নিজস্ব প্রতিবেদক, ধূমকেতু ডটকম: সমস্যা জর্জরিত বেসিক ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডকে (বিডিবিএল) একীভূত করার পরিকল্পনা করছে সরকার। প্রতিষ্ঠান দুটির সার্বিক অবস্থার উন্নতির জন্য সরকার এমন পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে বলে আলোচনা রয়েছে। যদিও একীভূত করার বিষয়টি চূড়ান্ত নয়, তবে দুটি প্রতিষ্ঠানেরই আর্থিক অবস্থা দুর্বল হওয়ায় একীভূত করে সুফল কতটা পাওয়া যাবে, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলছেন, শূন্যের সঙ্গে শূন্য যোগ করলে ফলাফল যেমন শূন্য হয়, তেমনি বিডিবিএল এবং বেসিক ব্যাংক একীভূত করলেও ফলাফল শূন্যই হবে। আবার কেউ কেউ বলছেন, দুর্বল প্রতিষ্ঠান হলেও ব্যাংক দু’টি একীভূত করলে কিছুটা হলেও সুফল পাওয়া যাবে। তবে সুফল পেতে হলে পরিচালনা পর্ষদের দায়িত্ব যোগ্য ব্যক্তিদের হাতে দিতে হবে। সেই সঙ্গে সব স্তরে দক্ষ জনবল নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে কিছু কর্মীকে গোল্ডেন হ্যান্ডশেক (স্বেচ্ছা অবসর) দিয়ে যোগ্য ও দক্ষ নতুন জনবল নিয়ে আসার পরামর্শও দিচ্ছেন কেউ কেউ।
বিডিবিএল ও বেসিক ব্যাংক একীভূত করলে কোনো সুফল পাওয়ার কথা নয়। কারণ শূন্যের সঙ্গে শূন্য যোগ করলে শূন্যই হয়। একীভূত করলেই তো সমাধান হয়ে যাবে না। কথা হলো একীভূত করলে ম্যানেজমেন্টের কী হবে? নতুন ম্যানেজমেন্ট টিমে কারা আসবে? এই গুলোর ওপর নির্ভর করবে কী ফল আসবে।
অবশ্য সবারই অভিমত, দুর্বল দুই প্রতিষ্ঠানকে একীভূত না করে অন্য ভালো কোনো দুটি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। এ ক্ষেত্রে এই দুই ব্যাংকের যে পরিমাণ মূলধন ঘাটতি রয়েছে তা সরকার থেকে পূরণ করে দিতে হবে। তা না হলে কোনো ভালো প্রতিষ্ঠান এমন দুর্বল প্রতিষ্ঠানকে নিতে রাজি হবে না।
১৯৮৯ সালে যাত্রা শুরু করা বেসিক ব্যাংক এক সময় দেশের সেরা ব্যাংকের তালিকায় ছিল। এমনকি এক সময় বৈশ্বিক জায়ান্ট স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের সঙ্গেও তুলনা করা হতো এই ব্যাংকটিকে। কিন্তু ২০০৯ সালে আবদুল হাই বাচ্চুর হাতে ব্যাংকটির দায়িত্ব যাওয়ার পরই পতনের শুরু হয়। ২০১০ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বেশি জালিয়াতির ঘটনায় ব্যাংকটি খাদের মধ্যে পড়ে। এরপর সরকার নানাভাবে ব্যাংকটির তহবিলের জোগান দিয়েও অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারেনি।
এ অবস্থায় গত আট বছরে বেসিক ব্যাংকের নিট লোকসান হয়েছে ৩ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০২০ সালে ৩৬৬ কোটি এবং ২০১৯ সালে ৩২৬ কোটি টাকা লোকসান করে ব্যাংকটি। এ খাদের মধ্যে পড়ায় বিভিন্ন সময়ে সরকার ব্যাংকটিকে রাজস্ব থেকে ৩ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা জোগান দিয়েছে। এরপরও ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা মূলধন ঘাটতির পাশাপাশি ৩ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা সঞ্চিতি ঘাটতিতে রয়েছে এক সময়ের সেরা ব্যাংকটি।
দেশজুড়ে ৭২টি শাখা ও ২ হাজার ১০০ কর্মী নিয়ে কার্যক্রম চালানো বেসিক ব্যাংকের ২০২০ সালের ডিসেম্বরে শেষে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১৪ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা। এর ৫১ শতাংশ বা ৭ হাজার ৫০২ কোটি টাকাই খেলাপি হয়ে গেছে।
অপরদিকে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক (বিএসবি) এবং বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা (বিএসআরএস) একীভূত করে গঠন করা হয় বিডিবিএল। পরের বছর ২০১০ সালের ৩ জানুয়ারি যাত্রা শুরু করা বিডিবিএল বর্তমানে ছয়টি আঞ্চলিক কার্যালয়, ৪৭টি শাখা ও ৭২৩ জন কর্মী নিয়ে কার্যক্রম চালাচ্ছে।
এ প্রতিষ্ঠানটির সার্বিক অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। ২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে প্রতিষ্ঠানটির বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা। এর ৩৩ দশমিক ৮৮ শতাংশ বা ৫৯৫ কোটি টাকা খেলাপি হয়ে গেছে। অবশ্য এ অবস্থাতেও বেসিক ব্যাংকের মতো এই প্রতিষ্ঠানটিকে লোকসানের ভার বহন করতে হচ্ছে না। গত বছরও ব্যাংকটি প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা মুনাফা করেছে।
এই দুটি প্রতিষ্ঠানের একীভূত করার উদ্যোগের বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘বিডিবিএল ও বেসিক ব্যাংক একীভূত করা হলে কিছুটা সুফল পাওয়া যেতে পারে। তবে একটি শক্তিশালী ব্যাংকের সঙ্গে একটি দুর্বল ব্যাংক একীভূত করলে তখন সুফলটা ভালো পাওয়া যায়। তারপরও আমি কিছুটা আশাবাদী। আমাদের দেশে তো মার্জার (একীভূত) বলে একেবারে কিছু নেই। আমি কেবল শিল্প ব্যাংক এবং বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা একীভূত করেছিলাম। তারপর আর কোনো মার্জার হয়নি। কাজেই এটি হলে মার্জারের একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন হবে।’
একীভূত করলে কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া উচিত, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘একীভূত ব্যাংক যেটা হবে, সেখানে প্রয়োজনে ম্যানেজমেন্টে পরিবর্তন আনার দরকার হতে পারে। সেখানে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। রাজনীতি বা অন্য কোনো বিবেচনায় যাতে ঋণ না দেয়া হয়, সে বিষয়ে দৃষ্টি রাখতে হবে। অর্থাৎ একটি প্রফেশনাল ম্যানেজমেন্ট চালু করতে হবে।’