কৃষি-মৎস্য

বাংলার ইলিশের বিশ্বজয়

দেবযানী দত্ত :

বাঙ্গালীকে মাছে-ভাতে বাঙ্গালী বলা হয়। আর সেখানে যদি হয় ইলিশ তাহলে তো কোনো কথাই নেই। বাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সাথে মিশে আছে বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ। বর্তমানে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রপ্তানি আয় ও আমিষ সরবরাহে ইলিশের গুরুত্ব অপরিসীম। দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনে ইলিশের অবদান সর্বোচ্চ (শতকরা প্রায় ১১ ভাগ)। পৃথিবীতে ইলিশ আহরণকারী ১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে। সারা বিশ্বের মোট উৎপাদিত ইলিশের প্রায় ৪০ শতাংশ পাওয়া যায় এ দেশ থেকে।
উৎপাদন বৃদ্ধির মাত্রাঃ
দেশে গত ১০ বছরে ইলিশের উৎপাদন প্রায় ৭৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে জাতীয় মাছ ইলিশের উৎপাদন ছিল ২ লাখ ৯৮ হাজার টন। সর্বশেষ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদন হয়েছে ৫ লাখ ৩৩ হাজার টন। এ সময়ে উৎপাদন বেড়েছে ২ লাখ ৩৫ হাজার টন। একইসঙ্গে ১০ বছরে ইলিশ উৎপাদনের গড় প্রবৃদ্ধি প্রায় ৬ দশমিক ২০ শতাংশ।
ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন রোল মডেল। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি তথ্য মতে, ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে ১ নাম্বারে অবস্থান করছে। মৎস্যবিষয়ক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ওয়ার্ল্ডফিশের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের মোট ইলিশের ৮৬ শতাংশ বাংলাদেশে উৎপাদিত হচ্ছে। যেখানে কয়েক বছর আগেও বাংলাদেশে ইলিশ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৬৫ শতাংশ। ইলিশের উৎপাদন বাড়ার পেছনে ২২ দিনের যে ইলিশ ধরার নিষেধাজ্ঞাটি দেয়া হয় সেটি সবচেয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ।
মেঘনার ইলিশের সুখ্যাতিঃ
ইলিশ বললেই প্রথমেই সকলের মনে আসে পদ্মার ইলিশের কথা। একদল গবেষক তাদের গবেষণায় দেখেছেন যে, দেশের ইলিশের বেশির ভাগই আসে মেঘনা থেকে। স্বাদে ও পুষ্টিতে এই মোহনার মাছ শুধু দেশের মধ্যেই নয়, বিশ্বসেরা। বাংলাদেশে ইলিশের উৎপাদনের মাত্র ২ শতাংশ আসে পদ্মা থেকে। কিন্তু সেগুলো হয় আকৃতিতে ছোট এবং স্বাদও তেমন পাওয়া যায় না মেঘনার মাছের মতো।
চাঁদপুরের বিখ্যাত ইলিশঃ

ইলিশ তো বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলেই পাওয়া যায়, তাহলে চাঁদপুরকেই কেন ইলিশের বাড়ি বলা হয়। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদনের হিসাবে বরিশাল বিভাগের ভোলা জেলা ছিল সবার শীর্ষে। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে বরগুনা এবং তাদের আহরিত ছোট ইলিশের পরিমাণ ছিল ১ লাখ মেট্রিক টন।
অন্যদিকে একই অর্থবছরে চাঁদপুরে ইলিশ ধরা পড়ে প্রায় ৩৪ হাজার মেট্রিক টন, আর তখন চাঁদপুরের অবস্থান ছিল ষষ্ঠ স্থানে। তাহলে কেন চাঁদপুরই ইলিশের জন্য বিখ্যাত।
আমরা যদি জীববৈচিত্র্যের আঙ্গিকে চিন্তা করি তাহলে বিষয়টি খুবই সহজ। ইলিশের বিচরণ লোনা পানিতে কিন্তু ডিম পাড়ার সময় তারা মিঠা পানির মোহনায় আসে। চাঁদপুরের পদ্মা ও মেঘনার মোহনায় প্রচুর পরমাণে প্ল্যাঙ্কটন আছে যা মা ইলিশের প্রধান খাদ্য। আর এই প্ল্যাঙ্কটন চাঁদপুরের মোহনা ছাড়া অন্য কোনো জেলায় পাওয়া যায় না। এজন্য ডিম পাড়ার সময় মা ইলিশ চলে আসে চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনার মোহনায়, যাতে তারা এ সময় পর্যাপ্ত খাদ্য পেয়ে থাকে। এতে ইলিশের শরীরে প্রচুর ফ্যাটি এসিড ও ওমেগা থ্রি তৈরি হয়। যা ইলিশের স্বাদ দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেয়।
মা ইলিশের ডিম ছাড়ার সময় ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ থাকায় চাঁদপুরে ইলিশ আহরণ কম হয়। আর যখন ডিম ছাড়ার মৌসুম শেষ হয় ততদিনে ইলিশ উপকূলীয় অঞ্চলে চলে যায়। তাই চাঁদপুরে ইলিশ কম ধরা পড়ে অন্যান্য জেলার তুলনায়। চাঁদপুরে ইলিশ আহরণ তুলনামূলক কম হলেও ইলিশের সবচেয়ে বড় বাজার এই জেলাতেই। এখান থেকেই সারা দেশে মাছ সরবারহ করা হয়।
চাঁদপুরের তৎকালীন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুস সবুর মণ্ডল ২০১৫ সালে উদ্যোগ নিয়ে ইলিশ ব্র্যান্ডিং কার্যক্রম শুরু করেন। চাঁদপুর জেলাকে “ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর” নামে ব্র্যান্ডিং করেন তিনি এবং ২০১৭ সালে সরকারের পক্ষ থেকেও পরে এই দাবিকে স্বীকৃতি দেয়া হয়।
জিআই পণ্য ইলিশ:
২০১৭ সালে বাংলাদেশের ইলিশ মাছ ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এর ফলে ইলিশ বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্য হিসেবে সারা বিশ্বে স্বীকৃতি পেল।
টাটকা ইলিশ চেনার উপায়ঃ
মাছের শরীর চকচকে দেখাবে।
মাছের শরীরে পিচ্ছিলভাব থাকবে।
ইলিশ মাছ লোনা পানি থেকে ধরা হলে মাছে লবণাক্ত গন্ধ থাকবে আর মিঠা পানির হলে পানির মতো গন্ধ থাকবে।
তাজা ইলিশের চোখ উজ্জ্বল দেখাবে।
ফুলকায় পিচ্ছিলভাব, লালচে ও তাজা দেখাবে।
মাছের গায়ে চাপ দিলে স্পঞ্জ করে আবার স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্পঃ
ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধিতে সরকার আড়াইশ’ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য হল মা ইলিশ ও জাটকা সংরক্ষণে আইন বাস্তবায়ন এবং ইলিশ জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধিকরণ। এ প্রকল্পের বাস্তবায়নকাল জুলাই, ২০২০ থেকে জুন, ২০২৪ পর্যন্ত। এই প্রকল্পটি ২৯টি জেলার ১৩৪টি উপজেলায় বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
ইলিশ সংরক্ষণ ব্যবস্থাঃ
দেশীয় গবেষণার ভিত্তিতে ২২ দিনের পরিবর্তে অন্তত ৪০-৪৫ দিনের স্থায়ী ইলিশ নিধন নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন করা। নিষেধাজ্ঞার সময় জেলেদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা যাতে তারা ইলিশ ধরা থেকে বিরত থাকে। সস্তায় মাছ ও পরিবেশবান্ধব জাল ও সমুদ্রে মাছ ধরার উপযোগী ইঞ্জিনচালিত নৌকা ভাড়া ও তা ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দেয়া। এছাড়া ডিমওয়ালা মাছ নিধন ও বিক্রয়, নির্দিষ্ট আকারের চেয়ে ছোট মাছ বিক্রয় এবং মাছের ডিম খাওয়াকে অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করে তা আইনত দণ্ডণীয় করা উচিৎ বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *