নবনীতা দত্ত তিথি:

বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, যিনি নারী জাগরণের অগ্রদূত হিসেবে সমধিক পরিচিত, জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর, রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে। ৯ ডিসেম্বর, ১৯৩২ তাঁর মৃত্যু দিবস। মাত্র ৫৩ বছর বেঁচেছিলেন এই মহীয়সী নারী। আর এ স্বল্প সময়েই তিনি যুদ্ধ করে গেছেন প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে।

ছোটবেলা থেকেই রোকেয়া স্বপ্ন দেখতেন মেয়েরা লেখাপড়া করে সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। কিন্তু তাঁর পারিবারিক পরিবেশই ছিল না তাঁর অনুকূলে। তাঁর বাবা নারীশিক্ষার পক্ষপাতি ছিলেন না। তাই তাঁর জীবনের প্রথম যুদ্ধই শুরু হল পরিবারের সাথে।

নারীশিক্ষার বিরুদ্ধে থাকলেও ছেলেদেরকে শিক্ষিত করতে কোনও ত্রুটি রাখেন নি তাঁর বাবা। প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে তাই ছেলেদের মনেও এসেছিল আমূল পরিবর্তন। তাঁরাও চাইতেন তাঁদের বোনেরা যেন শিক্ষিত হয়। বড় ভাই ইব্রাহিম সাবেরের সহযোগিতায় তাই সকলের অগোচরে, মাঝরাতে, মোমবাতির ক্ষীণ আলোয় শুরু হল রোকেয়ার পড়ালেখা। কিন্তু যখন এ ঘটনা জানাজানি হয়ে গেল তখন কিছুটা শাস্তিস্বরূপই তাঁকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হল মাত্র ১৬ বছর বয়সে, স্বামী খাঁন বাহাদুর সাখাওয়াত হোসেন। শাস্তিস্বরূপ বিয়ে দেওয়া হলেও এ বিয়ে যেন আশীর্বাদ হয়ে এল রোকেয়ার জীবনে।

সাখাওয়াত হোসেন ছিলেন নারী শিক্ষার পক্ষে। তিনি চাইতেন রোকেয়া যেন নিজের পায়ে দাঁড়ান এবং সেই সাথে সমাজের অন্য মেয়েদের জন্যেও কাজ করে যান। স্বামীর সহযোগিতায় তাই যুদ্ধের পথ এবার কিছুটা হলেও মসৃণ হল।

নারীর অধিকার রক্ষায় এবার কাজ করতে লাগলেন রোকেয়া। তখনই বুঝতে পারলেন নারীদেরকে যথার্থ মর্যাদায় আসীন করতে গেলে নারীশিক্ষার বিকল্প নেই। ঠিক সেই মূহুর্তেই মেয়ে, স্বামী সবাইকেই হারালেন তিনি। যুদ্ধ এবার নিজের বিরুদ্ধে নিজের। যুদ্ধে জয়ী হয়ে আবার ফিরে আসলেন নারীদের হয়ে কাজ করতে।

ভাগলপুরে তিনি শুরু করলেন সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল। কিন্তু প্রচুর বাধা বিপত্তির মুখে তাঁকে চলে যেতে হল কলকাতায়। ১৯১১ সালে মাত্র ৮ জন ছাত্রী নিয়ে তিনি শুরু করলেন নতুন স্কুল। এ স্কুলটি ছিল ইংরেজি ভাষায় শিক্ষাদানকারী প্রথম মুসলিম বালিকা বিদ্যালয়।

১৯১৬ সালে কলকাতায় “আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম” নামে একটি মহিলা সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। নারীদের ভোটাধিকার আন্দোলনেও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। ১৯৩০ সালের ২ ডিসেম্বর প্রথম মুসলিম মহিলা হিসেবে উড়োজাহাজে চড়ে আকাশ ভ্রমণের সুযোগ গ্রহণ করেছিলেন তিনি।

তিনি যেদিন মারা যান সেদিনও তিনি লেখালেখি করছিলেন নারীর অধিকার নিয়ে। তাঁর চিন্তাচেতনায় গেঁথে ছিল-

“মেয়েমানুষ নয়, মানুষ হয়ে বাঁচতে হবে, তবেই সার্থক মানবজনমের।”

উনি মারা যাওয়ার এত বছর পর এসেও মেয়েরা কি নিতে পেরেছে স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ? অনেকে যুক্তি দাঁড় করাবে মেয়েরা এখন পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছে, সুযোগ পাচ্ছে কর্মক্ষেত্রে, বাস-ট্রেনেও মেয়েদের সিট এখন রিজার্ভ করা। কিন্তু এগুলোর মাধ্যমেই কি বুঝা যায় মেয়েরা আজ স্বাধীন? বদলে গিয়েছে সমাজের চিন্তাধারা? কিংবা পূরণ হয়েছে রোকেয়ার স্বপ্ন?

আমি যদি বলি, “না, পূরণ হয়নি।” প্রশ্ন উঠবে কিভাবে হয়নি? সমাজে আজ ও দেখা যায় মেয়েদের উপর হচ্ছে নানা ধরনের সামাজিক মানসিক অত্যাচার। মেয়েদেরকে পণ্য হিসেবে যৌতুক নিয়ে ক্রয় করছে পাত্রপক্ষ। ক্রমাগত বেড়ে চলেছে ধর্ষণ, গণধর্ষণ কিংবা বধূনির্যাতন। এমনকি আজকাল ছাড় পাচ্ছে না মেয়েশিশুও। তাকেও হতে হচ্ছে সমাজের ঘৃণ্য চিন্তাভাবনার শিকার। সমাজের চিন্তাভাবনা আজও পালটায়নি। কিভাবে পালটায়নি সে ব্যাপারে আলোকপাত করতে আমি বলছি আজ থেকে প্রায় ৯ বছর আগে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা।

২০১২ সালের ঠিক এই ডিসেম্বর মাসেই ভারতের দিল্লিতে ঘটে যায় এক ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ড – “নির্ভয়া হত্যাকাণ্ড”, যা আলোড়ন তুলে পুরো বিশ্বজুড়ে। চলন্ত গাড়িতে গণধর্ষণের পর তাঁর নগ্ন দেহ ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয় গাড়ি থেকে।

নির্ভয়া হত্যাকারীর জবানবন্দিমূলক একটি তথ্যচিত্র সম্প্রতি দৃষ্টিগোচর হয় আমার। যেখানে আমি দেখতে পাই, হত্যাকারীর ন্যূনতম অনুশোচনা নেই এ হত্যাকাণ্ডে। বরং এ আত্মতৃপ্তিতে আছে এই ভেবে যে সে শেষমেশ শাস্তি দিতে পেরেছে নির্ভয়াকে। কিসের শাস্তি?? মেয়ে হয়ে বাইরে বের হওয়ার শাস্তি, মেয়ে হয়ে পড়াশোনা করার শাস্তি।

এ চিন্তাভাবনা শুধু পাশের দেশের একজন পুরুষের নয়, বরং এ দেশের অনেক নারী-পুরুষেরও। হ্যাঁ, আশ্চর্য হলেও সত্যি, এমন ঘৃণ্য চিন্তাভাবনা পোষণ করে রাখেন অনেক নারীও। আজকের দিনে এসেও মেয়েরা পড়াশুনা করলে উচ্ছন্নে যাবে বলে চিন্তা করা হয়। আজকের দিনে এসেও মেয়েদের সন্ধ্যার পর বাইরে বের হওয়া নিষেধ। যদি কোনও প্রয়োজনে একটি মেয়ে বাইরে বের হয়ও তার চরিত্রে কালিলেপন করতে ওঁৎ পেতে থাকে এ সমাজ।

ধর্ষণের কারণ হিসেবে দোষারোপ করা হয় ধর্ষিতার চরিত্রকে, পোশাককে। কিন্তু কেউ ধর্ষকের মানসিকতাকে দোষারোপ করে না। তাই আজও মেয়েরা সেই বন্দি হয়েই রয়ে গেছে।

বেগম রোকেয়ার মৃত্যুর এত বছর পর এসেও সমাজ আমাদের মেয়ে মানুষ করেই রাখল, মানুষ আর হতে দিল না।

আরো পড়ুন:

মাইডাস সেন্টারে চলছে নারী উদ্যোক্তাদের পণ্য নিয়ে বারুণী মেলা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *