তাপস হালদার :

বাংলাদেশ-ভারত দক্ষিণ এশিয়ায় অবস্থিত পাশাপাশি দুটি রাষ্ট্রই শুধু নয়, একে অপরের পরীক্ষিত বন্ধুও বটে। বাংলাদেশ-ভারত দুটি দেশে রয়েছে ৪,১৫৬ কিলোমিটার জুড়ে বিশাল সীমান্ত। দুই দেশের ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যে রয়েছে ব্যাপক মিল। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দু’টি দেশেরই জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম ও লালন শাহ উভয় দেশেরই সম্পদ।

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বন্ধুর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় ভারত। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অত্যাচারের হাত থেকে প্রাণ বাঁচতে এদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ ভারত সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করলে, সে সময় মানবতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয়, তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা, মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিংসহ যাবতীয় সহযোগিতা করেছিল ভারত সরকার ও তাদের জনগণ।

৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, বাংলাদেশ ও ভারত বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে দিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল সময়ে এই দিন ভারত বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দান করে। তারপর বাংলাদেশ ভারতের যৌথবাহিনীর আক্রমনে মাত্র দশ দিন পর তেরানব্বই হাজার সৈন্য নিয়ে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। জন্ম হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের।

এবছর বাংলাদেশ-ভারত কূটনৈতিক সম্পর্কেরও ৫০ বছর পূর্ণ হয়েছে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতের জনগণ, সরকার ও সামরিক বাহিনীর অবদান বাংলাদেশের জনগণ চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে এবং করবে। গত মার্চ মাসে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বাংলাদেশ সফরকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদী ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা যৌথভাবে ৬ ডিসেম্বর ‘মৈত্রী দিবস’  পালনের সিদ্ধান্ত নেন। সে অনুযায়ী এবছরই প্রথমবারের মতো পালিত হচ্ছে বাংলাদেশ-ভারত  ‘মৈত্রী দিবস’। বিশ্বের  আরো ১৮টি দেশে বাংলাদেশ-ভারত যৌথভাবে ‘মৈত্রী দিবস’ পালন করবে। দেশগুলো হচ্ছে- যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, কানাডা, রাশিয়া, ফ্রান্স, মিশর, ইন্দোনেশিয়া, বেলজিয়াম, কাতার, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, থাইল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত।

বাংলাদেশ একটি মাহেন্দ্রক্ষণ পার করছে। একদিকে  জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী, অন্যদিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। আবার বাংলাদেশ-ভারত কূটনৈতিক সম্পর্কেরও সুবর্ণজয়ন্তী। স্বাধীনতা দিবসের অতিথি হয়ে এসেছিলেন বন্ধুপ্রতীম ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদী এবং বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে আসছেন ভারতের রাষ্ট্রপতি শ্রী রামনাথ কোবিন্দ। শোনা যাচ্ছে ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হচ্ছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই সফরগুলো থেকেই বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের গভীরতা অনুমান করা যায়।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে দুটি দেশের জনগণের মধ্যে যে বন্ধুত্বের বন্ধন তৈরি হয়েছে সেটিকে কখনও আলাদা করা যাবে না। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করার পরপরই ১৯৭২ সালে ২৫ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চুক্তি ও ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা সীমান্ত চুক্তির মধ্য দিয়ে শুরু হয় বন্ধুত্বের পথচলা।

১৯৭৫ সালে জাতির পিতার নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর সামরিক শাসক ও বিএনপি রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসে পাকিস্তানি ভাবাদর্শে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গিয়ে ভারতের সঙ্গে একটি বৈরী সম্পর্ক তৈরি করে। এদেশের একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক জনগণের মধ্যে ধর্মের জুজু দেখিয়ে ভারত বিরোধিতার বীজ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। ধর্মের নামে মৌলবাদ তৈরি করে দেশকে একটি জঙ্গি, সন্ত্রাসবাদী ও মৌলবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করে। ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বিছিন্নতাবাদী উগ্রপন্থিদের বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সুযোগ করে দেওয়া হয়। সে সময়গুলোতে দুটি দেশের সম্পর্ক একদম তলানিতে এসে পৌঁছেছিল।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর সম্পর্ক আবার ভালো হতে শুরু করে। ঐতিহাসিক গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। দীর্ঘ ২১ বছর পর পানির ন্যায্য হিস্যা পায় বাংলাদেশ। আবার বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় ২০০২ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত সম্পর্ক শীতল হয়। পরবর্তীতে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ পুনরায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পর সম্পর্কের  উষ্ণতা বাড়তে  শুরু করে। বিশেষ করে ২০১৪ সালে ভারতে শ্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক নতুন মাত্রা তৈরি হয়। দু-দেশের দীর্ঘদিনের ছিটমহল সমস্যার সমাধান, সমুদ্র সীমা বিরোধ নিষ্পত্তিসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ অমীমাংসিত সমস্যার সমাধান  হয়।

বৈশ্বিক করোনা মহামারিতে সারা বিশ্বই যখন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল তখন করোনা সামগ্রী দিয়ে প্রথমেই বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল ভারত। ১৯৭১ সালের পর ভারতের পক্ষ থেকে সবচেয়ে বড় উপহার হলো করোনা ভ্যাকসিন ও তরল অক্সিজেন সরবরাহ।

অতীতে অনেক সময়ই বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে অনেক টানাপোড়েন হয়েছে। এক শ্রেণীর মৌলবাদী, যারা ধর্মের নামে রাজনীতি করতে চায়, তারা সম্পর্ককে নানাভাবে বিনষ্ট করার চেষ্টা করেছে। আর বিএনপি-জামায়াত ভারত জুজুকে হাতিয়ার করে ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে।

মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তিরা দু-দেশের সম্পর্ক নষ্ট করার বারবার চেষ্টা করলেও এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী অসাম্প্রদায়িক বলে তাদের সেই অপচেষ্টা সফল হয়নি।

বাংলাদেশ ভারত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মূল ভিত্তি হলো পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস। মহান মুক্তিযুদ্ধের মতো একটি যুগান্তকারী ঘটনার মধ্য দিয়ে ভারতের জনগণ ও সরকারের সঙ্গে এ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। ১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতার ব্রিগেড সমাবেশে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারপ্রধান হিসেবে প্রথম বিদেশ সফরে গিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চিরদিন অটুট থাকবে। বিশ্বের কোনো শক্তি পারবে না, এই বন্ধুত্বে ফাটল ধরাতে।’

দুটি দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক মুক্তিযুদ্ধের রক্তের বন্ধনে আবদ্ধ। এ বন্ধুত্বে দেনা-পাওনা, চাওয়া-পাওয়ার হিসেব নেই। এ বন্ধুত্ব চিরন্তন, এ বন্ধুত্ব শাশ্বত। বন্ধুত্বের ৫০ বছরে এ বন্ধন দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়েছে।

লেখক: সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা।

ইমেইল: haldertapas80@ gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *