স্বাস্থ্য

বিশ্বে ওমিক্রনে এখন পর্যন্ত মৃত্যুর খবর নেই

নিখিল মানখিন, ধূমকেতু বাংলা: করোনার নতুন ভেরিয়েন্ট ‘ওমিক্রন’ এর ঝুঁকির সুনির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক তথ্য উৎঘাটনে কাজ করে যাচ্ছেন বিশ্বের প্রখ্যাত বিজ্ঞানীরা। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওমিক্রন নিয়ে গবেষণা চলছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ কোনো দেশই ওমিক্রন এর ঝুঁকির মাত্রার সুনির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক তথ্য নিরুপণ করতে পারেনি। সংক্রমণ ছড়ালেও পূর্বের ভেরিয়েন্টগুলোর তুলনায় বেশি বিপদজনক হয়ে উঠতে পারেনি ওমিক্রন। এখন পর্যন্ত বিশ্বে ওমিক্রনে মৃত্যুর খবর নেই বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওমিক্রন ও আগের ভেরিয়েন্টগুলোর মধ্যকার পার্থক্য নির্ণয় এবং ক্ষতিকর দিকসমূহ নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দিতে পারেনি। আগেও করোনাভাইরাসের বেশ কয়েকটি ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে ব্যাপক উদ্বেগ ও আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত সেসব আতঙ্ক কেবল কাগজ কলমেই সীমাবদ্ধ ছিল। যেমন- এ বছরের শুরুতে মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আতঙ্ক তৈরি করেছিল বেটা ভেরিয়েন্ট। ইমিউন সিস্টেমকে পাশ কাটিয়ে শরীরে প্রবেশ করার সক্ষমতা সবচেয়ে বেশি ছিল করোনাভাইরাসের এই ভেরিয়েন্টটি। কিন্তু দ্রুত সংক্রমিত হওয়া ডেল্টা ভেরিয়েন্টের কাছে এটি ধরা খেয়ে যায়।

‘ওমিক্রন’ শনাক্তের দুই সপ্তাহের বেশি সময় অতিবাহিত হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, গত ২৪ নভেম্বর দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম করোনার ওমিক্রন ভেরিয়েন্ট শনাক্ত হয়। করোনার এই ধরনকে উদ্বেগজনক ভেরিয়েন্ট হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে সংস্থাটি।

বিশ্বে এখন পর্যন্ত ওমিক্রনে মৃত্যু নেই : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা

প্রথম শনাক্তের দুই সপ্তাহের ব্যবধানে বিশ্বের প্রায় ৪০টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে করোনা ভাইরাসের নতুন ভেরিয়েন্ট ওমিক্রন। ভাইরাসটির ছড়িয়ে পড়ার সক্ষমতার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা শুরুতেই এটিকে ভেরিয়েন্ট অফ কনসার্ন হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। তবে কোনও মৃত্যুর খবর রেকর্ড হয়নি। যা কিছুটা স্বস্তিদায়ক।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কর্মকর্তা মাইকেল রায়ান জানান, এখনই এর সংক্রমণ ক্ষমতা নিয়ে কিছু বলার সময় হয়নি। তবে যেভাবে স্ট্রেনটি ছড়িয়ে পড়ছে, তা সাবধান হওয়ার মতোই। দক্ষিণ আফ্রিকা জানিয়েছে, এই স্ট্রেনে দ্বিতীয় বা তৃতীয় বারের জন্য কোভিড সংক্রমিত হচ্ছেন অনেকে। বাচ্চাদের সংক্রমিত হওয়ার ঘটনা বেশি। পাঁচ বছরের নীচে শিশুদের সংক্রমিত হয়ে হাসপাতালে ভর্তির ঘটনা বাড়ছে। আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় ওমিক্রনের প্রবেশ ঘটেছে কয়েকদিন আগে।

জানা গেছে, স্ট্রেনটির স্থানীয় সংক্রমণও শুরু হয়ে গেছে এই দুই দেশে। অর্থাৎ এখানে এমন কেউ সংক্রমিত হয়েছেন, যারা সম্প্রতি বিদেশ সফর করেননি। স্থানীয় এলাকাতেই কারও থেকে আক্রান্ত হয়েছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সতর্ক করে বলেছে, এই নতুন ভেরিয়েন্টটি কতটা শক্তিশালী তা জানতে কয়েক সপ্তাহ সময় লেগে যেতে পারে। এটি গুরুতর অসুস্থতার কারণ কি-না এবং এর বিরুদ্ধে কতটা কার্যকর চিকিৎসা ও ভ্যাকসিন রয়েছে সেটি যাচাই করে দেখা হবে।

অতি সংক্রামক, ঝুঁকি কম:

করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন বিশ্বের অনেক দেশে ছড়িয়ে পড়লেও এটিকে এখনও বড় ধরনের ঝুঁকি দেখছেন না মার্কিন শীর্ষ সংক্রামক ও রোগ বিশেষজ্ঞ ড. অ্যান্থনি ফাউচি। তার মতে, ওমিক্রনের তীব্রতা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অধিক তথ্যের প্রয়োজন বিজ্ঞানীদের।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রধান উপদেষ্টা ড. ফাউচি সিএনএন-এর স্টেট অব দ্য ইউনিয়নে এক সাক্ষাৎকার দেন। সেখানেই তিনি করোনার নতুন ধরন সম্পর্কে কথা বলেন।

ফাউচি বলেন, এই ভেরিয়েন্টের তীব্রতার যে প্রাথমিক ইঙ্গিত পাওয়া গেছে তা বেশ আশাব্যঞ্জক। কিন্তু আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত ওমিক্রন দেখে যা মনে হচ্ছে এটি অতি সংক্রামক। তবে ঝুঁকি কম। এই ভেরিয়েন্টের বিষয়ে দ্রুত বিবৃতি দিলে একটু আগেই হয়ে যাবে। তবে ডেল্টার তুলনায় এটির ক্ষতির মাত্রা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার আগ পর্যন্ত আমাদের সতর্ক থাকতে হবে বলে জানা ড. অ্যান্থনি।

দ্রুত ছড়ালেও ভয়ংকর নয় বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশের গণবিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. বিজন কুমার শীল। গত ৭ ডিসেম্বর রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ওমিক্রনকে ভয়ংকর ভাবার কারণ এর মিউটেশন। এখন পর্যন্ত ডেল্টা ধরনের সর্বোচ্চ ১৫টি মিউটেশন হয়েছে। সেখানে ওমিক্রনের হয়েছে ৫০টি। যার ৩২টি স্পাইক প্রোটিন। তবে এই মুহূর্তে ডেল্টার মত আতঙ্কিত করার মত অবস্থায় যায়নি ওমিক্রন। এটাই শেষ নয়, খারাপ হতে পারে। আফ্রিকা থেকে অন্যান্য দেশে শনাক্তের পর এটি আরও শক্তিশালী হয়েছে, সংক্রমণ যত বাড়বে ততটাই এটি মারাত্মক হতে থাকবে।

এই গবেষক বলেন, ইতিমধ্যে যারা ভ্যাকসিন নিয়েছেন, তারা অনেকটা সুরক্ষিত। তবে এর বিপরীতে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা কতটুকু সেটি সম্পর্কে এখনো পর্যালোচনা চলছে।

ওমিক্রনের অপর্যাপ্ত তথ্যের বেড়াজালে বিশ্ব :

আগের যে কোনও সময়ের তুলনায় দক্ষিণ আফ্রিকায় এখন দ্রুত ছড়াচ্ছে করোনাভাইরাস, সোমবার দেশটির প্রেসিডেন্ট এমন মন্তব্য করেছেন। নতুন ওমিক্রন ভেরিয়েন্ট যে এখন সেখানে মহামারির মূল কারণ তার ইঙ্গিত পাওয়া যায় এই বক্তব্যে। কিন্তু প্রাথমিক পর্যালোচনায় ধারণা করা হচ্ছে, ওমিক্রনে হয়ত অন্যান্য ভেরিয়েন্টর তুলনায় কম গুরুতর রোগ দেখা দিচ্ছে।  প্রিটোরিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ হাসপাতাল ভবনের গবেষকরা জানান, তাদের কাছে আসা করোনাভাইরাসের আগের রোগীদের তুলনায় নতুন আক্রান্তরা কম অসুস্থ।

অন্যান্য হাসপাতালেও একই প্রবণতা। এমনকি তারা বলছেন, বেশিরভাগ নতুন আক্রান্তদের কোভিড উপসর্গ নেই, অন্য কারণে তাদের ভর্তি করা হয়েছে। অবশ্য বিজ্ঞানীরা কম গুরুতর হওয়ার বিষয়টি সম্ভাব্য সুসংবাদ হিসেবে ধরে নেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে বলছেন। ওমিক্রন ইমিউনিটি এড়াতে পারে– এমন দুঃসংবাদের ক্ষেত্রেও তাদের অবস্থান একই। এটি মাত্র গত মাসে শনাক্ত হয়েছে। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বিষয়টি বলতে পারার জন্য বিশেষজ্ঞদের আরও বেশি গবেষণা প্রয়োজন।

ওমিক্রন কম প্রাণঘাতীর বিষয়ে জন্স হপকিন্স ব্লুমবার্গ স্কুল অব পাবলিক হেলথের এপিডেমিওলজিস্ট ড. এমিলি এস. গার্লি বলেন, এমনটি সত্য হলে অবাক হওয়ার মতো না। কিন্তু আমরা এখনই এই উপসংহারে পৌঁছাতে পারি বলে আমি নিশ্চিত না।

পর্যাপ্ত তথ্যের অভাবে বিভিন্ন দেশের সরকার ওমিক্রন শনাক্তের ঘটনায় আন্তর্জাতিক ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা ও কড়াকাড়ি এবং টিকা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তায় গুরুত্বারোপ করেছে। মহামারির শুরুতে বিলম্বিত পদক্ষেপ নেওয়ার সমালোচনায় থাকা বিশ্বনেতারা পদক্ষেপ নেওয়াতে উদগ্রীব। অবশ্য অনেক বিশেষজ্ঞ প্রশ্ন তুলছেন, ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা মাত্রাতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া কিনা।  দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে ফ্লাইট বাতিল করেছে অনেক দেশ দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে ফ্লাইট বাতিল করেছে অনেক দেশ ওমিক্রন ভেরিয়েন্ট ছড়িয়েছে খুব দ্রুত এবং এখন পর্যন্ত ছয়টি মহাদেশের ৪০টির বেশি দেশে শনাক্ত হয়েছে।

স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও গবেষকরা বলছেন, এটি করোনার সবচেয়ে সংক্রামক ভেরিয়েন্ট হতে পারে এবং গত বছর শনাক্ত হওয়া ডেল্টা ভেরিয়েন্টর দাপট শিগগিরই ছাপিয়ে যেতে পারে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিজ্ঞানীরা বলছেন, ওমিক্রন এখন দেশটিতে দাপট ছড়াচ্ছে। এক মাস আগেও সেখানে দৈনিক শনাক্তের সংখ্যা ছিল ৩০০ জনের কম। শুক্রবার থেকে দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা ১৬ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।

এখন পর্যন্ত প্রিটোরিয়ার স্টিভ বিকো অ্যাকাডেমিক অ্যান্ড স্বওয়ানে ডিস্ট্রিক্ট হসপিটাল কমপ্লেক্সের চিকিৎসকদের একটি প্রতিবেদন ওমিক্রন নিয়ে আতঙ্কিত না হওয়ার পক্ষে সবচেয়ে দৃঢ় সমর্থন হাজির করেছে। যদিও প্রতিবেদনটির গবেষক ড. ফারিদ আব্দুল্লাহ এমন উপসংহারে না পৌঁছানোর পক্ষেও উদ্বেগজনক কারণ তুলে ধরেছেন।

দক্ষিণ আফ্রিকার মেডিক্যাল রিসার্চ কাউন্সিলের এইচআইভি/এইডস ও টিউবারকিউলোসিস রিসার্চ কার্যালয়ের পরিচালক ড. আব্দুল্লাহ গত বৃহস্পতিবার হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ৪২ জন রোগীকে পর্যালোচনা করেছেন। তিনি দেখতে পেয়েছেন, এদের মধ্যে ২৯ জন (৭০ শতাংশ) স্বাভাবিকভাবে নিশ্বাস নিচ্ছেন। ১৩ জন অক্সিজেন নিচ্ছেন এবং চারজন কোভিড সংশ্লিষ্ট নয় এমন রোগে ভর্তি হয়েছেন। ৪২ জনের মধ্যে মাত্র একজন ইনটেনসিভ কেয়ারে ভর্তি ছিলেন। দেশটির জাতীয় সংক্রামক রোগ ইন্সটিটিউটের পরিসংখ্যানও একই ধরনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। তাদের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুই সপ্তাহ ধরে সংক্রমণ বাড়ার পরও ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে ভর্তি রোগীর সংখ্যা মাত্র ১০৬। বেশিরভাগের রোগ পরীক্ষায় দেখা গেছে কোভিড সংশ্লিষ্ট নয় এমন রোগে তারা ভর্তি হয়েছেন। সতর্কতা অবলম্বনে গুরুত্বারোপ  জন্স হপকিন্সের ড. গার্লি উল্লেখ করেছেন, রোগের ভয়াবহতা শুধু ভেরিয়েন্টর ওপর নির্ভর করে না, কে আক্রান্ত হচ্ছে সেটিও গুরুত্বপূর্ণ।

আরো পড়ুন:

তৃতীয় ডোজ নিয়েও গুতেরেস করোনা আক্রান্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *