বাড়ানো হলো হোটেল-রেস্তোরাঁর খাবারের দাম কিন্তু পরিমাণে কম
এবার বাড়ানো হলো হোটেল-রেস্তোরাঁর খাবারের দাম কিন্তু পরিমাণে কম। রামপুরা বনশ্রীর ‘এ’ ব্লকে ছোট্ট একটি খাবারের হোটেল। সকালের নাশতার জন্য এখানে পরোটা ও ডাল-সবজি বিক্রি করা হয়। হোটেলের সামনে একটি কাচের বক্সের ভেতরে কিছু শিঙাড়া ভেজে রাখা হয়েছে। এক নারী এসে হোটেলকর্মীকে বলেন তিনটি শিঙাড়া দিতে।
হোটেলকর্মী একটি কাগজের ঠোঙায় তিনটি শিঙাড়ার সঙ্গে মরিচ-পেঁয়াজ মুড়িয়ে দেন ওই নারীর হাতে। ওই নারী তাঁর হাতব্যাগ থেকে ১৫ টাকা বের করে হোটেলকর্মীর হাতে দেন। হোটেলকর্মী তখন বলেন, শিঙাড়ার দাম বেড়েছে, ৩০ টাকা দেন। ওই নারী অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ‘দাম বাড়ল কবে, সেই দিন না নিলাম পাঁচ টাকা করে?’
বলতে বলতেই হাতব্যাগে টাকা খুঁজতে থাকেন ওই নারী। অনেক হাতড়ে তিনি ব্যাগ থেকে ১০ টাকা পেলেন। সব মিলিয়ে তাঁর হলো ২৫ টাকা। কিন্তু শিঙাড়ার দাম ৩০ টাকা। আর কোনো উপায় না পেয়ে তিনি হোটেলকর্মীকে বললেন, ‘দুটি শিঙাড়া দেন। ’ পরে ২০ টাকা দিয়ে দুটি শিঙাড়া কিনে চলে যান তিনি।
এটি একটি খণ্ডচিত্র মাত্র। শুধু এই হোটেলেই নয়, রাজধানীর বেশির ভাগ এমন হোটেলে পরোটা, শিঙাড়া, ডাল-সবজি ও ভাজা ডিমের দাম বাড়ানো হয়েছে। ভোজ্য তেল, আটা-ময়দা ও সবজির দাম বেড়ে যাওয়ায় দাম বাড়ানো হয়েছে বলে যুক্তি দিচ্ছেন বিক্রেতারা।
গতকাল শনিবার রাজধানীর পল্টন, বাড্ডা ও ভাটারা এলাকার বিভিন্ন ছোট-বড় হোটেল-রেস্তোরাঁ ঘুরে দেখা যায়, নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার প্রভাব পড়েছে হোটেল-রেস্তোরাঁর খাবারে। পাঁচ টাকার পরোটা হয়েছে ১০ টাকা, নান রুটি ২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ২৫ টাকা, পাঁচ টাকার শিঙাড়া বিক্রি হচ্ছে ১০ টাকায়, ডাল-সবজির ১০ টাকার প্লেট ১৫ থেকে ২০ টাকা করা হয়েছে, ভাজা ডিম ১৫ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ২০ টাকা। সঙ্গে ভাত, মাছ ও সব ধরনের মাংসের দামও বেড়েছে। অনেকে আবার ক্রেতা ধরে রাখতে দাম না বাড়িয়ে পণ্যের পরিমাণ কমিয়ে বিক্রি করছেন। ফলে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে খেটে খাওয়া মানুষ ঘর কিংবা খাবারের হোটেল, কোথাও স্বস্তিতে নেই।
জীবিকার তাগিদে রিকশাচালকসহ অনেক শ্রমজীবী ও নিম্ন আয়ের মানুষকে রাস্তার পাশের হোটেলে খেতে হয়। গতকাল পল্টনের সেগুনবাগিচা হাই স্কুল গলিতে ফুটপাতের একটি হোটেলে দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন রিকশাচালক মো. ইব্রাহিম (৩৮)। খাওয়া শেষে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে এই এলাকার ফুটপাতের হোটেলগুলোতেই দুপুরের খাবার খাই। খাবারের দাম না বাড়িয়ে খাবারের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে হোটেলগুলো। আগে দুই প্লেট ভাত দিয়ে পেট ভরে খাওয়া যেত, এখন দুই প্লেট ভাতে পেট ভরে না। তিন প্লেট খেতে হয়। মাছের টুকরার আকারও ছোট করেছে। আলু ও মাছের ভর্তার পরিমাণ কমেছে।
ডাল হয়েছে আগের চেয়েও পাতলা। আগে পেট ভরে ৮০ টাকায় খাবার খাওয়া যেত। এখন ১০০ টাকার খাবার খেলেও পেট ভরে না। ’ তিনি বলেন, ‘শুধু দুপুরের খাবারের দাম বাড়েনি, সকালের নাশতার খরচও বেড়েছে। আগে দুটি পরোটা ও ডাল-সবজি খেতে লাগত ২৫ টাকা, এখন লাগে ৪০ টাকা। ’
জানতে চাইলে ফুটপাতের হোটেলটির মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘খাবারের পরিমাণ না কমিয়ে আমাদের কিছু করার নেই। আমরা তো লোকসানে ব্যবসা করতে পারব না। এখন যদি খাবারের দাম বাড়িয়ে বিক্রি করি, তাহলে খাবার খেতে আসবে না। কারণ আমাদের হোটেলে বড়লোকরা খেতে আসে না, খাবার খায় নিম্ন আয়ের মানুষ। ’
ভোজ্য তেল, চাল, ডাল, আটা-ময়দা ও মাছ-মাংসসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়ার প্রভাবটা পাল্টে দিয়েছে হোটেল-রেস্তোরাঁর সব রকম খাবারের দাম। বদলে যাচ্ছে মূল্যতালিকাও। পল্টন মোড়ে জিএফসি রেস্টুরেন্টে গতকাল দুপুরে গিয়ে দেখা গেছে, হোটেলের প্রতিটি চেয়ারে মানুষ।
জানতে চাইলে এই রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার আরাফাত হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ঈদের পর থেকে পুরো লোকসান দিয়ে হোটেল চালাতে হচ্ছে। যেভাবে মাছ-মাংসসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে, এখন দাম কিছু না বাড়ালে হোটেল চালানো সম্ভব নয়। তাই আগামী মাসের ১ তারিখ থেকে বেশির ভাগ খাবারের আইটেমের দাম বাড়ানো হবে। ’
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় দেশের বড় বড় হোটেল-রেস্তোরাঁয় ক্রেতা কমছে। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার সুলতান ডাইনের ম্যানেজার মোসাররাত হাসিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ভোজ্য তেল, মাংস, চাল ও মসলার দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে খাবার তৈরিতে খরচ প্রায় ১০ শতাংশের মতো বেড়ে গেছে। এর পরও আমরা এখনো দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিইনি। বাজারে সব কিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষ পরিবার নিয়ে রেস্টুেন্টে খাবার খেতে কম আসছে। ’
জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের সংগঠন থেকে দাম বাড়ানোর কোনো নির্দেশনা নেই। রেস্টুরেন্টের খাবার তৈরির খরচ বেড়ে যাওয়ায় মালিকরা দাম বাড়াচ্ছেন, অনেকে সামনের মাসে বাড়ানোর চিন্তা করছেন। লোকসান দিয়ে তো কেউ ব্যবসা চালাবেন না। তবে যুক্তিসংগতভাবে দাম বাড়তে হবে, বেশি বাড়ালে ক্রেতা হারাতে হবে। ’ তিনি বলেন, ‘বর্তমানে শুধু রাজধানীতে হোটেল-রেস্তোরাঁ আছে প্রায় ১৫ হাজার। তবে সরকারের হিসাবে, সারা দেশে ছোট-বড় হোটেল আছে প্রায় চার লাখ ৭৮ হাজার। ’