অভিমত

বাঙালির প্রতিটি আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

তাপস হালদার:
১লা জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস। ১৯২১ সালের আজকের দিনে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়টি। ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর বঙ্গভঙ্গে ঢাকাকে রাজধানী করে নতুন ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম’ প্রদেশ গঠিত হলে পূর্ব বঙ্গে দ্রুত শিক্ষার প্রসার ঘটতে থাকে তাতে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা অবধারিত হয়ে পড়ে। কিন্তু ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করা হলে শিক্ষায় আবার বিপর্যয় নেমে আসে। ১৯১২ সালের ২১শে জানুয়ারি ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ঢাকা সফরে এলে ঢাকার তৎকালীন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রয়োজনীয়তার দাবি তুলে ধরেন। সেই দাবির প্রেক্ষিতে মে মাসেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ব্যারিষ্টার নাথানের নেতৃত্বে “নাথান কমিশন” গঠন করা হয়। কমিটি ২৫টি সাব-কমিটি করে ১৯১৩ সালেই তাদের রিপোর্টে পেশ করে। রিপোর্টে অক্সফোর্ড এবং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে ঢাকায় একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সুপারিশ করা হয়। রমনা অঞ্চলের ৪৫০ একর সরকারী খাস জমির উপর নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়।

আরও পড়ুন: স্মৃতি বড় মধুর স্মৃতি বড় বেদনার

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে প্রতিষ্ঠার কাজে একটু ধীর গতি চলে আসে। অবশেষে ১৯২০ সালের ২২ শে ফেব্রুয়ারি ভারতীয় আইন সভায় “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিল” সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। ২৩ মার্চ “দি ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট” গভর্নর জেনারেলের অনুমোদন লাভ করে। এই আইনের ফলে ১৯২১ সালের ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুটা হয়েছিল একদল প্রতিভাবান ও নিজ গুণে গুণান্বিত জগৎবিখ্যাত শিক্ষকমন্ডলীর নেতৃত্বে। প্রথম উপাচার্য ছিলেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক রেজিস্ট্রার পি জে হার্টগ, সংস্কৃত ও বাংলায় ছিলেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এবং রাধাগোবিন্দ বসাক। ইতিহাস বিভাগে ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদার এবং স্যার এ এফ রহমান। পদার্থ বিজ্ঞানে সত্যেন্দ্রনাথ বসু আর রসায়নে জ্ঞানচন্দ্র। আইন বিভাগের প্রধান নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত। প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে ছিলেন জগৎ বিখ্যাত।

প্রথম শুরু হয়েছিল তিনটি ছাত্র হল নিয়ে। জগন্নাথ হল, মুসলিম হল (পরে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল), ঢাকা হল (পরে শহীদুল্লাহ হল)। হিন্দু ছাত্রদের জন্য জগন্নাথ হল, মুসলিম ছাত্রদের জন্য মুসলিম হল আর সকল ধর্মের ছাত্রদের জন্য ঢাকা হল। প্রতিষ্ঠালগ্নে রক্ষণশীলতার কারণে ছাত্রী ভর্তির ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দ্বিধান্বিত ছিল। কিন্তু কলকাতা বেথুন কলেজের গ্রাজুয়েট লীলা নাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ব্যাপারে ছিলেন নাছোড়বান্দা। তিনিই প্রথম ছাত্রী হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে এম.এ ভর্তি হন।

প্রথম মুসলিম ছাত্রী ছিলেন ফজিলাতুন্নেশা, গণিত বিভাগে ভর্তি হন ১৯২৩ সালে। ১৯২৬ সালের ২৮ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭ নং বাংলো চামেরি হাউজ এ (বর্তমান সিরডাপ ভবন) প্রথম তিন জন ছাত্রী নিয়ে ছাত্রী হোষ্টেল চালু হয়।

চল্লিশের দশকে প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের মধ্যে রাজনৈতিক জাগরণ শুরু হয়।১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোর প্রস্তাব উত্থাপনের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম ছাত্র সমাজের মধ্যে পাকিস্তান আন্দোলনে সাড়া জাগে। এই প্রথম ছাত্ররা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়ে। সেই থেকে শুরু, বাঙালির প্রতিটি গণতান্ত্রিক ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হওয়ার পরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বুঝে গিয়েছিলেন এই পাকিস্তান বাঙালির জন্য তৈরি হয়নি। বাঙালিদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বিকল্প রাজনৈতিক সংগঠনের দরকার। সে লক্ষ্য নিয়েই ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। ছাত্র সংগঠনের পরে একটি রাজনৈতিক সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে ১৯৪৮ সালের জানুয়ারিতে ১৫০ মোগলটুলীতে শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ নেতৃবৃন্দ এক কর্মী সম্মেলন করে সিদ্ধান্ত নেন মুসলিম লীগের বিপক্ষে একটি রাজনৈতিক সংগঠন গড়তে হবে। সেই ধারণা থেকেই আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম হয়। সেদিন যাঁরা নেতৃত্ব দেন তাদের অধিকাংশই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।

বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করার জন্য বঙ্গবন্ধুসহ ২৭ জন ছাত্রের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তপক্ষ। শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৫ টাকা জরিমানা করলে তিনি দিতে অস্বীকৃতি জানান। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার ও গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করে। পাকিস্তান আমলে এটাই বঙ্গবন্ধুর প্রথম কারাবরণ।

১৯৫২ সালের ২৬ শে জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকায় নিখিল পাকিস্তান মুসলিম লীগ অধিবেশনে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ গর্জে ওঠে। ২৯ জানুয়ারি ও ৪ ফেব্রুয়ারি সর্বাত্মক ধর্মঘট পালিত হয় এবং ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়। ২০ ফেব্রুয়ারি নুরুল আমিন সরকার ১৪৪ ধারা জারি করলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করলে শহীদদের রক্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রক্তাক্ত হয়। ভাষা আন্দোলনে যে ছাত্ররা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তারা প্রত্যেকে স্বাধীনতা যুদ্ধেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।

৬২ সালে অগণতান্ত্রিক ও ছাত্র স্বার্থবিরোধী শিক্ষা নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন, ৬৬’র ছয় দফা কর্মসূচি এবং পরবর্তীতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে ৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়ে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করা হয়। ১৯৬৯ সালে সকল ছাত্র সংগঠন মিলে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে ১১ দফা দাবি আইয়ুব খান সরকারের ভিত কেঁপে উঠেছিল। ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বটতলায় বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে। ৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। স্বাধীন বাংলাদেশেও যখন গণতন্ত্র ভূলুন্ঠিত হয়েছে তখনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রুখে দাঁড়িয়েছে। ৯০-এ স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, ২০০২ সালে শামসুন্নাহার হলে পুলিশি নির্যাতনে ভিসি বিরোধী আন্দোলন, ২০০৬ সালে বিএনপি জামায়াতের অপশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ১/১১ সরকারের সময়ে ছাত্রদের নির্যাতন ও শিক্ষকদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে আন্দোলনসহ সকল ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জাতির নেতৃত্ব দিয়েছে।

গত ১০ দশকে এই বিদ্যাপীঠ তৈরি করেছে অনেক মনীষী, জ্ঞানী গুণীজন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, মানবতার জননী রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনাসহ একাধিক রাষ্টপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, সাংসদ, বিজ্ঞানী, বরেণ্য ব্যক্তিবর্গসহ লক্ষ লক্ষ গ্র্যাজুয়েট।

বাঙালির প্রতিটা অর্জনের পেছনে অনন্য ভূমিকা রেখেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।পৃথিবীর আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের এই গৌরব নেই। শুধুমাত্র শিক্ষার রাঙ্কিং দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল্যায়ন করলে হবে না, বাঙালি জাতির জীবনে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা অপরিসীম। জাতির প্রয়োজনে প্রতিটি সময়ই গর্জে উঠেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারসহ প্রতিটি ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষক সমাজ অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। জাতির বাতিঘর হয়ে যুগ যুগ ধরে আলো বিলিয়ে যাচ্ছে। ইতিহাসের এক মাহেন্দ্রক্ষণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। শততম বর্ষে পদার্পণ করলো। শুভ জন্মদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

লেখক: সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা

ইমেইল: haldertapas80@gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *