ডাঃ মোঃ সোহরাব হোসেন ::
কোভিড-১৯, করোনা ভাইরাস দ্বারা সংঘটিত একটি মারাত্মক সংক্রামক রোগ। যার সংক্রমণ হার অত্যন্ত বেশি কিন্তু মৃত্যু হার কম। করোনা একটি দুর্দান্ত শক্তিশালী ভাইরাস যা একই সাথে মানবদেহের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অংগ (vital systs)কে আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে । তবে নিউমোনিয়া, এজমা, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস ও কিডনি রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিবর্গের জন্য এটা বেশি বিপজ্জনক। করোনা ভাইরাস রোগী হতে মুখ, নাক এবং চোখ দিয়ে সুস্থ মানবদেহে সংক্রমিত হয় এবং একই সাথে আক্রান্ত রোগী Respiratory, Cardiac, Renal, Gastro-intestinal system কে দ্রুত আক্রমণ এবং ক্ষতিগ্রস্ত করে। তবে অধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় নিউমোনিয়া, এজমা, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস ও কিডনি রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিবর্গ । যাদের সংখ্যা মাত্র ৫%-১০%। বাকি ৯০%-৯৫% মানুষের শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি হওয়ায় তাদের খুব একটা ক্ষতি করতে পারে না এবং সামান্য চিকিৎসা ও মানবদেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিকারী পথ্যাপথ্য খেলেই ভাল হয়ে যায়। করোনা একটি বৈশ্বিক সমস্যা। অদ্যাবধি (২৭/৬/২০২০) পৃথিবীর প্রায় ২১৫টি দেশে তা বিস্তার লাভ করেছে এবং সারা বিশ্বে ৯৯,২০,০৮৮ জন মানুষ আক্রান্ত এবং ৪,৯৭,২৬১ (৫.৩৫%) জন মৃত্যুবরণ করেছেন (WHO)। বাংলাদেশে অদ্যাবধি ১,৩৩,৯৭৮ জন মানুষ আক্রান্ত এবং ১,৬৯৫ (১.৩%) জন মৃত্যুবরণ করেছেন (স্বাস্থ্য অধিদপ্তর)।
করোনা সংক্রমণ সংখ্যা প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ বৃদ্ধি শেষ কোথায় তা সকলের অজানা ।
করোনাতে সংক্রমণ এবং মৃত্যুর মিছিল যেভাবে দীর্ঘ হচ্ছে তাতে বাংলাদেশ খুব দ্রুত পৃথিবীর অন্যান্য অধিক সংক্রমণশীল দেশের কাতারে চলে আসছে। বিজ্ঞানসম্মত কারণেই হয়তো ঐ সকল দেশে করোনায় মৃত্যু হার অনেক বেশি। তবে করোনা মহাযুদ্ধে টিকে থাকার জন্য তাদের মত যদি আমাদের সমরাস্ত্র থাকতো তাহলে এ দেশে করোনা রোগীর মৃত্যুসংখ্যা হয়তো এত নাও হতে পারতো। প্রশ্ন হলো- কোনো উপায়ই কি নেই করোনার এ ধ্বংসলীলা বন্ধ করার?
কয়েকদিন পূর্বে প্রথিতযশা বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ প্রফেসর রাশিদুল হাসান (চেয়ারম্যান, ইনজিনিয়াস হেলথ কেয়ার লিমিটেড) সাহেবের একটি উপস্থাপনা দেখে শত কষ্টের মধ্যেও একটু আশার আলো যেনো দেখলাম। তিনি যে পদক্ষেপগুলোর কথা বললেন, কী করে বাংলাদেশে করোনার মৃত্যু হার শূন্যতে নামানো যায় এবং কী করে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে করোনা সংক্রমণচক্র ভেংগে এর বিস্তার রোধ করা যায় । আর তা হল তিনি Rapid test kit ব্যবহার করতঃ দ্রুত করোনা রোগী শনাক্ত করে তার চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন। এ কৌশল প্রয়োগ করে অনেক রোগীকে তিনি ভালও করেছেন।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেমন দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন, ইতালি, তুরস্ক, ইরান ইত্যাদি Rapid Test Kit ব্যবহার করে দ্রুত করোনা পরীক্ষা করছে । যে সকল দেশ করোনাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছে, তাদের মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়া, হংকং, সিংগাপুর, তাইওয়ান, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া প্রভৃতি দেশ করোনা রোগী দ্রুত পরীক্ষা এবং পৃথক থাকা নীতি অবলম্বন করেই সফল হয়েছে। এটি সত্য যে বিভিন্ন প্যারামিটার-এ করোনা নিরূপণ, প্রতিরোধ ও চিকিৎসা বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের সক্ষমতা পূর্বাপেক্ষা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে । RTPCR পরীক্ষা একটি উত্তম ব্যবস্থা তাতেও কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই । কিন্তু যে হারে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, তাতে RTPCR এর মত একটি ল্যাবরেটরি ভিত্তিক পরীক্ষা ব্যবস্থা দেশের সর্বত্র আক্রান্ত সকল করোনা রোগীর জন্য উন্মুক্ত করা কোনো ক্রমেই সম্ভব নয় । অন্য দিকে ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করতে গিয়ে জনবহুল পরিবেশে সুস্থ ব্যক্তি অসুস্থ ব্যক্তির সংস্পর্শে এসে আক্রান্ত হচ্ছে। আক্রান্ত ব্যক্তি বিলম্বে রিপোর্ট পাওয়ার কারণে চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণে বিলম্ব হয় এবং সে শারীরিক ও মানসিক দিক হতে দুর্বল হয়ে পড়ে । বিড়ম্বনার ভয়ে পরীক্ষা না করে আক্রান্ত ব্যক্তি অন্যদের মাঝে রোগ ছড়াচ্ছে ।
প্রফেসর রাশিদুল হাসান সাহেব আক্রান্ত ব্যক্তির শারীরিক অবস্থা অনুযায়ী অনেকটা দেশীয় ঔষধ দিয়ে চিকিৎসা করেই রোগী ভাল করছেন ।
গাজীপুর মহানগরীর টঙ্গীতে ডাঃ নাজিম উদ্দিন আহমেদ সাহেব স্বল্প পরিসরে একটি করোনা হাসপাতাল স্থাপন পূর্বক, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মহোদয় – চীন হতে যে Rapid test kit এনেছেন তা ব্যবহার করে ১৫/০৬/২০২০ তারিখ পর্যন্ত ২,৪৯০ জন সন্দেহভাজন রোগীকে পরীক্ষা করতঃ ২৮০ জন রোগী শনাক্ত করেছেন। তার মধ্যে ৩ জন মারা গেছেন ।
করোনা রোগীর সংখ্যা এবং মৃত্যু হার যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে মনে হয় এটি মোকাবিলায় পরীক্ষা ও চিকিৎসা ব্যবস্থার চলমান কৌশলে পরিবর্তন আনা বিশেষ প্রয়োজন। আমি এ দেশের একজন ক্ষুদ্র অথচ সচেতন নাগরিক হিসাবে সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, করোনা নিয়ন্ত্রণ জাতীয় ও টেকনিক্যাল কমিটি, সর্বোপরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মহোদয়ের সদয় সমীপে কিছু প্রস্তাব করছি। যা অনেকাংশে সরকারিভাবেও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। কিন্তু করোনার বিস্তার রোধ ও মৃত্যুর হার হ্রাস না পাওয়ায় ইহার আশংকাজনক অবস্থা দিনের পর দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই অবস্থার প্রেক্ষাপটে আমার প্রস্তাবগুলো গ্রহণযোগ্য বলে সুবিবেচিত হলে তা বাস্তবায়নে সবিনয় আনুরোধ করছি ।
ক) কাঙ্খিত সময়ের মধ্যে করোনা সংক্রমণ রোধ এবং মৃত্যুর হার শূন্যতে নামানো :
করোনা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে একটি Time Bound Road Map প্রস্তুত করা এবং তা বাস্তবায়ন করার জন্য প্রখ্যাত ভাইরোলোজিস্ট, বক্ষব্যাধী, মেডিসিন ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে Corona Control Action Sub-Committee করা। যারা প্রয়োজনীয় SOP প্রস্তুত করে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বাস্তবায়ন পূর্বক Road map অনুযায়ী কাঙ্খিত সময়ের মধ্যে করোনার সংক্রমণ রোধ ও মৃত্যুর হার শূন্যতে নামানোর পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন ।
খ) দ্রুত করোনা রোগী শনাক্তকরণে Rapid Test Kit ব্যবহার করা :
RTPCR মেশিনে করোনা রোগী শনাক্তের পাশাপাশি করোনা Rapid Test Kit ব্যবহার করে দ্রুত রোগ শনাক্ত পূর্বক প্রয়োজনীয় চিকিৎসা প্রদান ও রোগী পৃথক করতঃ এক ব্যক্তি হতে অন্য ব্যক্তিতে এর বিস্তার রোধ করা। এ ক্ষেত্রে দেশীয়ভাবে যদি টেস্ট কিট সংগ্রহ করা সম্ভব না হয় তবে বিদেশ হতে দ্রুত তা আমদানি করে সকল রোগীর পরীক্ষার জন্য উন্মুক্ত করা। এতে সন্দেহভাজন রোগী সহজে রোগ শনাক্ত করে নিজ হতেই পৃথক থাকতে পারবে এবং অন্যকে রোগ ছড়াবে না। RTPCR এর উপর চাপ কমবে । করোনা বিস্তার হ্রাস পাবে এ রোগ সংক্রমণের প্রাথমিক অবস্থায় রোগীর শারীরিক অবস্থা অপেক্ষাকৃত ভালো থাকে। সুতরাং প্রাথমিক অবস্থায় যথাযথ চিকিৎসা প্রদান করা হলে যে কোনো রোগীর আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। ফলে মৃত্যুর হারও কমবে ।
করোনায় টেস্ট কিট ব্যবহার করার আরেকটা সুবিধা, এ প্রক্রিয়ায় রোগীর দেহে করোনা এন্টিবডি উপস্থিতি নিরূপণ করা হয়। সুতরাং উক্ত রোগী আরোগ্যের পর তালিকাভুক্ত করে তাদের রক্ত সংগ্রহ পূর্বক Plasma Therapy প্রস্তুত করা সহজ হবে। মানুষ যদি ফার্মেসী হতে করোনা টেস্ট কিট ক্রয় করে নিজ ঘরে বসে, ফার্মেসীতে বা নিকটবর্তী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে করোনা পরীক্ষা করতে পারে তাহলে আক্রান্ত হলেও নিজ হতেই পৃথক থেকে চিকিৎসা গ্রহণ করতে পারবে। আর রোগাবস্থা বেশি খারাপ হলে দ্রুত referral হাসপাতালে গিয়ে যথাযথ চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হতে পারবে।
গ) দেশব্যাপী জটিল রোগী দ্রুত চিকিৎসা প্রদানে জেলা সদর হাসপাতালগুলোকে করোনা Referral হাসপাতালে উন্নীত করা :
বড় শহর ছাড়াও বিশেষ করে জেলাসদর ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে Oxygen ও Ventilation সুযোগসমৃদ্ধ করে করোনা referral হাসপাতালে উন্নীত পূর্বক দেশের সর্বত্র জটিল করোনা রোগীর দ্রুত সুচিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
ঘ) দেশের সকল এলাকা হতে করোনা রোগী খুঁজে বের করতে পর্যাপ্ত ভলান্টিয়ার নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ প্রদান :
হাসপাতাল ছাড়াও (প্রকাশ্য বা গোপনে) দেশের সকল প্রান্তে নিজ নিজ বাড়িতে অবস্থানরত সকল রোগীকে Tracing & Tracking পদ্ধতিতে সরকারি পরিসংখ্যানের আওতাভুক্ত করে সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা। যাতে বিনা চিকিৎসা বা অপচিকিৎসায় কোনো রোগী মারা না যায় এবং পরিবার, সমাজ বা জনগোষ্ঠীতে কোনো রোগীই রোগ ছড়াতে না পারে এর জন্য প্রয়োজনীয় সরকারি কর্মীদের পাশাপাশি দেশব্যাপি সকল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদেরকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে ভলান্টিয়ার হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা। যারা শহর, বন্দর, গ্রাম সর্বত্র বিচরণ করে করোনা রোগীর তথ্য সংগ্রহ, তাদের চিকিৎসা ও আরোগ্যলাভে সহায়তা প্রদান করবে এবং জনসাধারণকে মাস্ক ধারণ ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং সাবান-পানি দিয়ে হাত ধুতে অভ্যস্থ করাবে।
ঙ) স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে করোনা নিরূপক যন্ত্র সরবরাহ :
করোনা রোগীর শরীরে রোগ তীব্রতা নিরূপণের জন্য Oxygen Concentration নিরূপক যন্ত্র বা অক্সিমিটারসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি উপজেলা হাসপাতাল, কমিউনিটি ক্লিনিক এবং বিশেষ করে সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ওয়ার্ড লেভেলে স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্রগুলোতে সরবরাহ করা । যাতে সন্দেহভাজন যে কোনো রোগীর জন্য প্রাথমিক পরীক্ষা করে সঠিক চিকিৎসা গ্রহণে হাসপাতালে গমন সহজতর হয়। এভাবে এক সময় করোনা মৃত্যু হার এবং ব্যক্তি হতে ব্যক্তিতে করোনা বিস্তার নিয়ন্ত্রণে আসবে।
চ) বিভিন্ন পেশা ও শ্রেণীর মানুষের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার কারণসমূহ অনুসন্ধান করতঃ বিদ্যমান অব্যবস্থা দূর করা :
করোনাতে সাধারণ মানুষ ছাড়াও চিকিৎসক, নার্স, পুলিশ, সাংবাদিক প্রভৃতি পেশাজীবীগণ আক্রান্ত হচ্ছেন। যা করোনা যুদ্ধে সংগ্রাম করার অন্তরায়। তাদের এভাবে আক্রান্ত হওয়ার পিছনে নিশ্চয়ই যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ রয়েছে। সুতরাং তা অনুসন্ধান করে বিহিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক।
সাধারণ মানুষ বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী স্বাস্থ্যবিধি না মেনে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার কারণ যেমন অজ্ঞতা, অভাব, অভ্যাস ও মানসম্পন্ন সুরক্ষা সামগ্রীর অপ্রতুলতা। এ সকল কারণ অনুসন্ধান করে তাদের অজ্ঞতা দূর করতে সচেতন করা, অভাবী ও এ রোগে আক্রান্ত মানুষের জন্য রাষ্ট্রীয়, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ও সামাজিকভাবে তাদের খাদ্য ও আর্থিক সহযোগিতা প্রদান। স্বাস্থ্যবিধি ভাঙতে অভ্যস্থ বাক্তিদের জন্য কঠোর আইন প্রয়োগ করতঃ তা মানতে বাধ্য করা।
বর্তমান বিশ্বে করোনা নিয়ন্ত্রণে দক্ষিণ কোরিয়া সবচেয়ে বেশি সফল দেশ। সেদেশে অর্জিত সফলতার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস নিম্নরূপ :
দক্ষিণ কোরিয়াতে করোনা সংক্রমণ প্রথম নিরূপিত হয় ২০ জানুয়ারি, ২০২০। ২৭ জানুয়ারি কোরিয়া ডিজিস কন্ট্রোল ও প্রিভেনশন সেন্টার (KCDC) কর্তৃক সে দেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, ওষুধ কোম্পানির নির্বাহী অফিসারগণ এবং অন্যান্য সরকারি বেসরকারি পর্যায়ের বিশেষজ্ঞবৃন্দকে একত্রিত করে করোনা মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ও Road Map প্রস্তুতে সহযোগিতা কামনা করা হয়। ফলে তারা করোনা যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার প্রয়োজনীয় সামগ্রী যেমন সকলের জন্য ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী, টেস্ট কিট, দ্রুত রোগ নিরূপণের অন্যান্য দ্রব্য এবং প্রয়োজনীয় ঔষধ অন্যান্য চিকিৎসা সামগ্রী প্রস্তুত করা শুরু করে । টেস্ট কিট প্রস্তুতে প্রায় ৩০টি কোম্পানিকে সরকারি লাইসেন্স প্রদান করা হয় যারা নিজ দেশের চাহিদা পূরণ করে ১২০টি দেশে তা রপ্তানি করছে। করোনা সংক্রমণ তীব্রতা বৃদ্ধির সাথে সাথে সকল নাগরিক মাস্ক ব্যবহার এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার উপর অতিশয় প্রাধান্য দিতে শুরু করে । টেস্ট কিট দিয়ে রোগ নিরূপণ করাকে বেশি অগ্রাধিকার দেয়া হয় । করোনা শনাক্তকরণে সন্দেহভাজন জনসাধারণকে এক জায়গায় একত্রিত না করে Drive Through ও Walk Through পদ্ধতিতে রাস্তা-ঘাট, দোকানপাট, বসতবাড়ি, অফিস-আদালত সর্বত্র মানুষের করোনা পরীক্ষা করে রোগ নিরূপণ করা হয়। এর ফলে সর্বোচ্চ ১০ মিনিটেই প্রতিটি রোগীর রোগ শনাক্তকরণ সম্ভব হয় । এভাবে প্রায় তিন সপ্তাহে ২,৭০,০০০ জনের করোনা পরীক্ষা করে ১০,৭২৮ জন রোগী শনাক্ত করা হয় এবং আক্রান্ত রোগীদেরকে পৃথক করে রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় । রোগীদেহে রোগ তীব্রতা নিরূপণে Chest-X-Ray AI Image Support Decision Tool এর সাহায্যে কয়েক সেকেন্ডেই ফুসফুসের সংক্রমণ অবস্থা নিরূপণ করা হয় এবং আক্রান্ত রোগীদেরকে মৃদু সংক্রমণ, মধ্যম অবস্থা, তীব্র ও অতি তীব্র আক্রান্ত প্রভৃতি শ্রেণিতে বিভক্ত পূর্বক তাদের অবস্থা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় চিকিৎসা প্রদান করে ৮,৭১৭ (৮১%) জনকে রোগমুক্ত করা হয় এবং ২৪২(২.৩%) কোভিড-১৯ রোগী মারা যায় । যখন (২৬,এপ্রিল ২০২০) যুক্তরাষ্ট্রে অন্তত ৫০,০০০ এবং স্পেন, ইতালি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্যে ২০,০০০ এর অধিক মানুষ কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বরণ করে (Worldometer 2020) । এভাবে সে দেশে সার্বিক জীবনযাত্রা সচল রেখে কোনো প্রকার লকডাউন না দিয়ে জনগণ সঠিক নিয়মানুবর্তিতা চর্চা করেই প্রায় তিন সপ্তাহের মধ্যে পাঁচ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত দক্ষিণ কোরিয়া করোনাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয় ।
করোনা নিয়ন্ত্রণ একটি ভয়ংকর যুদ্ধ যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাথে তুলনীয়। বঙ্গবন্ধুর অমরবাণী – “তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে” এ আহ্বানে উদ্বুদ্ধ হয়ে সমগ্র জাতি স্বাধীনতার জন্য এক মোহনায় উপনীত ও মরণপণ যুদ্ধ করতঃ দেশকে শত্রুমুক্ত করেছিল আর অর্জিত হয়েছিল আজন্মকালের কাঙ্খিত স্বাধীনতা। অনুরূপভাবে করোনা যুদ্ধেও আমাদের সকলকে অংশগ্রহণ করে বিজয়ী হতে হবে । মুক্তিযুদ্ধে বাঙ্গালী জাতির একাংশ যেমন সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল, আরেকাংশ মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় ও সেবা শুশ্রুষা করে উজ্জীবিত করেছিল এবং অনেকেই আশ্রয়হীন উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠীকে খাদ্য ও আশ্রয় প্রদান করেছিল। করোনা যুদ্ধেও আমাদের সকলের স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিজকে, পরিবার এবং সমাজকে রোগমুক্ত রাখতে হবে। দ্বিতীয়ত করোনা রোগীকে চিকিৎসা প্রদানে সার্বিক সহযোগিতা এবং আক্রান্ত পরিবার ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে খাদ্য ও আর্থিক সাহায্য প্রদান করে স্বাস্থ্যবিধি মানতে সহযোগিতা করতে হবে । করোনা দেশ থেকে অল্প সময়ে চলে যাবে এ ধারণা করা দুরূহ এবং সকল রোগীকে হাসপাতালে চিকিৎসা করাও সম্ভব নয় । কাজেই বঙ্গবন্ধুর “তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল” এ আহ্বানকে সামনে রেখে করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করতে ঘরে ঘরে করোনা চিকিৎসা কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে । তাহলেই ইনশাআল্লাহ দেশ করোনামুক্ত হবে এবং “এ আঁধার কেটে যাবে একদিন” মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এ উক্তি বাস্তবতা লাভ করবে।
মানুষের জন্য করিব কাজ, যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ,
আল্লাহর কাছে করিব প্রার্থনা, মানুষকে রক্ষা করেই বৃদ্ধি করুন এদেশের সম্মান,
মানুষ ও সৃষ্টির সেবা করেই আখিরাতে জান্নাতে করে নেব স্থান, এ হল মোর সুদৃঢ় পণ।
লেখক- ডাঃ মোঃ সোহরাব হোসেন, জেনারেল সেক্রেটারি- Rabies in Asia Foundation, Bangladesh Chapter
E-mail: dr.sohrabhossain@gmail.com