প্রচ্ছদ

বিশ্বের ৩০ প্রভাবশালী প্রতিবন্ধী নেতার একজন বাংলাদেশের ভাস্কর

নিজস্ব প্রতিবেদক, ধূমকেতু ডটকম: চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার ধলঘাট ইউনিয়নের বাগদণ্ডী গ্রামে জন্মের সময় গ্রামটিতে কোনো হাসপাতাল বা চিকিৎসক ছিলেন না। জন্মের পর নাক ও মুখ দিয়ে রক্তক্ষরণ হয়। ছেলেটির বয়স দুই বছর হলে সে চোখে দেখতে পায় না, তা প্রথম বুঝতে পারেন মা–বাবা। চোখে দেখতে না পাওয়া ছেলেটির নাম ভাস্কর ভট্টাচার্য। কাজের মধ্য দিয়ে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জীবন পরিবর্তন করতে পেরেছেন—এ ধরনের ৩০ জন প্রভাবশালী নেতার মধ্যে তিনি একজন। আর বাংলাদেশ থেকে এ ধরনের নেতা নির্বাচিত ব্যক্তিদের মধ্যে তিনিই প্রথম।

গত ২৬ জুলাই অনলাইন আয়োজনের মাধ্যমে ভাস্কর ‘ডি-৩০ ডিজঅ্যাবিলিটি লিস্ট-২০২১’ সম্মাননা পেয়েছেন। ১৯৯০ সালে যাত্রা শুরু করা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবন্ধীবিষয়ক আইনের (এডিএ) ৩১ বছর পূর্তি উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, নেপাল, কেনিয়াসহ বিভিন্ন দেশের প্রতিবন্ধী নেতাদের সঙ্গে ভাস্কর এ সম্মাননা পেয়েছেন। এ সম্মাননার ফলে এই ৩০ জন নেতা বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ফোরামে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার আদায়ে কথা বলবেন। তাঁদের কথা অন্যরা গুরুত্ব দেবেন। আইন-নীতিতে পরিবর্তন আনবেন বিশ্বনেতারা।

ভাস্কর ভট্টাচার্য সরকারের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অ্যাকসেস টু ইনফরমেশনের (এটুআই) ন্যাশনাল কনসালট্যান্ট (অ্যাকসেসেবিলিটি) এবং চট্টগ্রামের ইয়াং পাওয়ার ইন সোশ্যাল অ্যাকশনের (ইপসা) প্রোগ্রাম ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

গত শনিবার ভাস্কর বলেন, ‘এ সম্মাননা পেতে আমাকে আবেদন বা কিছুই করতে হয়নি। আমার বিভিন্ন কাজের জন্য নির্বাচিত করা হয়েছে। এটি কাজের ক্ষেত্রে বিশাল একটি স্বীকৃতি। সবচেয়ে বড় কথা, আমার নামের পাশে বাংলাদেশ লেখা থাকবে। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের মানুষ বাংলাদেশের নাম উচ্চারণ করবে। নির্বাচিত ৩০ জন জাতিসংঘসহ বিভিন্ন ফোরামে কথা বলার সুযোগ পাবেন।’

প্রতিবন্ধী মানুষের প্রবেশগম্যতা, তথ্যপ্রযুক্তিতে অভিগম্যতা ও অন্তর্ভুক্তি নিয়ে ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে কাজ করছেন ভাস্কর। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ২০১৮ সালে তিনি ‘ডিজিটাল এমপাওয়ারমেন্ট অব পারসনস উইথ ডিজঅ্যাবিলিটিস’ শীর্ষক ইউনেসকো পুরস্কারও পেয়েছিলেন। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীসহ সব শিক্ষার্থীর উপযোগী ডেইজি মাল্টিমিডিয়া ডিজিটাল বই প্রকাশের জন্যই মিলেছে এ পুরস্কার। অ্যাকসেসেবল ডিকশনারি তৈরির জন্যও পেয়েছেন সম্মাননা।

চোখে দেখতে পান না বলে ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনা নিয়ে আক্ষেপ ছিল ভাস্কর ভট্টাচার্যের। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য আবেদন করলে চোখে দেখতে পান না বলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভাস্করসহ আরও কয়েকজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীর আবেদন নাকচ করে দিয়েছিল। ভর্তির দাবিতে তখন অনশনে নামেন তাঁরা। দাবির মুখে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়। ভাস্কর সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ফিল্ডওয়ার্ক করতে পারবেন না বলে ভর্তি নেয়নি কর্তৃপক্ষ। ইতিহাস বিভাগে পড়াশোনা শেষ করেন। ব্রেইলে লেখা বই না থাকাসহ বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা পাড়ি দিতে হয় ভাস্করকে।

অনার্স পাস করার পর ২০০২ সালে ভাস্কর জাপানে ডাসকিন লিডারশিপ ট্রেনিং করার সুযোগ পান। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল থেকে ১০ জনকে নির্বাচিত করা হয়েছিল এক বছরের এ প্রশিক্ষণে। এ ট্রেনিং প্রোগ্রামেই কম্পিউটারে ভাস্করের প্রথম হাতেখড়ি হয়। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের ওপর এই প্রশিক্ষণে জীবনের মোড় ঘুরে যায় ভাস্করের। দেশে ফিরে মাস্টার্স করেন তিনি।

পড়াশোনা শেষ করে প্রথম এক বছর কোথাও চাকরি পাননি ভাস্কর। কেউ বিশ্বাস করতে পারতেন না যে তিনি কোনো কাজ করতে পারবেন। এক বছর শুধু স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করে কাটিয়েছেন। আর সেই ভাস্করই চট্টগ্রামে প্রথম কম্পিউটারাইজড ব্রেইল প্রোডাকশন সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন। এ কাজে তাঁকে সহযোগিতা করে ‘জাপান ব্রেইল লাইব্রেরি’ এবং ‘মালয়েশিয়ান কাউন্সিল ফর দ্য ব্লাইন্ড’। এসব কাজের মধ্য দিয়েই চট্টগ্রামের উন্নয়ন সংস্থা ইপসাতে চাকরি পাওয়া সহজ হয়।

ভাস্কর এ পর্যন্ত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের বিনা মূল্যে পড়ার জন্য বাংলা স্ক্রিন রিডিং সফটওয়্যার তৈরি করেছেন। প্রথম থেকে দশম শ্রেণির সব বই ডিজিটাল মাল্টিমিডিয়া (পুরো টেক্সট, পুরো অডিওসহ) বইয়ে রূপান্তরিত করেছেন। এ বইগুলো দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা পড়তে পারছে। সহজে ব্রেইলও করতে পারছে। তুরস্কে অনুষ্ঠিত ইন্টারনেট গভর্ন্যান্স ফোরাম থেকে ডব্লিউএসআইএফ এশিয়া পুরস্কার, ন্যাশনাল ই-কনটেন্ট অ্যান্ড আইসিটিফরডি চ্যাম্পিয়ন অ্যাওয়ার্ড, মন্থন পুরস্কার, আইএসআইএফ এশিয়া পুরস্কার, বাংলাদেশে সরকারের প্রধানমন্ত্রী পুরস্কার ২০১৬, হেনরি ভিসকার্ডি অ্যাওয়ার্ড ২০১৭–সহ পেয়েছেন বিভিন্ন পুরস্কার। জাতিসংঘের সদর দপ্তরে কয়েকবার প্যানেল আলোচক হিসেবে অংশ নিয়েছেন ভাস্কর।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে দেশের প্রথম অন্তর্ভুক্তিমূলক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে তৈরি করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন ভাস্কর। ভাস্কর দুই লাখেরও বেশি পৃষ্ঠার পাঠ্য উপকরণকে অভিগম্য আকারে তৈরি করেছেন। পাঁচ শতাধিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে আইসিটি দক্ষতা এবং সহায়ক প্রযুক্তিতে দক্ষ করে তুলতে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। কোভিড-১৯ মহামারিতে জাতীয় হেল্পলাইন ৩৩৩ এবং মাইগভ–এর সেবা–সম্পর্কিত তথ্যগুলো প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সহজগম্য করতে সরকারের উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি।

ব্যক্তিজীবনে ভাস্কর দুই মেয়ের জনক। তাঁর স্ত্রী শ্যামশ্রী দাশ ইপসাতে প্রজেক্ট ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *