স্বাস্থ্য

বিল গেটসের প্রসংশায় ভাসলেন বাংলাদেশী বিজ্ঞানী সমীর সাহা ও মেয়ে সেঁজুতি সাহা

ধূমকেতু প্রতিবেদক: নিজের জীবন ও কর্মের জন্য বহু মানুষের নায়ক বিল গেটস। আবার তার কাছে নায়ক এমন অনেক মানুষ, যাঁরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করছেন বিশ্বের নানা প্রান্তে। তেমন দুই বাংলাদেশী ড. সমীর সাহা ও তার মেয়ে ড. সেঁজুতি সাহাকে নিয়ে কিছুদিন আগে বিল গেটস লিখেছেন নিজের ব্লগ ‘গেটসনোট’-এ। সেখানে তাদেরকে নিজের নায়ক হিসেবেই আখ্যা দিয়েছেন। সম্প্রতি বাংলাদেশে তারাই সর্বপ্রথম করোনার জিনোম সিকোয়েন্স বা জীবন রহস্য উদঘাটন করেছেন।

গত মঙ্গলবার (১২ মে) দুই বাংলাদেশী ড. সমীর সাহা ও তার মেয়ে ড. সেঁজুতি সাহা প্রতিষ্ঠিত চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশন এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, দেশে প্রথমবারের মতো করোনা ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স সম্পন্ন হয়েছে। এই বাবা-মেয়েই দেশে সর্বপ্রথম করোনার জিনোম সিকোয়েন্স উদঘাটন করেছেন- এমনটাই দাবি তাদের।

এ জিনোম সিকোয়েন্স ভাইরাসটির গতি-প্রকৃতি ও প্রতিরোধের উপায় খুঁজতে সহায়তা করবে। ড. সমীর সাহার নেতৃত্বাধীন প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে সিকোয়েন্সটি জমা দিয়েছেন অনুজীব বিজ্ঞানী ড. সেজুঁতি সাহা।

এর আগে ঢাকা শিশু হাসপাতালের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের প্রধান ও অণুজীববিজ্ঞানী অধ্যাপক সমীর সাহা এবং তার মেয়ে ড. সেঁজুতি সাহার ভূয়সী প্রশংসা করেন মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস। স্বাস্থ্য বৈষম্যের বিরুদ্ধে বাবা-মেয়ের একসঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে বিল গেটস তার নিজের ব্লগে (গেটস নোটস ডটকম) লেখেন, বাবা-মেয়ে বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যমান উন্নয়নে প্রাণবন্ত টিম হিসেবে কাজ করছে। উচ্চ শিশুমৃত্যুতে ধনী ও দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে যে ব্যবধান ছিল, তা হ্রাসে তারা কাজ করে চলেছেন। এ জন্য তারা সংক্রামক রোগের ভ্যাকসিনের পাশাপাশি তথ্য-উপাত্ত ও রোগ নির্ণয়ের অত্যাধুনিক ব্যবস্থাপনা প্রয়োগ করছেন। ভ্যাকসিন নিয়ে তাদের গবেষণার সুফল পাচ্ছে বাংলাদেশের পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশও।

বাংলাদেশে ভ্যাকসিন প্রবর্তনে ড. সমীর সাহার প্রশংসা করে বিল গেটস লিখেছেন, তার প্রতিষ্ঠিত চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে শিশুদের টিকাদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। এ কাজে সরকারের পক্ষ থেকে তাকে জোরালো সহায়তা করা হয়েছে। সরকারের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির আওতায় দেশে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যু হ্রাস পেয়েছে। একই সঙ্গে শিশুস্বাস্থ্যের অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে। বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের প্রায় ৯৮ শতাংশই এখন ভ্যাকসিন সুবিধার আওতায় এসেছে।

দেশে মেনিনজাইটিস ও নিউমোনিয়ার ভ্যাকসিন প্রবর্তনে ড. সমীর সাহার ভূমিকার কথা উল্লেখ করে বিল গেটস লেখেন, এ দুটি রোগ ছিল বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর বড় কারণ। এই রোগের ভ্যাকসিন আমেরিকার মতো ধনী দেশগুলোতে সহজলভ্য হলেও বাংলাদেশে ছিল দুর্লভ। সমীর নিরলসভাবে কাজ করে এ দুটি রোগের তথ্যউপাত্ত সরবরাহ করে স্বাস্থ্য খাতের সরকারি নীতিনির্ধারকদের এই ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা সম্পর্কে বোঝাতে সক্ষম হন। এর ফলে হাজার হাজার মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হয়েছে।

মেয়েকে জীববিজ্ঞানে উদ্বুদ্ধ করার পেছনে ড. সমীরের ভূমিকার কথা উল্লেখ করে বিল গেটস লিখেছেন, সমীর সাহার পরিবারে রাতের খাবার টেবিলে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও সংক্রামক রোগ নিয়ে আলোচনা গুরুত্ব পেত। ড. সমীর তার বৈজ্ঞানিক লেকচারের বিষয় কিংবা বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সমস্যার চ্যালেঞ্জ নিয়ে তিনি যা শিখেছেন তা শেয়ার করতেন। সমীরের স্ত্রীও একজন জীববিজ্ঞানী।

ছোট্ট সেঁজুতির মনে সেই আলোচনা প্রভাব ফেলে। পরবর্তী সময়ে তিনিও মাইক্রোবায়োলজি বিষয়ে পড়তে আগ্রহী হন। সেঁজুতি এখন তার বাবার সঙ্গে চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনে (সিএইচআরএফ) কাজ করেন। প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ ও অন্যান্য দেশে শিশুমৃত্যুর হার কমাতে সহায়তা করছে। দরিদ্র দেশগুলোতে নবজাতক ও শিশুদের রহস্যময় অসুস্থতার কারণ নির্ধারণে সহজ পন্থা উদ্ভাবন করেছেন সেঁজুতি।

বিল গেটস লিখেছেন, ২০১৭ সালে বাংলাদেশে শিশুদের মধ্যে মেনিনজাইটিস ছড়িয়ে পড়লে সেঁজুতি শিশুদের জেনেটিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে সে রহস্য উদ্‌ঘাটন করেন। দেখা যায়, মশাবাহিত চিকুনগুনিয়ার মাধ্যমে মেনিনজাইটিস ছড়িয়ে পড়ে। তবে রহস্যের গভীরে যেতে তিনি নমুনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ছুটে যান পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য। এর পর তিনি বাংলাদেশে মেনিনজাইটিস ও অন্যান্য প্রাণঘাতী রোগ ছড়িয়ে পড়া রোধে একটি স্বল্প ব্যয়সাপেক্ষ ডায়াগনস্টিক যন্ত্র বসান। তার এই গবেষণা বাংলাদেশে চমৎকারভাবে কাজে লেগেছে। এ গবেষণার মাধ্যমে সরকার সবচেয়ে কার্যকর পন্থায় রোগ নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবে। এটা নতুন ভ্যাকসিন তৈরিতেও সহায়ক হবে।

বাংলাদেশের অবস্থার উন্নতি হলেও দেশটিকে আরও অনেক দূর যেতে হবে বলে মনে করেন মাইক্রোসফটের এই প্রতিষ্ঠাতা। তার প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশ থেকে গোলকিপার হিসেবে সেঁজুতিকে বাছাই করা হয়েছে। সেই গোলকিপার অনুষ্ঠানে সেঁজুতি সাহার দেওয়া বক্তব্য উল্লেখ করে গেটস লেখেন, সেঁজুতি বলেছেন; বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে এখনও অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে।

দেশের বৃহত্তম শিশু সেবাকেন্দ্র ঢাকা শিশু হাসপাতাল থেকে প্রতি বছর ৬ হাজার শিশুকে ভর্তি ছাড়াই ফেরত পাঠাতে হচ্ছে। এর কারণ ৬৬৫টি শয্যার এই হাসপাতালটি সব সসয় রোগী দ্বারা পরিপূর্ণ থাকে। জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন এমন অনেক শিশুকে ফেরত যেতে হয়।

অধ্যাপক সমীর ও তার মেয়ে সেঁজুতির কাজের ফলে বাংলাদেশে ভবিষ্যতে সংক্রামক রোগীর সংখ্যা কমবে এবং হাসপাতালে শয্যা সংখ্যাও বাড়বে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন বিল গেটস।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *