তথ্য, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিব্যক্তিত্ব

বাংলাদেশের মানুষের না-জানা এক বিজ্ঞানী এম. এ. জাহের

লিমন নন্দী :

পৃথিবীর যত উন্নত দেশের কথা বলা হয় তাদের দিকে তাকালে দেখা যাবে তাদের উন্নতির পেছনে ওই জাতির মহান সন্তানদের অবদান। আর সেই জাতি সেইসব জ্ঞানী-গুণীদের কদর করে তাদের সর্বোচ্চ আসনে মর্যাদা দিয়েছে। তাদের কর্মের কথা যতই প্রচারিত হয়েছে ততই নতুন প্রজন্ম উদ্বুদ্ধ হয়েছে সেইসব মহান ব্যক্তিদের দেখানো পথে নতুন আবিষ্কারের নেশায়।

তেমনি আমাদের দেশের এমন অনেক প্রতিভা জন্ম নিয়েছেন যাদের কর্মের জন্য সারা বিশ্ব তাদের স্বীকৃতি দিয়েছে কিন্তু আমাদের দেশের অনেকেই জানেন না তাদের নাম বা তাদের অবদানের কথা। বিজ্ঞানের উত্তরোত্তর সফলতার যুগে আমাদের দেশের অনেক বিজ্ঞানী নিজেদের স্ব-স্ব ক্ষেত্রে রেখে গেছেন সফলতার চিহ্ন যা আমাদের গৌরবান্বিত করে।

তেমনি একটি নাম এম. এ. জাহের

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং বাংলাদেশের একজন অজানা বিজ্ঞানী। এই বিখ্যাত লোকটি সম্বন্ধে এদেশের খুব কম মানুষই জানেন।

অথচ তিনি দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম এবং একমাত্র বিজ্ঞানী যার নামে কোনো খনিজ আকরিক (Zaherite) এর নামকরণ হয়েছে।

জাহের সাহেবের জন্ম ১৯৩৫ সালে কুমিল্লা জেলার (বর্তমানে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা) বাঞ্ছারামপুর উপজেলায়। ২০১৭ সালের ২৭ আগস্ট ৮৫ বছর বয়সে তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।

তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। তা ছাড়া তিনি ছিলেন ভূতত্ত্ববিদ ও বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর (জিএসবি)-এর সাবেক মহাপরিচালক।

৩০ বছর ধরে বাংলাদেশের ভূ-বৈজ্ঞানিক লগ তৈরি এবং বিশ্লেষণ করে ভূ-অভ্যন্তরের কাঠামো, শিলার গঠন এবং খনিজ সম্পদের বিবরণ তৈরিতে কাজ করেছেন।

তিনি খুলনার কোলামৌজায় প্রথম পিট কয়লা ও জয়পুরহাটের জামালগঞ্জে মাটির গভীরে চুনাপাথর আবিষ্কার করেন।

তিনি যখন Michigan Technological University-এর ছাত্র, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন তার স্নাতকোত্তর গবেষণাপত্রের কাজের জন্য তিনি পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের সল্ট রেঞ্জে যান। ১৯৬৯ সালে এম. এ. জাহের তার থিসিস পেপারে সল্ট রেঞ্জে সন্ধান পাওয়া এক নতুন খনিজ পদার্থের নাম উল্লেখ করেছিলেন।

‘জাহেরাইট’ হলো এক ধরনের খনিজ পদার্থ যা আবিষ্কার করেন বাংলাদেশী বিজ্ঞানী এম. এ. জাহের

১৯৭৭ সালে International Mineralogical Association খনিজ পদার্থটির নাম তার নামানুসারে Zaherite (জাহেরাইট) রাখার সিদ্ধান্ত নেয়।

Zaherite হলো অ্যালুমিনিয়ামের এক ধরনের জটিল জলীয় সালফেট। এর সংকেত [Al12(OH)26(SO4)5·20H2O]

জাহেরাইট 200° সেলসিয়াস তাপমাত্রায় তার জলীয় অংশ হারায়। এটি একটি অতেজস্ক্রিয় খনিজ পদার্থ।এর আণবিক ভর 1606.59 গ্রাম।

জাহেরাইট হল এক ধরনের খনিজ পদার্থ। এটি অ্যালুমিনিয়ামের এক ধরনের জটিল জলীয় সালফেট। এলুমিনিয়াম সালফেট অনেক কাজেই ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যেমনঃ পরিশোধন, রঞ্জনবিদ্যা, প্রিন্টিং টেক্সটাইল, কাপড় প্রিন্টিং, মাটির মান পরীক্ষা, আগুন নেভানোর কাজসহ অ্যালুমিনিয়াম পটাসিয়াম সালফেট বেকিং পাউডারেও পাওয়া যায়। এছাড়াও নির্মাণ শিল্পে এটি কংক্রিটের জলরোধক এবং বেগবর্ধক হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

তাছাড়া বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের কারিগরী ও কৌশলগতভাবে সহায়তা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।তিনি আজীবন বিভিন্ন সামাজিক ও জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন।

আমাদের দেশেই জন্ম নিয়েছেন অনেক প্রথিতযশা বিজ্ঞানী। জামাল নজরুল ইসলাম, চিকিৎসক ও চিকিৎসা বিজ্ঞানী রফিকুল ইসলাম, বিজ্ঞানী ভূতত্ত্ববিদ এম এ জাহের, মেঘনাদ সাহা। উনাদের অবদানের কথা যতদিন না জাতির সর্বস্তরে পৌঁছনো সম্ভব, ততদিন আগামী প্রজন্মের মধ্যে বিশ্বাস জন্মানো সম্ভব নয় যে আমরাও পারি।

দেশ ও জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ও আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে হলে প্রতিটি তরুণ-তরুণীর কাছে তাদের অবদানকে পরিচিত করে তুলতে হবে। তাদের কাজের স্বীকৃতি ও নতুনদের তাদের পথে যাওয়ার জন্য পাঠ্যপুস্তকে তাদের অবদানকে তুলে ধরতে হবে। তাহলেই জাতি হিসেবে আমরা সম্মানিত হবো তাদেরকে সাম্মানিত করে। আর তা দেখে গর্ব করবে, অনুপ্রেরণা পাবে বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *