তালেবানের অগ্রযাত্রার মুখে ক্ষমতাচ্যুত আফগানিস্তানের সাবেক সরকারের প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি গত ১৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে বিদেশে পালিয়ে যান। এরপরই অভিযোগ ওঠে গোপনে কাবুল থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাথে করে প্রায় ১৭ কোটি মার্কিন ডলার নিয়ে যান গনি। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা।
এরপরই মার্কিন সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা আশরাফ গনির বিরুদ্ধে বিপুল পরিমাণ অর্থ নিয়ে পালানোর অভিযোগের তদন্ত শুরু করে। তবে সেই তদন্তের মধ্যেই নতুন তথ্য সামনে এনেছেন আশরাফ গনির দেহরক্ষী দলের প্রধান কর্মকর্তা। তার দাবি, বিপুল পরিমাণ টাকা নিয়ে আশরাফ গনির পালিয়ে যাওয়ার অভিযোগটি সত্য। এমনকি টাকা নিয়ে গনির পালানোর একটি ভিডিও ফুটেজও তার হাতে আছে।
সোমবার (১১ অক্টোবর) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম দ্য ডন। এর দিন দুয়েক আগে পৃথক এক প্রতিবেদনে বিষয়টি প্রথম সামনে আনে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ডেইলি মেইল।
প্রতিবেদনে সংবাদমাধ্যম দু’টি জানিয়েছে, তালেবানের হাতে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্বপালনের সময় আশরাফ গনির দেহরক্ষী দলের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পিরাজ আতা শরিফি।
তিনি জানিয়েছেন, তালেবানের অগ্রযাত্রার মুখে কাবুল ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় বিপুল পরিমাণ অর্থবোঝাই বড় বড় ব্যাগ আশরাফ গনিকে নিয়ে যেতে দেখেছেন তিনি। শুধু তাই-ই নয়, টাকা নিয়ে আশরাফ গনির পালানোর সময়কার একটি সিসিটিভি ভিডিও ফুটেজও তার হাতে আছে বলে জানিয়েছেন সাবেক এই কর্মকর্তা।
সাবেক সকোরের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হওয়ায় ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পিরাজ আতা শরিফিকে হাতে পেতে চাইছে তালেবান। সাবেক সরকার ও কর্মকাণ্ড সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেতেই তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চায় কাবুলের বর্তমান সরকার। আর তাই আশরাফ গনির সাবেক এই দেহরক্ষীকে আটক করতে ১০ লাখ আফগানি পুরস্কার ঘোষণা করেছে তালেবান।
তালেবান ক্ষমতায় আসার পর থেকে আফগানিস্তানেই আত্মগোপন করে আছেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পিরাজ আতা শরিফিতবে তালেবান ক্ষমতায় আসার পর থেকে আফগানিস্তানেই আত্মগোপন করে আছেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পিরাজ আতা শরিফি। সেই আত্মগোপন থেকেই ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ডেইলি মেইল অনলাইনকে আতা শরিফি বলেন, ‘আমার কাজ ছিল প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আর তাই আশরাফ গনি কোনো মন্ত্রণালয় বা দফতরে পৌঁছানোর আগে আমার দায়িত্ব ছিল সেখানে দায়িত্বপালনরত সৈনিকদেরকে নিরস্ত্র করা।’
তিনি বলেন, ‘(আগস্টের ১৫ তারিখ) আফগান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে আমরা প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির আসার অপেক্ষায় ছিলাম। তারপর আমি একটি ফোনকল পেলাম; আমাকে বলতে বলা হলো যে- প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে আসার পরিবর্তে প্রেসিডেন্ট বিমানবন্দরে গিয়েছেন। প্রতিরক্ষামন্ত্রীও পালিয়ে গেছেন। আমার বস ও আশরাফ গনির পরিবারের ঘনিষ্ঠ সদস্যদের অবস্থাও তাই।’
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পিরাজ আতা শরিফি দাবি করেন, ‘প্রেসিডেন্ট প্যালেসের একটি সিসিটিভি ফুটেজ রেকর্ডিং আমার কাছে আছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে- প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ থেকে আশরাফ গনি পালানোর আগে আফগানিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘আফগান ব্যাংক’র এক কর্মকর্তা বিপুল পরিমাণ অর্থ নিয়ে সেখানে আসেন। সেখানে ছিল শত শত লাখ মার্কিন ডলার; প্রকৃতপক্ষে শত শত কোটি মার্কিন ডলার। বিপুল পরিমাণ টাকা বোঝাই এরকম ব্যাগ অনেকগুলো ছিল এবং সেগুলোর ওজনও ছিল অনেক বেশি।’
শরিফির দাবি, গনির এমন কর্মকাণ্ডে তিনি হতাশ হয়েছিলেন। কারণ আশরাফ গনিকে তিনি পছন্দ করতেন। তার ভাষায়, গনির নিয়ে পালানো এসব অর্থের পুরোটাই মুদ্রা বিনিময় বাজারের। প্রতি বৃহস্পতিবার কাবুলের মুদ্রা বিনিময় বাজারে ডলার আনা-নেওয়া হয়ে থাকে। তবে পালনোর আগে আশরাফ গনি এগুলো নিজে নিয়ে নেন। কারণ তিনি (আশরাফ গনি) জানতেন, দিন শেষে কি ঘটতে যাচ্ছে! যার কারণে পুরো টাকাটি তিনি নিয়ে নেন এবং পালিয়ে যান।
তবে কাবুল থেকে পালানোর সময় বিপুল পরিমাণ অর্থ সাথে করে নেওয়ার অভিযোগ আগেই অস্বীকার করেছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি। এই অভিযোগকে তিনি ‘পুরোপুরি ও স্পষ্ট মিথ্যা’ বলেও দাবি করেন। তার দাবি, নিজেদের ব্যক্তিগত আর্থিক বিষয়াদি নিয়ে তিনি ও তার লেবানিজ বংশোদ্ভূত স্ত্রী ‘খুবই সতর্ক’ ছিলেন।
উল্লেখ্য, আশরাফ গনি আফগানিস্তান ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পরই তাজিকিস্তানে নিযুক্ত আফগান রাষ্ট্রদূত মোহম্মদ জহির আগবার অভিযোগ করেন যে, গনি যখন দেশ ছাড়েন তখন সাথে করে তিনি ১৬ কোটি ৯০ লাখ মার্কিন ডলার নিয়ে যান। গনির আফগানিস্তান ত্যাগকে ‘দেশ ও জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা’ বলেও সেসময় বর্ণনা করেন তিনি।
এছাড়া গনি পালানোর সময় চারটি গাড়ি ও হেলিকপ্টারে করে বিপুল পরিমাণ অর্থ নিয়ে গেছেন বলে সেসময় অভিযোগ তোলে কাবুলে অবস্থিত রাশিয়ার দূতাবাস।
কাবুলের রুশ দূতাবাসের মুখপাত্র নিকিতা ইশচেঙ্কো গত আগস্ট মাসে জানান, ‘বিপুল পরিমাণ অর্থ ভর্তি ছিল চারটি গাড়ি, তাছাড়া একটি হেলিকপ্টারেও অর্থের একটি অংশ তোলার চেষ্টা করেছিলেন গনি। কিন্তু জায়গা না হওয়ায় অনেক অর্থ টারমার্কে ফেলে যান তিনি।’