশ ফ্রুক্টোজ, ৫-১২ শতাংশ মন্টোজ, ০.৫ থেকে ৩.০ শতাংশ সুক্রোজ থাকে। শুধু তাই নয়, আরো থাকে ২৮ শতাংশ খনিজ লবণ, ২২ শতাংশ অ্যামাইনো এসিড এবং ১১ ভাগ এনকাইম। এতে সাধারণত কোনো চর্বি ও প্রোটিন নেই। প্রতি ১০০ গ্রাম মধুতে থাকে ২৮৮ গ্রাম ক্যালরি।

যেসব ফুল থেকে মধুঃ
সাধারণভাবে বিভিন্ন ফুল থেকে মধু হয় তার মধ্যে কিছু হল – সরিষা ফুল, লিচু, কালজিরা থেকে মধু আহরিত হয়। এছাড়াও রয়েছে ধনিয়া ফুল, গুজি তিল ও তিষি থেকেও মধু উত্‍পাদিত হয়ে থাকে। প্রায় সব উপাদান বা ফুল থেকে যে মধু আসে তার সবগুলোর গুণাগুণ প্রায় একই।

সবচেয়ে সেরা মধুঃ
আমরা বিভিন্ন উপায়ে মধু সংগ্রহ করে থাকি তবে নিউজিল্যাণ্ডের মানুকা হানি বাজারে প্রাপ্য সকল মধুর চেযে বেশী ঔষধি গুণসম্পন্ন বলে গণ্য করা হয়। সাধারণত মানুকা নামীয় এক প্রকার ঝোপ জাতীয় উদ্ভিদের ফুল থেকে উত্‍পন্ন মধু “মানুকা হানি” নামেও পরিচিত।

খাটি মধুর কিছু বৈশিষ্ট্যঃ
খাঁটি মধুর কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে তা হল-
১। খাঁটি মধুতে কখনো কোনো কটু গন্ধ থাকে না।
২। সব থেকে মজার কথা হল মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক কোনো উপাদান থাকেনা। প্রকৃতিক গাছে থাকলেও তার কোনো প্রভাব মধুতে থাকে না।
৩। মধু সংরক্ষণে কোনো প্রকার প্রিজারভেটিভ জাতীয় উপাদান ব্যবহৃত হয় না। কারণ মধু নিজেই প্রিজারভেটিভ গুণাগুণ সম্পন্ন পুষ্টিতে ভরপুর একটি খাদ্য।
৪। খাঁটি মধু উত্‍পাদন, নিষ্কাশন, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাত ও বোতলজাতকরণের সময় অন্য কোনো প্রকার পদার্থের সংমিশ্রণ প্রয়োজন হয় না।
৫। আপনি খাঁটি মধু পরীক্ষা করতে চাইলে একটা কাজ করতে পারেন। খাঁটি মধু পানির গ্লাসে ড্রপ আকারে ছেড়ে দিন। খাঁটি মধু ড্রপ অবস্থায়ই গ্লাসের নিচে চলে যাবে।

মধুর যত উপকারিতা-
আসুন এবার জেনে নাওয়া যাক মধুর উপকারিতা

১. মধু রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়- সাধারাণত প্রাকিতিক মধুতে আছে প্রচুর পরিমাণে মিনারেল, ভিটামিন ও এনজাইম যা শরীরকে বিভিন্ন অসুখ বিসুখ থেকে রক্ষা করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। এছাড়াও প্রতিদিন সকালে এক চামচ মধু খেলে ঠান্ডা লাগা, কফ, কাশি ইত্যাদি সমস্যা কমে যায়।শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে হলেপ্রতিদিন হালকা গরম জলের সাথে মধু ও লেবুর রস মিশিয়ে খান।

২. ওজন কমায় মধু- আপনি যদি প্রতিদিন সকালে মধু খান তাহলে আপনার বাড়তি ওজন কমবে। বিশেষ করে যদি পারেন সকালে খালি পেটে হালকা গরম জলে লেবুর রস ও মধু মিশিয়ে খান এতে করে বেশ খানিকটা ওজন কমে যায় কিছুদিনের মধ্যেই। এছাড়াও এভাবে প্রতিদিন নিয়মিত মধু খেলে লিভার পরিষ্কার থাকে, শরীরের বিষাক্ত উপাদানগুলো বের করে দেয় এবং শরীরের মেদ গলে বের হয়ে যায়।

৩. মধু খেলে বুদ্ধি বাড়ে- মধু যে শুধু আপনার কায়িক শক্তি বাড়ায়, তা নয়। আপনি নিয়মিত প্রতিদিন রাতে শোয়ার আগে এক চামচ মধু খাবেন, কারণ ঘুমানোর আগে এক চামচ মধু মস্তিষ্কের কাজ সঠিক ভাবে চালাতে খুব সাহায্য করে ফলে আপনার মস্তিষ্কের শক্তি তথা বুদ্ধির জোর বেড়ে যাবে। যে কোনো কাজে কর্মে আপনার মগজ আগের চেয়ে বেশি কাজ করবে। যাদের সাধারণত মাথা খাটিয়ে কাজ করতে হয়, তাদের জন্য মধু এনে দেবে নতুন উদ্যম ও সৃষ্টিশীলতা।

৪. হৃত্‍পিণ্ডের সমস্যার ঝুঁকি হ্রাস করতে মধু- মধুর সাথে দারচিনির গুঁড়ো মিশিয়ে খেলে তা রক্তনালীর বিভিন্ন সমস্যা দূর করে এবং রক্তনালী পরিষ্কার করতে সাহায্য করে এবং রক্তের খারাপ কোলেস্টেরলের পরিমাণ ১০% পর্যন্ত কমিয়ে দেয়। মধু ও দারচিনির এই মিশ্রণ নিয়মিত খেলে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যায় এবং যারা ইতিমধ্যেই একবার হার্ট অ্যাটাক করেছেন তাদের দ্বিতীয়বার অ্যাটাকের ঝুঁকি কমে যায়।

৫. ব্যথা নিরাময়ে- আপনার শরীরের কি জয়েন্টে জয়েন্টে ব্যথা? প্রচুর বাতের ওষুধ খেয়েও আজও কোনো ফল পাননি? তাহলে আজ থেকে মধু খাওয়া শুরু করুন। আপনার শরীরে যে অবাঞ্ছিত রসের কারণে বাতব্যামোর জন্ম, সে রস অপসারিত করতে মধু বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। কিছু দিন পর আপনার বাত ব্যাথা সেরে যাবে।

৬. হজমে সাহায্য করে মধু- যাদের নিয়মিত হজমের সমস্যায় ভুগেন তারা প্রতিদিন সকালে নিয়মিত মধু খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। মধু আপনার পেটের অম্লীয়ভাব কমিয়ে হজমপ্রক্রিয়ায় সহায়তা করে। হজমের সমস্যা অনেকাংশে দূর করার জন্য মধু খেতে চাইলে প্রতিবার ভারী খাবারের আগে এক চামচ মধু খেয়ে নিন। বিশেষ করে প্রতিদিন সকালে খালি পেটে এক চামচ মধু খান।

৭. শক্তি বাড়াতে মধু- মধুতে আছে প্রচুর পরিমাণে প্রাকৃতিক চিনি। এই প্রাকৃতিক চিনি আপনার শরীরে শক্তি জোগায় এবং শরীরকে কর্মক্ষম রাখতে সাহায্য করে। বিশেষ করে যাদের মিষ্টি খাবারের নেশা অনেক আছে তারা অন্য মিষ্টি খাবারের বদলি হিসাবে মধু খেয়ে নিন। কিছু মানুষ আছে যারা সারাক্ষণ দুর্বলতায় ভোগেন এবং দেখা যায় এই সমস্যা দূর করার জন্য তারা কিছুক্ষণ পর পর চা কফি খায়। এই সমস্যায় যারা ভুগছেন তারা প্রতিদিন সকালে নিয়মিত এক চামচ মধু খেয়ে নিন এবং সারাদিন সবল থাকুন।

৮. যৌন দুর্বলতায়- সাধারণত পুরুষদের মধ্যে যাদের যৌন দুর্বলতা রয়েছে তারা যদি প্রতিদিন মধু ও ছোলা মিশিয়ে খেতে পারেন। তাহলে একটা সময় বেশ উপকার পাবেন।

৯. রক্ত পরিষ্কারক- এক গ্লাস হালকা গরম জলের সাথে এক বা দুই চামচ মধু এবং এক চামচ লেবুর রস মেশান। পেট খালি করার আগে প্রতিদিন এই মিশ্রিত জল খান। এটা রক্ত পরিষ্কার করতে অনেক সাহায্য করে। তাছাড়া রক্তনালীগুলোও পরিষ্কার করে থাকে।

১০. হাঁপানি রোধে- আপনি যদি পারেন আধা গ্রাম গুঁড়ো করা গোলমরিচের সাথে সমপরিমাণ মধু এবং আদা মেশান। আপনি দিনে অন্তত তিনবার এই মিশ্রিত জল খান। এটা হাঁপানি রোধে সহায়তা করবে।

১১. গ্যাস্ট্রিক আলসার থেকে মুক্তি- আপনার হজম সমস্যার সমাধানেও কাজ করে মধু। একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, গ্যাস্ট্রিক আলসার থেকে মুক্তি পেতে একজন ব্যক্তি প্রতিদিন নিয়মিত তিন বেলা দুই চামচ করে মধু খেতে পারে। এতে করে গ্যাস্ট্রিক আলসার থেকে মুক্তি পেতে পারেন।

১২. মধু আয়ু বৃদ্ধি করে- গবেষণায় আরও দেখা গেছে, নিয়মিত যারা মধু ও সুষম খাবারে অভ্যস্ত তুলনামূলকভাবে সেসব ব্যাক্তিরা বেশি কর্মক্ষম ও নিরোগ হয়ে বেঁচে থাকে। মধুতে থাকা উপাদান(Material) গরম কোনো কিছুর সংস্পর্শে বিষাক্ত হয়ে যায়।

মধু(Honey) কখনো কোনো পরিস্থিতিতে গরম করা বা রান্নায় ব্যবহার করা উচিত নয়। মধু এমনি খাওয়াই ভালো। বাজার(Market) থেকে কেনা মধু এমনিতেই প্রক্রিয়াজাত করার সময় তাপের সংস্পর্শে আসে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্লাস্টিকের কৌটায় বিক্রি হয়। এর ফলে মধুর গুণাগুণ এমনিতেই কমে যায়। তার ওপর গরম কিছুতে মিশিয়ে পান করলে কার্যকারিতা কমে যায়।
সুস্থ থাকুন, নিজেকে এবং পরিবারকে ভালোবাসুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *