বাংলাদেশের ভূস্বর্গ বান্দরবান

লিমন নন্দি :

একসময় আমাদের দেশে একটা কথা খুবই প্রচলিত ছিল তা হলো, “আমাদের দেশে কোনো সুন্দর জায়গা নেই! মানুষ ঘুরবে কোথায়! ঘুরতে হলে দেশের বাইরে যেতে হয়”। তবে ভাললাগার বিষয় হলো, এই ভুলটা কিছু মানুষ এখন বুঝতে পেরেছে। তারা এখন জানে যে আমাদের দেশে কত সুন্দর সুন্দর মনকাড়া জায়গা রয়েছে ঘুরার মত। সুন্দরবন, কক্সবাজার, কাপ্তাই, কুয়াকাটা, রাঙামাটি, ময়নামতি, পাহাড়পুর, সোনারগাঁ, রাতারগুল, বিছানাকান্দি, সাজেক, নিকলিরহাওড়, আড়িয়াল বিল, আরো কত ঘুরার মত সুন্দর সুন্দর জায়গা।

দেশের অন্যতম সুন্দর এবং সবার মন কেড়েছে যে জায়গা তা হল, বান্দরবান। বান্দরবানের অনুভূতি কেবল সেখানে গিয়েই বুঝতে হয়। তাছাড়া বুঝা যাবে না তার অনুভূতি, তার সৌন্দর্য, তার মূল্য। আমাদের এক অমূল্য সম্পদ হল বান্দরবান। যেখানেই বের হবেন বান্দরবানে সেখানেই আপনাকে তার সৌন্দর্য মুগ্ধ করবে।

বান্দরবান বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অন্তর্ভুক্ত সবচেয়ে কম জন বসতিসম্পন্ন এলাকা। চারিদিকে পাহাড়, তার দুপাশে ভেসে বেড়ানো সাদা মেঘ ও সবুজের গহীন দিগন্তে ছুটে চলার নাম বান্দরবান।

শীতের বান্দরবান যেন কুয়াশার চাদরে জড়িয়ে থাকা লজ্জাবতী নারীর আবরণ অথবা তার চেয়েও অনেক বেশি সুন্দর। ভরা বর্ষার বান্দরবান অনন্তযৌবনা যেটা কখনো বার্ধক্যে ক্ষয়ে যায় না, এতটাই অপূর্ব। তবে শেষ কথা একটাই, বান্দরবান অপূর্ব সুন্দর আর সেটা সম্ভবত পুরো বছরজুড়েই।

গন্তব্যহীনভাবে ছুটে চলা মেঘমাল্লার দলের বিশাল বিশাল পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খেয়ে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়া, ঘন বর্ষার অঝর ধারায় প্রাণ পেয়ে নব উদ্যমে ছুটে চলা ঝর্ণা ধারা, পাহাড়ের পাদদেশ ধরে পাহাড়ি খরস্রোতা নদী সাঙ্গুর বয়ে চলা এবং মেঘমাল্লার দলকে আলতো স্পর্শে ছুঁয়ে দেখার অনুভূতি নিয়ে ফিরতে চাইলে আপনাকে ঠিক বান্দরবানেই যেতে হবে।

পাহাড়ি জনপদে পাহাড়ের আনাচে-কানাচে সবুজের উপস্থিতি, সাথে ভিন্ন ভাষার ১১টি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর বৈচিত্র্যময় জীবনধারা এবং সংস্কৃতি – নিঃসন্দেহে বান্দরবানকে পূর্ণতা দিয়েছে। বিশাল পাহাড়ের সম্রাজ্যে অসাধারণ সব ঝর্ণাধারা, অপূর্ব পাহাড়ি খরস্রোতা নদী, মেঘমাল্লার দলের অলস ওড়াউড়ি এবং উপজাতিদের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি – আমার সাদা চোখে এটাই বান্দরবানের সবচেয়ে সুন্দর বিজ্ঞাপন।

নীলাচল, মেঘলা পর্যটন কেন্দ্র, স্বর্ণ মন্দির, মিলনছড়ি, শৈলপ্রপাত, চিম্বুক, নীলগিরি, বড় পাথর, নাফাখূম জলপ্রপাত, প্রান্তিক লেক, বগা লেক, কিওক্রাডং, তিনাপ সাঁইতার, আমিয়াখূম, রুমা বাজার, চিংড়ি ঝর্ণা, দার্জিলিং পাড়া, জাদিপাই ঝর্ণা আরো কতশত নাম। নামের মধ্যে যেমন বৈচিত্র্য তেমনি সৌন্দর্যেও বৈচিত্র্যময় প্রতিটি জায়গা।

বান্দরবান শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া পাহাড়ি সাঙ্গু নদীর দু-কূলের নৈসর্গিক সৌন্দর্য অপরূপ। নৌকা বা ইঞ্জিনচালিত বোটে চড়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকন করার মজাই আলাদা। নদীপথে ভ্রমণ করলে নদীর তীরে পাহাড়িদের বিশেষ কায়দায় তৈরি টংঘরগুলো দেখা যায়। সেই সাথে উঁচু পাহাড়ের কূল ঘেঁষে বয়ে চলা সাঙ্গু নদীর অপরূপ সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হওয়ায় মতো। শহর থেকে একটু দূরে ভাটির দিকে শীতামুড়া পাহাড় প্রকৃতির অপূর্ব সৃষ্টি দেখে ভোলার নয়। এ ছাড়া উজানে তারাছা রেঞ্জের নৈসর্গিক সৌন্দর্য সত্যি অসাধারণ। ঝলমলে আকাশের নীল যেন মিশেছে রেমাক্রির জলে। আমরা বিদেশি ভূ-স্বর্গের গালগপ্পো শুনি। দেখি স্রোতস্বিনী পাহাড়ি নদী, বন আর পাহাড়ের মেলবন্ধনের অপার্থিব সব দৃশ্য। কিন্তু নিঃসন্দেহে বলা যায় পৃথিবীতে যত সৌন্দর্যই থাক না কেন একজন বাঙালি একবার বান্দরবান গেলে সবকিছু ভুলে দেশীয় সৌন্দর্যের প্রেমে পড়বেই।

■ যেখানেই ঘুরতে যাই না কেন সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নিজের জীবনের নিরাপত্তা। কাজেই, আমাদের সামান্য অবজ্ঞা আর অসচেতনতায় কোনো প্রাণ যেন ঝরে না পড়ে। জীবন একটাই, বেঁচে থাকলে হাজারো জায়গা হাজারো বার ভ্রমণ করা যাবে। কিন্তু একবার চলে গেলে ফিরে আসার কোনো সুযোগ নেই। তাই অনুরোধ, অতি উৎসাহী হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কোনো ঘোরাঘুরি নয়।

■ পর্যটন শিল্পের বিকাশের স্বার্থে প্রকৃতিকে রক্ষা করা আমাদের সকলের নৈতিক দায়িত্ব। তাই অনুরোধ, কোনো ধরনের পথিলিন, প্লাস্টিক অথবা যে কোনো বর্জ্য যথাস্থানে ফেলুন। যথাস্থান না থাকলে সাথে ছোট্ট ব্যাগ রাখুন। তবুও প্রকৃতি এবং পরিবেশকে রক্ষা করা উচিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *